প্রবন্ধ

আদমবোমা: ৩, আদমবোমা না স্বাধীনতা-ব্যবসায়

Spread the love

talal-a-1.jpgতালাল আসাদ, ২০০৮

আত্মঘাতী বোমা প্রসঙ্গে তালাল আসাদের বক্তব্য বিচার

নতুন ইয়র্ক নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক তালাল আসাদ ২০০৬ ইংরেজি সনের মে মাসে কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবিন নামক পরিসরে তিনটি বক্তৃতায় আত্মহত্যাকারী বোমা আক্রমণ বিষয়ে বিচার ও আলোচনা করিয়াছিলেন। পরের বৎসর নতুন ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সেই বক্তৃতামালা লইয়া একখণ্ড ছোট মাপের বই ছাপাইয়াছেন। প্রকাশিত প্রথম দুই বক্তৃতায় তালাল আসাদ আলোচনা করিয়াছিলেন দুই প্রশ্নের: পশ্চিম জগতের নীতি-নির্ধারকরা ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘ত্রাসনীতি’ বলিতে কী বোঝেন আর তাঁহাদের বিচারে কোনো কোনো মানুষ কেনই বা ত্রাসনীতির চরম প্রকাশস্বরূপ আত্মহত্যার মতন বোমা ফাটায়।

তালাল বইআমি ২০০৭ সনের শেষের দিকে এই দুইখানা বক্তৃতা লইয়া দুই আলোচনা করিয়াছিলাম। তাহার কিছু কিছু সমালোচনাও কেহ কেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন। আমি নিজেও এই জাতীয় বোমা আক্রমণ সমর্থন করি কিনা প্রায় সকলেই এই আশঙ্কাজাত প্রশ্ন করিয়াছিলেন। ইহার উত্তর দেওয়া আমার মনে হইয়াছিল অনাবশ্যক। তালাল আসাদের লেখাতেই বরং ইহার উত্তর খোঁজা যাইতে পারে। জ্ঞানী সমালোচকদের জিজ্ঞাসার জওয়াব খোদ তালাল আসাদই উত্তম দিয়াছেন বলিয়া আমার মনে হইয়াছে। এক কথায়,প্রশ্নটা সমর্থনের বা বিরোধের নহে,উত্তরটাই অর্থের।

তালাল বলিয়াছেন তিনি নিজেও তাঁহাদেরই দলে যাঁহারা যুদ্ধে ব্যবহৃত সাধারণ বা গুচ্ছ (cluster) বা নিশ্ছিদ্র (carpet) প্রভৃতি বোমার তুলনায় আদমবোমায় বেশি শিহরণ বোধ করেন। শিহরণ বা ইংরেজি ‘হরর’ কথা দিয়া তিনি এমন কোনো প্রতিক্রিয়ার কথা বলিতেছেন যাহা ঠিক আতঙ্ক নহে। আর আতঙ্ক বলিতে ‘ভয়’ নামক যে অনুভূতির চরম প্রকাশ চিহ্নিত হয় সেই ভয়ও ঠিক নহে। সুতরাং সমর্থনের প্রশ্নই উঠিতেছে না।

পার্থক্যের মধ্যে, তালাল আসাদ আর দশ পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ বা প্রাচ্য বিশারদের মতন নিতান্ত সমর্থন করি না বা নিন্দা করি বলিয়া তুষ্ট থাকিতে চাহেন না। পশ্চিমা পণ্ডিতদের এক বড় অংশই আত্মহত্যা বা আদমবোমার নিন্দা করিয়া বলেন এই বোমাবাজি কাজটি যাহারা করে তাহারা সভ্য নহেন,তাহারা ‘অসভ্য’ (বা বড়জোর ‘বর্বর’)। অর্থাৎ আদমবোমা ব্যাপারটি সভ্যতা ও বর্বরতার মধ্যকার সংঘর্ষ। শুনিতে ভালো লাগিবে না বিধায় মধ্যে মধ্যে তাঁহারা ‘সভ্যতার সহিত সভ্যতার সংঘাত’ বা এই জাতীয় কিছু কথা ব্যবহার করিয়া থাকেন। তালাল তাঁহাদের নিকুচি করেন।

পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এক বড় অংশ একই সঙ্গে এই কথাও বলেন যে আত্মহত্যা বোমা কেবল বিশেষ এক সভ্যতার—যাহার নাম এক্ষণে এসলামি সভ্যতা—অন্তর্গত সত্য। তালাল আসাদ এই মতের পোষকতা করেন না। তিনি মনে করেন আদমবোমা কোনো ধর্ম বা সভ্যতাবিশেষের অন্তর্গত সত্য নহে, ইহার গোড়া দেখিতে হইবে বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতির মধ্যে। যতদিন আমরা ইহা বুঝিতে না পারিব ততদিন আমরা ইহার হাত হইতে নিস্তার পাইব না।

ত্রাসনীতি ও আদমবোমার ত্রাসনীতি—এই দুই প্রশ্নের গোড়ায় একই পদ্ধতি কাজ করিতেছে। সকলেই প্রশ্ন করিতেছেন: বোমারুর ব্রত,মতলব বা প্রবর্তনাটি কী বস্তু। তাহারা কী কারণে বা কোন অকারণে এহেন গর্হিত কাজে পৃথিবী নোংরা করিতেছে? তালাল আসাদ তাঁহার তিন নম্বর বক্তৃতায় সেই প্রশ্ন সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলিয়াছেন।

তিনি বলিতেছেন: প্রশ্ন কেবল বোমারুর মতলব সন্ধানের মধ্যে সীমিত রাখায় ফল হইতেছে না। প্রশ্ন করা উচিত আমাদের মধ্যে কেন এই শিহরণ জাগিতেছে? কেন আমরা যাঁহারা বোমার খবর শুনি বা ছবি দেখি তাঁহারা এমন করিয়া কাঁপিয়া উঠি? আসাদের ধারণা, এই প্রশ্নটিও যদি একই সঙ্গে না করা হয় তো ঘটনার পুরা ছবি ধরা পড়িবে না।

তালাল আসাদ দ্বিতীয় এয়ুরোপীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ কিংবা বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ সকল জায়গা হইতে উদাহরণ সমবায় করিয়া দেখাইতেছেন শিহরণ নামক প্রতিক্রিয়ার দুই পর্ব। প্রথম পর্ব যখন ঘটনা ঘটে তখনকার। ইহাতে সঙ্গে সঙ্গে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাহাকে সচরাচর বলে অবাক কিংবা হতবাক হওয়া। পরে যখন সেই ঘটনার স্মরণ কিংবা বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা হয় তখন ঘটে দ্বিতীয় পর্ব।

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এই শিহরণের কারণ খুঁজিয়াছেন ঘটনার আকস্মিকতার মধ্যে, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন বিস্ফোরণের মধ্যে। আবার কেহ কেহ ইহার কারণবীজ খুঁজিয়াছেন আক্রান্ত আর আক্রমণকারীর রক্তমাংস একসঙ্গে জড়াজড়ি করার ঘটনার মধ্যে। ১৭ শতকের ইংরেজ মহাকবি জন মিল্টনও এই জড়াজড়ি দেখিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার শিহরণ হয় নাই। (মিল্টন ১৯৮২: ৮৪) এই শিহরণের উৎস বা শিকড় ব্রিটিশ পণ্ডিত জ্যাকুলিন রোজ (Jacqueline Rose) সন্ধান করিয়াছিলেন এই নৃশংস মিলনের ভিতর। প্রচলিত যুদ্ধের নৃশংসতা হইতে এই নৃশংসতার একপ্রস্ত পার্থক্য শ্রীমতি রোজ দেখিয়াছিলেন খোদ আক্রমণকারীর পরিকল্পিত মৃত্যুর মধ্যে। দুঃখের মধ্যে, তিনিও সেই তদন্ত সম্পূর্ণ করেন নাই। (রোজ ২০০৪; দেখুন, আসাদ ২০০৭: ৬৫-৬৭)


