প্রবন্ধ

শহীদের নাম মেহেরুন্‌নেসা

Spread the love

‘একাত্তর সাল পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সে একাত্তরের কথা বলার চিন্তা যখন করি, আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা প্রবল আতঙ্কস্রোত প্রবাহিত হতে থাকে, একটা মহান পবিত্র ভীতি সর্বসত্তা গ্রাস করে ফেলে। আমার মনে হয় একাত্তর সম্পর্কে কোন কিছু আমি কস্মিনকালেও ভুলতে পারব না।’

–আহমদ ছফা (২০২৩: ৭১)

 

১৯৭১ সালে– প্রায় পুরোটা বছর ধরিয়াই বাংলাদেশে গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়াছে। পুরোটা মানে মাত্র মার্চ হইতে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয়। পরের বছর ৩০ জানুয়ারি নাগাদ সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধানকেও এই বছরের মধ্যে গণ্য করা যায়।

কবীর চৌধুরী তারপর যোগ করিতেছেন: ‘ফোনে গলা শুনেছি, চোখে দেখিনি। কিন্তু কল্পনায় দেখেছিলাম, আজও দেখি, সে চোখে সেদিন আলো জ্বলে উঠেছিলো। কিন্তু ১৪ই ডিসেম্বর, স্বাধীনতার কয়েক ঘণ্টা আগে মাত্র, সে আলো চিরদিনের জন্য নির্বাপিত করে দিলো বর্বর পশুশক্তি।’ (স্মারকগ্রন্থ, ১৯৯৪: ৮)

শহীদ মেহেরুন্‌নেসার পরিণত বয়সের বন্ধু কবি কাজী রোজী জানাইতেছেন, পশ্চিমবঙ্গ হইতে মাত্র আসিয়াই ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করেন নাই মেহেরুন্‌নেসা। সংগ্রামের একটা বন্ধুর পথ তাঁহাকে অতিক্রম করিতে হইয়াছিল: ‘১৯৫০ সালের পর থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় নানাজনের বাসায় ভাড়া থাকেন মেহেরুন্‌নেসার মা-বাবা এবং ভাইবোন। ১৯৬৫ সালে অনেক চেষ্টার পর কিস্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে মিরপুরে ডি-৬, ১২/৮-এর বাড়িতে সবাই মিলে বসবাস শুরু করেন। এটাই হয় কবি মেহেরুন্‌নেসার স্থায়ী ঠিকানা।’ (রোজী ২০১১: ১৫)

এই মিরপুরেই অবশেষে শহীদ হইবার গৌরব অর্জন করিলেন তিনি। গুলজার নামক জনৈক প্রতিবেশী প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে বোনের করুণ পরিণতির বয়ান শুনিবার পর মেহেরুন্‌নেসার বড় বোন মোমেনা খাতুন ঘটনার একটি বিবরণ দিয়াছেন। কাজী রোজীর বাড়ি হইতে মেহেরুন্‌নেসার ছোট ভাই– নাম রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবলু– নিজ বাড়িতে ফিরিয়া আসেন মার্চের ২৬ কি ২৭ তারিখ। ঐ সময় মাথায় শাদা পট্টিবাঁধা বিহারীদের একটি দল রফিককে দেখিয়া ফেলে। আর দেখিবা মাত্র চিৎকার করিয়া ওঠে। পরে–২৭শে মার্চ তারিখেই–ধর ধর বলিয়া চারদিক হইতে রফিককে চল্লিশ কি পঞ্চাশ জন লোক ঘিরিয়া ফেলে।

মোমেনা খাতুনের জবানে গল্পের বাকিটুকু শোনা যাইতে পারে: “[লোকগুলি] ভিতরে ঢুকে প্রথমে মেহেরুন্‌নেসা (রানু)র ঘাড়ে একটা কোপ দেয়, ওর মাথাটা কেটে নিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয়। রফিকুল ইসলাম বাবলুকে একইভাবে মেরে তাঁর কর্তিত মাথা নিয়ে ফুটবল খেলতে থাকে। [মেহেরুন্‌নেসার অপর ভাই] শহিদুল ইসলাম টুকুকে মারার পর ওরা চলে যাওয়ার সময় আমার মা বলে ওঠে ‘আমাকে আর রেখে যাচ্ছ কেন?’ তখন ওরা মাকে একটা কোপ দিয়ে যায়। রাত ১০/১২টা পর্যন্ত আমার মা’র প্রাণ ছিল।” (রোজী ২০১১: ২৬)

মেহেরুন্‌নেসার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তাঁহার একদা সহকর্মী বেগম মকবুলা মনজুর বিলাপ করিয়াছেন: ‘কল্পনা করতেও শিউরে উঠি, উনিশ শ একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চের সেই ভয়াবহ দিনটিতে যখন ঢাকা শহর দাবানলগ্রস্ত পশুর মতো দিশাহারা, প্রাণভয়ে কম্পমান, তখন সেই সময়ে মেহেরুন্‌নেসার অবাঙালি প্রতিবেশীরা ঐ কুসুমপ্রতিম তরুণী আর দুটি ভাইকে এক সাথে বেঁধে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে ওদেরই বৃদ্ধ মায়ের চোখের সামনে। তিনটি তরুণ কণ্ঠের তীব্র চিৎকার আর তাদের মায়ের করুণ আর্তনাদে সেদিন মিরপুরের কালো আকাশ শিউরে উঠেছিল, রুদ্ধদ্বার গৃহে প্রতিবেশীরা আতঙ্কে কানে হাত চাপা দিয়েছিল। কিন্তু মেহেরুন্‌নেসাদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে কেউ সাহসী হয়নি।’ (রোজী ২০১১: ৪৯-৫০)

বেগম মনজুরের এই লেখা জুন, ১৯৭২ সালের। প্রকাশ ‘দৈনিক বাংলা’য়। তাঁহার আক্ষেপ: ‘বেঁচে থাকতে মেহেরুন্‌নেসা যোগ্য স্বীকৃতি পায়নি, মরণেও পায়নি শহীদের যথার্থ মর্যাদা। তাঁর জন্য আমরা কিছুই করিনি। কোন একটি শিক্ষা কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নাম অথবা কোন মহিলা ছাত্রীনিবাস কিংবা কোন সড়কের নামফলকে কখনও কারুর দৃষ্টিগোচর হয়নি মেহেরুন্‌নেসার নাম।’ ১৯৭২ সালের পর কোথায়ও হইয়াছে কি? আমার জানার সুযোগ হয় নাই। দৃষ্টিগোচর না হওয়াটাই স্বভাব। হইয়া থাকিলে ব্যতিক্রম বিশেষ।

ইহার কারণ কি তাহা জানা সুদূরপরাহত হইলেও অসম্ভব নহে। নূরজাহান বেগমের লেখা হইতে খানিক আভাস পাইলাম। বেগম সাহেবা লিখিয়াছেন: ‘দারিদ্র্য-পীড়িত মা-বাবার মেয়ে রানুর জীবনে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ ঘটেনি। তবু বাবার উৎসাহে আর বড় বোনের সাহায্যে যতটুকু লেখাপড়া সে শিখেছিল তাকে প্রচলিত উচ্চশিক্ষার কোনো মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা যায় কিনা জানি না,
কিন্তু দেখেছিলাম, ওর মানসলোক সুশিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত।’

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থে লেখা হইয়াছে, ‘বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় [তিনি] প্রুফ দেখতেন এবং ফিলিপ্স কোম্পানিতে চাকুরি করতেন।’ (স্মারকগ্রন্থ ১৯৯৪: ৪৯) মেহেরুন্‌নেসা অবশ্য আরো একটি কাজ করিতেন। আর তাহা খোদ বাংলা একাডেমিতেই। মকবুলা  মনজুর লিখিয়াছেন: ‘আমরা দু’জন তখন বাংলা একাডেমীতে কপি লেখার কাজ করতাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। ক্লাসের ফাঁকে অথবা শেষে আসতাম বাংলা একাডেমীতে। মেহেরুন্‌নেসা আসত কোন্‌ যেন পত্রিকা অফিস থেকে প্রুফ দেখার কাজ সারা করে। পৃষ্ঠাপ্রতি পঁচিশ পয়সা হিসাবে লেখা, প্রতিপৃষ্ঠায় কমপক্ষে ষোল লাইন লেখা চাই। আমার ভালো লাগত না, ক্লান্তবোধ করতাম। কিন্তু কি অক্লান্ত ছিল মেহেরুন্‌নেসা! বাঁ হাতে কলম ধরে বাঁকা বাঁকা হরফে লিখে চলত। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হবার মুখে যখন আমরা উঠে পড়তাম তখনও তাঁর কলম চলেছে।।’ (রোজী ২০১১: ৪৮)