তালাল আসাদ মনে করেন জ্যাকুলিন রোজের পরিত্যক্ত প্রথম প্রশ্নের পথেই সত্যের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা অধিক। শ্রীমতি রোজের দ্বিতীয় প্রশ্ন সেই পুরাতন পথে ফিরিয়া যাওয়া মাত্র। নিজেকে বাঁচাইয়া শত্রু নিধন করিবার তুলনায় নিজের প্রাণ দিয়া শত্রু সংহার করা কেন নীতির বিচারে নিকৃষ্টতর গণ্য হইবে? ইহাই ছিল শ্রীমতি রোজের দ্বিতীয় প্রশ্ন। আসাদ দেখিতেছেন, ইহার মর্মকথাও অপরাপর পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের প্রশ্নের অন্যথা নহে: আত্মহত্যাকারীর নৈতিক অবস্থান, তাহার পাপ, তাহার অপরাধ, তাহার বর্বরতা বা অসভ্যতার পরিমাপ জানাই ইহার নিহিত উদ্দেশ্য।

অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে ঘটনার সাক্ষী বা দর্শক যে তাহার মনের ভাব কোন অবস্থায় থাকে জানিবার বিষয় তাহাই। হিরোশিমা কি নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফুটিয়াছিল কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়া। আজও দুনিয়ার এই দেশে সেই দেশে মাটিতে পুঁতিয়া রাখা মাইন শত শত মানুষ, শিশু-যুবা-বৃদ্ধ নির্বিশেষে, পঙ্গু কিংবা হত্যা করিতেছে। তাহাতেও বিপুল শিহরণ ঘটে। কিন্তু তাহার তুলনায় আদমবোমার শিহরণ অধিক কেন?

আরো প্রশ্ন করিতে হয়। কালো মানুষ কালো মানুষকে আদমবোমায় আঘাত করিলে—যেমনটি শ্রীলঙ্কায় তামিল ও সিংহলিদের যুদ্ধে হইতেছে কিংবা ঘটিতেছে এরাকি স্বাধীনতাকামীদের সহিত সেই দেশের মার্কিন সহযোগীদের সশস্ত্র সংঘাতে—পশ্চিম জগতের মানুষজন তেমন শিহরণ বোধ করে না। অথচ অন্য সময়—যখন কালো মানুষের দল এয়ুরোপের কোনো কোনো যোদ্ধা কিংবা এয়ুরোপীয় বংশের কাহাকেও হামলা করিলে—তাহারা ঢের বেশি শিহরিত হয়।

কিন্তু কেন? পরদেশ দখল করিয়া শাসন ও শোষণ করিবার ইতিহাসেই ইহার গোপন কথা নিহিত আছে—তালাল আসাদের এই কথা সত্য। তবুও আসাদের প্রশ্নের সত্যটা সত্য কেন সেই রাহা এইখানে হইল না।

আদমবোমারু নিজেও মারা যায়। ইহাও সত্য কথা। মানুষের মৃত্যু মাত্রই মানুষের হৃদয়কে ব্যথিত করিবে। কিন্তু আদমবোমায় যে শিহরণ তাহার তুলনা সাধারণ মৃত্যু দিয়া হইতেছে না। উদ্বেগ ও রাগে, উৎকণ্ঠা ও ক্রোধে ইহার ব্যাখ্যা শেষ হইবে না। তাহা হইলে সন্ধান করিতে হইবে আত্মহত্যা করিয়া হত্যা করিলে আমরা যে একটু অধিক কাতর হইয়া পড়ি তাহারই বা কারণ কী? আদমবোমারুর সহিত এইখানে কি আমাদের অন্তরের কোথাও কোনো যোগসাজশ আছে?

এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করিয়া তালাল আসাদ দুই দফা প্রস্তাব হাজির করিয়াছেন। তাঁহার প্রথম প্রস্তাব: আদমবোমারুর সহিত আমাদের যোগাযোগ দুই জায়গায়। আমরা যাঁহারা আধুনিক এয়ুরোপের নানা রাষ্ট্রের নাগরিক অথবা যাঁহারা ভাষায়, সংস্কারে, আচারে এয়ুরোপীয় হইয়া উঠিয়াছি তাঁহারা অনেকেই নিজেদের বলি লিবারেল, সেকুলার কিংবা মডার্ন। এই লিবারেল মানে হইতে পারে স্বাধীনতাবাদীও। ‘উদারনৈতিক’ কথাটার তুলনায় ইহা বরং মূলের অধিক অনুগামী। বাংলায় আমি ইহারই তর্জমা প্রস্তাব করিলাম ‘স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী’।

আমরা কি কথায় কথায় বলি না, যে কোনো মূল্যে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করিব? যে কোনো মূল্যে গণতন্ত্র রক্ষার কথাও শোনা যায়, কেহ কেহ স্ব স্ব ধর্ম রক্ষার কথাও প্রচার করেন। যে কোনো মূল্যের কথা আসে কেন? আসে চরম মূল্য অর্থে। এই চরম মূল্যেরই অপর নাম জীবন। নিজের জীবন দান করিয়া দেশরক্ষার শপথ বর্তমান যুগের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষই লইয়া থাকেন।

অর্থাৎ স্বাধীনতার মূল্য হিসাবে জীবন দেওয়া জীবনের অতি তুচ্ছ ব্যবহার, ইহাই আমরা নিত্য বলিতেছি। যুদ্ধে আমার জীবন দান এক প্রকার নিশ্চিত ব্যাপার। জাতির বা দেশের প্রয়োজনে (কেহ কেহ বলিবেন আদর্শের প্রয়োজনে) জীবন দিতে যিনি কার্পণ্য করেন না তাঁহাকেই আমরা শহিদ, বীর বা বীরশ্রেষ্ঠ প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করি। তাই না!

আদর্শটা যাহাই হউক, তাহা সঙ্গত না বিসঙ্গত সেই তর্ক আপাতত স্থগিত রাখিয়াও বলা যায়, জীবনদানের বৈধতা আমাদের অগোচর নহে। আদমবোমারুর কাজে আমরা কি আমাদেরই ভিতরের পরিচয়টা প্রকাশিত হইতে দেখি না? আমাদের শিহরণের গোপন কারণ কি ইহাও হইতে পারে না? এই প্রশ্নেরই নাম আমি রাখিলাম: তালাল আসাদের প্রথম প্রস্তাব।

আধুনিক, ইহলৌকিক, স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী নাগরিকের জন্য দেশ জাতি রাষ্ট্র আদর্শ প্রভৃতি রক্ষার্থে আত্মোৎসর্গ করা তুচ্ছ জিনিস। ইহা তিনি নিজে করিবেন স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু অন্যেও যদি একই কাজ করে, একই পথ ধরে তবে তাঁহার আতঙ্ক শিহরণে পরিণত হয়। যাহাকে তিনি স্বাভাবিক বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলেন, তাহাই অস্বাভাবিক বলিয়া প্রকাশ পায়। এই ধরা পড়িয়া যাওয়ার জন্যই কি তিনি শিহরিয়া উঠিতেছেন?

ধরা পড়িয়া যাওয়া ব্যাপারটির আর একটি অর্থও কিন্তু আছে। দেশ জাতি প্রভৃতির জন্য আত্মদানে আধুনিক মানুষ কসুর করে না। করিলে তাহার স্বাধীনতা কোথায় থাকে? অথচ একই সঙ্গে আধুনিক মানুষ দাবি করে: ধর্ম প্রভৃতি সংস্কার হইতেও তাহারা স্বাধীন। তাহাদের স্বাধীনতা পারলৌকিক নহে, ইহলৌকিক। যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা রক্ষার শপথ করিবার পর তাহাদের এই দাবি যে বেশ অসার আত্মপ্রতারণা তাহাও ধরা পড়িয়া গেল। তলে তলে তাহাদের আবেগ আগের দিনের ধর্মীয় বা পৌরাণিক আবেগ হইতে মোটেও স্বাধীন কিংবা স্বতন্ত্র হয় নাই—এই সত্যে সন্দেহ থাকে না।

যাহাকে বলে আদমবোমা তাহা আধুনিক মানুষেরই নেমেসিস। আর আদমবোমারু সেই সত্যই প্রকাশ করিয়া দিয়াছে। সেই জন্যই কি আমরা—আধুনিক ইহলোকবাদী স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীরা—শিহরিয়া উঠি?

আধুনিক স্বাধীনতা-ব্যবসায় ও পৌরাণিক ধর্ম-ব্যবসায় একসূত্রে গাথা এহেন দাবি তালাল আসাদ সরাসরি করেন নাই। তবে তিনি দাবি করেন আধুনিক স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের গোড়ায় যে সকল স্রোতস্বিনী জলসিঞ্চন করিয়াছে—আজও করিতেছে—তাহার মধ্যে, বিশেষ পশ্চিম জগতে, এয়াহুদি-নাসারা ধর্ম-ব্যবসায়ের ধারাই অধিক কার্যকর। আদমবোমায় আমরা যেভাবে কাঁপিয়া উঠি তাহার অন্যতম সূত্র এয়াহুদি-নাসারা ধর্মধারায় পাওয়া যায় আর এই ধর্মধারায় তাহা অনুমোদন লাভ করিয়াছে স্ববিরোধী আকারে। ইহাই তালাল আসাদের দ্বিতীয় প্রস্তাব।

ফলে আমরা বলিতে পারি আদমবোমারুর পাপের মধ্যে এই পাপও আছে যে সে এয়াহুদি-নাসারা ধর্মের অনুসারীদের মনে করাইয়া দিতেছে তাহাদের ধর্মের ভিত্তিস্থলেও একই ঘটনা বর্তমান। রক্তমাংসের জড়াজড়ি নয়, আত্মায় আত্মায় এই জড়াজড়িই কি সেই নিহিত কারণ যাহার কথা বিস্মরণের গর্ভ হইতে স্মরণপথে উদিত হইলে স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীর শিহরণ ঘটে?

আধুনিক স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের ভিত্তিতে যে জীবনবিরোধী আত্মদানের নীতি নিত্য বর্তমান, প্রাচীন এয়াহুদি-নাসারাদি ধর্মেও সেই একই জীবনবিরোধী আত্মদান নীতির প্রাবল্য। আত্মহত্যাকারী বোমারু সম্ভবত সেই কথাই আমাদের মনে করাইয়া দিতেছে। যাঁহারা বলেন আত্মহত্যাকারী বোমাবাজ জঘন্য সন্ত্রাসবাদী আর স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য যাঁহারা প্রাণ দিয়াছেন তাঁহারা ন্যায়যোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা তাঁহাদের প্রস্তাবের তলায় মাটি তাহা হইলে থাকে কোথায়?

তৃতীয় ওয়েলেক লাইব্রেরি বক্তৃতায় তালাল আসাদ প্রশ্নের মুখ এই দিকেই ঘুরাইয়াছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিতেছেন, মামলা ন্যায়নিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী বনাম জঘন্য সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে নহে। সত্য ঘটনা বরং উল্টাই। আদমবোমা কথাটা নতুন শোনাইলেও শোনাইতে পারে, কিন্তু ঘটনাটা তো অনেক অনেক দিন আগে হইতে চলিয়া আসিতেছে। আদমবোমারুকে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা বলিতে অনেকেরই আপত্তি। তাই আসাদ পাল্টা জিজ্ঞাসা করিতেছেন: আধুনিক যুগের স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী রাষ্ট্র ও ইহার মনীষীবর্গ কি অস্বীকার করিতে পারিবেন আদমবোমাবাজি তাঁহাদেরও বংশ-পরম্পরার অংশ বা উত্তরাধিকার নহে?

এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলিবার সাধ্য যেহেতু কাহারও নাই, সঙ্গত কারণেই সিদ্ধান্ত হইবে সমস্যা খোদ স্বাধীনতা-ব্যবসায় অর্থাৎ লিবারেলিজমের মধ্যেই লুকাইয়া রহিয়াছে। স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব হইতে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে ইহার সমাধান।

অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরাজমান না থাকিলে স্বাধীনতার সহিত দাসপ্রথা, সার্বভৌমত্বের সহিত পররাজ্য-গ্রাসনীতি, ঔপনিবেশিক শাসন কেমন করিয়া সহাবস্থান করিতে পারে? এয়ুরোপে যে নরঘাতক নীতির জন্য জার্মানির আর্যব্যবসায়ী হিটলার মানবজাতির অভিসম্পাত আজি অবধি কুড়াইয়া যাইতেছে, সেই একই নীতির অধিক গিয়াও ফরাসি, ইংরেজ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, মার্কিন ঔপনিবেশিক নীতি প্রভৃতি কী করিয়া বাহবা পাইতে পারে? কী করিয়া স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের নামে হাততালি লইতে পারে?

স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের একমুখে আছে স্বাধীনতার বুলি, কিন্তু তাহার পায়ের নিচে দাবানো সারা পৃথিবীর কোটি কোটি পরাধীন, অর্ধ-পরাধীন মানুষ। এয়ুরোপ যাহাদের নরাধম-জ্ঞানে দাসত্বের শৃঙ্খল পরাইয়াছিল আজও তো তাহারা পূর্ণ মুক্ত হয় নাই।

১৯৪৭ সনের ভারত বিভাজন ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর হইতে আমরা যে যুগের সূচনা দেখিয়াছি সেই যুগকে বলে পরাধীনতাবসানের যুগ (age of decolonization)। কিন্তু তাহার এক বছরের মাথায় ফিলিস্তিনে নতুন করিয়া পরাধীনতার যুগ শুরু হইল কী করিয়া? (আহমদ ২০০৬/ক) স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। ইহা তাহার অকাট্য প্রমাণ।

তালাল আসাদের প্রস্তাব হইতে আমরা এই সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার পথ পরিষ্কার করিতেছি। আমরা প্রাচীন ধর্ম হইতে আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্ব সর্বত্র দেখি একই কবিতা—আত্মহত্যা, অমীমাংসিত আত্মহত্যা। ইহা কি অধিকার, না কর্তব্য? এই প্রশ্নের মীমাংসা হয় নাই।


হজরত এব্রাহিমের বংশধর তিন ধর্মের প্রত্যেকটিতেই বলা হইয়াছে আত্মহত্যা পাপ বটে। মানুষকে জীবন দেওয়া হইয়াছে তাহা যাপন করিবার জন্য। জীবন যিনি দিয়াছেন লইবার সর্বস্বত্বও তিনিই সংরক্ষণ করিতেছেন। নিজ জীবনের উপর মনুষ্য-সন্তানের সার্বভৌমত্ব কোনো ধর্মই স্বীকার করিবে না। কিন্তু ঘোর অন্যায়ের প্রতিদানে মনুষ্যের জীবন লইবার হক সৃষ্টিকর্তার আছে। সেই সুবাদে তাঁহার প্রতিনিধিস্বরূপ ধর্মমণ্ডলি বা আধুনিক রাষ্ট্রও জীবন লইবার বা লঘু-গুরু শাস্তি দান করিবার হক রাখে। বর্তমান যুগের ভাষায় বলা যায় নাগরিকের জীবনের উপর রাষ্ট্রের হক আছে। দুঃখের মধ্যে, শুদ্ধ নাগরিকেরই হক নাই—থাকিতে পারে না।

সেই কারণেই হয়তো বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোনো অবস্থায় যেন আত্মহত্যা না করিতে পারে তাহার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। যুদ্ধরত সৈনিকেরও আত্মহত্যার অধিকার নাই, কালব্যাধিগ্রস্ত মরণপথযাত্রীরও নাই সেই অধিকারভোগের অধিকার। আত্মহত্যা করিবার চেষ্টা করিয়া বিফলমনোরথ ব্যক্তির শাস্তি হইবে এক বৎসর কারাদণ্ড—বাংলাদেশে কার্যকর দণ্ডবিধিতে এহেন তথ্য পাওয়া যাইবে।

১৮৩৮ সনে প্রকাশিত ভারতে ব্রিটিশ দণ্ডবিধির এক আদি খসড়ায় (ব্রিটিশ) ভারতীয় ‘আইন কমিশন’ প্রস্তাব করিয়াছিলেন আত্মহত্যার সহায়তা করিলে ক্ষেত্রবিশেষে (১২ বছরের নিচের ব্যক্তি প্রভৃতির ক্ষেত্রে) মৃত্যুদণ্ড ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ২ বছর হইতে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান করিতে হইবে। (ইন্ডিয়ান ল কমিশনার্স ২০০২: ধারা ৩০৬-৩০৭)

এক কথায় মৃত্যু অভিপ্রেত নহে, তবে কর্তৃপক্ষের আদেশে বা অনুমতিক্রমে কিংবা উৎসাহে মানুষের প্রাণ দেওয়া কর্তব্য।

ঐদিকে আদমবোমারু প্রভৃতি আত্মহত্যাকারী ধর্ম বা রাষ্ট্র যাহা অনুমোদন করে না সেই কাজ করিয়া নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া থাকে। হয়তো ইহাই তাহার আসল পাপ। কর্তৃত্বহীনের কর্তৃত্ব গ্রহণ মানিয়া লওয়া যায় না। একটুখানি আবেগ-নিরপেক্ষ হইয়া বিচার করিলেই ধরা পড়িবে সমস্যা প্রাণ বা মৃত্যু লইয়া যতটা নহে, তাহার অনেক বেশি সেই প্রাণদান বা মৃত্যুবরণের শর্ত বা পরিস্থিতি লইয়া। তাহা হইলে সেই শর্ত বা পরিস্থিতিই বা কেন আমাদের আলোচনার বিষয় হইবে না?

তালাল আসাদ এই নিয়মের অতিক্রম, ব্যতিক্রম বা ব্যভিচারও দেখাইয়াছেন এক জায়গায়। প্রাচীন গ্রিসের জগতে আত্মহত্যা পাপ বলিয়া গণ্য হইত না, আপন প্রাণ আপনি লওয়াকে এমনকি অপরাধও বলা চলিত না। পার্থক্যের মধ্যে, এই অধিকার সীমিত হইত শুদ্ধ উচ্চবাক বা এলিট শ্রেণীর ভিতর। দাসদিগকে আত্মহত্যার হক দেওয়া বুদ্ধির কাজ বিবেচিত হয় নাই।

পৃথিবীর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত আত্মহত্যার ঘটনা মহাত্মা সক্রাতেসের বিষপানে মৃত্যুবরণ। সকলেই ইহার কথা জানিবেন কিন্তু ইহাকে আত্মহত্যা বলিয়া মানিবেন কিনা সন্দেহ। বলিবেন ইহা তো বিচারে প্রদত্ত দণ্ড। ইহার অন্যথা কী হইতে পারিত? জল্লাদের হাতে মৃত্যু।

জার্মান মনীষী নিৎসে বলিয়াছেন সক্রাতেসের এই আত্মহত্যা গর্হিতকর্ম। কেন? শুদ্ধ আত্মহত্যা বলিয়া নয়। হত্যা বা আত্মহত্যায় নিৎসের আপত্তি নাই। তাঁহার আপত্তি অন্যত্র, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করিয়া হার মানায়। বাহিরের শক্তির কাছে বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী দেওয়ার পক্ষ তিনি লইবেনই না। এই নীতি উচ্চবাক বা এলিট নীতি হইতে পারে না। একই যুক্তিতে নিৎসে আলায়হেস সালাম হজরত ইসার বেহাত আত্মহত্যাও অনুমোদন করিবেন না। আত্মসমর্পণই নিৎসের মতে দোষের কাজ, আত্মহত্যা কিংবা মৃত্যু নহে।

অথচ হজরত ইসার ধর্ম যাঁহারা দুনিয়াজোড়া অনুসরণ করেন তাঁহারা এই ঘটনার অন্য ব্যাখ্যা দিতেছেন। তাঁহাদের বিশ্বাস পবিত্র। কারণ হজরত ইসা আর দশজনের মতন মানুষ নহেন। তিনি মাবুদের একমাত্র ঔরসজাত পুত্র অর্থাৎ পবিত্র। অথচ প্রকাশ্য নির্যাতনেই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। সাধারণ মনুষ্য-সন্তানের মতন তাঁহারও রক্ত ঝরিয়াছে। আর দশ মানুষের রক্তের মতন তাঁহারও রক্ত লাল এবং বহমান ছিল।

হজরত ইসা আত্মহত্যা করিয়াছিলেন। যাহারা নাসারাধর্মের বেগানা তাহাদের নিকট ইহা বিশেষ নতুন কথা মনে হইতে পারে। কিন্তু নাসারামাত্রই জানেন অপ্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে হইলেও ইহা এক প্রকার আত্মহত্যাই ছিল। হজরত জানিতেন তাঁহাকে হত্যা করা হইবে। তিনি তাহা বন্ধ করিবার বা তাহা হইতে পলাইবার চেষ্টা করেন নাই। শুদ্ধ তাহাই নহে। হত্যাকারীদের তিনি সহায়তাও করিয়াছেন। সেই অর্থেই ইহাকে পরোক্ষ বা বেহাত আত্মহত্যা বলা সঙ্গত। নিৎসে ইহারও নিন্দা করেন একই কারণে।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিতেছে: হজরত ইসা কেন আত্মহত্যায় লিপ্ত হইলেন? নিজেকে অকুতোভয় প্রমাণ করিবার জন্য? তাঁহার মতন মহাত্মা ব্যক্তির জন্য ইহা বাহ্যবস্তু মাত্র। প্রয়োজন ছিল না। নাসারা ধর্মতত্ত্ব অনুসারে মহাত্মা ইসার মৃত্যু মোটেও মৃত্যু নহে, স্বর্গলোকে মানে পিত্রালয়ে প্রত্যাবর্তনস্বরূপ। কিন্তু তাঁহারাও অস্বীকার করেন না তিনি মরিয়াছেন মানুষরূপেই—মানুষের হইয়া। মানবজাতির মুক্তির সোপানস্বরূপ তাঁহার মৃত্যুকে দেখাইয়া থাকেন নাসারা পুরাণলেখকগণ।

তাহা হইলে আমরা দেখিতেছি নাসারা পরম্পরায় মৃত্যুর অর্থ দুই। মানুষ পাপ করিয়াছে তাই মৃত্যু তাহার প্রাপ্যদণ্ড। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ইহাই প্রথম অর্থ। মৃত্যু পাপেরই ফল।

মৃত্যুর দ্বিতীয় অর্থ মহাত্মা ইসার মৃত্যুতে প্রাপ্তব্য। তাঁহার মৃত্যুতে আমরা আর সকলেই পাপ হইতে মুক্ত হইলাম। পাপে মৃত্যু নয়, মৃত্যুতেই পাপমুক্তি। মহাত্মা ইসা পবিত্র—শুদ্ধ এই ধারণার ভিত্তিতে আমরা আবিষ্কার করিতেছি তাঁহার মৃত্যু তাঁহার পাপের ফল নহে, অন্যের (অর্থাৎ মানবসমষ্টির) পাপের যুগপৎ ফল ও প্রায়শ্চিত্ত।

তালাল আসাদ দেখাইতেছেন বর্তমান যুগের ইহলৌকিক মানবতন্ত্রও (যাহাকে এয়ুরোপে নাসারাধর্মের উত্তরাধিকারী আদর্শ বলা যায়) এই স্ববিরোধ বুকে ধারণ করিয়া যাত্রা শুরু করিয়াছিল এবং এই দুই পায়েই খাড়া আছে। বিশেষ আদর্শ বা জীবনধারা টিকাইয়া রাখিতে হইলে নাগরিক-সৈনিককে প্রয়োজনে আপন জীবন উৎসর্গ করিতে হইবে—আধুনিক রাষ্ট্র এই দাবি