মকবুলা মনজুরের সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য: ‘শুধু বাংলা একাডেমীতে কপি লেখার কাজই নয়, ওঁকে দেখেছি একাধিক পত্রিকা অফিসে প্রুফ দেখতে, ছোটখাট ফিচার লিখতে। আর কবিতা লেখার তো বিরাম ছিল না। … খুচরা উপার্জনে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল বলে পাকাপাকিভাবে চাকরিতে নামতে হলো মেহেরুন্‌নেসাকে। ফিলিপ্‌স ওয়ার্কশপে চাকরি। কবিতার প্রাণ তখন ইস্পাতের চাকায় চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। দিনে আট ঘণ্টার ডিউটি, তার ওপর ওভারটাইম। বাঁচার জন্য, বাঁচাবার জন্য টাকা চাই। মেহেরুন্‌নেসা তখন সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারত না।’ (রোজী ২০১১: ৪৮-৪৯)

মকবুলা মনজুরের আর্তি আমার কানে প্রবেশ করিয়াছে। হাত চাপা দিয়াও ঠেকাইতে পারি নাই। মেহেরুন্‌নেসা শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অধিক কিছু। মকবুলা লিখিয়াছেন: ‘চাকরি এবং লেখা দুটো কাজ এক সাথে করেও কেন মেহেরুন্‌নেসার অভাব দূর হয়নি? এ প্রশ্ন অনেকেই করত সে সময়ে। এর জবাব আমার জানা। মেহেরুন্‌নেসা ছিল অবহেলিত প্রতিভা। তাই তার প্রচুর কবিতা ছাপা হলেও কবিতার মূল্য সে পায়নি–অর্থাৎ যোগ্য সম্মানী পায়নি। বহু সুপ্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়েছে, কিন্তু সেই সব পত্রিকা একটা পয়সাও দেয়নি তাকে। কেন দেবে?

মেহেরুন্‌নেসা যে অনেক পথ হেঁটে ধুলো পায়ে এসে পত্রিকা অফিসে কবিতা পৌঁছে দেয়। যাঁদের কবিতার জন্য বিল করা হতো, পত্রিকা অফিসে এলে যাঁদের সম্ভ্রমে আপ্যায়িত করা হতো, মেহেরুন্‌নেসা তাঁদের দলে পড়বার মতো নয়।’ (রোজী ২০১১: ৪৯)

মকবুলা মনজুরের বাক্য দিয়াই তবে এই নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের যবনিকা টানি: ‘তাঁর একমাত্র জীবিত আত্মীয় বড় বোন একসময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রীনিবাসের নামকরণ শহীদ কবি মেহেরুন্‌নেসার নামে করার অনুরোধ জানিয়ে দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন। কিন্তু তাঁর ক্ষীণকণ্ঠ বেশিদূর পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই থেমে গিয়েছে।’ (রোজী ২০১১: ৫০)

৫২ বছর পর সেই কণ্ঠ আর হয়তো শোনাই যাইবে না কোনদিন। সান্ত্বনার মধ্যে, ২০০৮ সালে অধ্যাপক হাফিজা বেগম কবির শতাধিক কবিতাসহ ‘মেহেরুন্‌নেসার জীবন ও কাব্যসংগ্রহ’ প্রকাশ করিয়াছিলেন, আর কবি কাজী রোজী ২০১১ সালে প্রকাশ করিয়াছেন ‘শহীদ কবি মেহেরুন্‌নেসা’।

১৩ ডিসেম্বর ২০২৩

দোহাই

১. আহমদ ছফা, ‘একাত্তর: মহাসিন্ধুর কল্লোল’, সলিমুল্লাহ খান (সম্পাদিত), বেহাত বিপ্লব ১৯৭১, ২য় সংস্করণ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী এবং এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ২০০৯), পৃ. ৭১-৮৯।

২. কাজী রোজী, শহীদ কবি মেহেরুন্‌নেসা (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০১১)।

৩. –– [সম্পাদকের নাম নাই], শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ, পুনর্মুদ্রিত (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪)।

 

প্রকাশ: সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩।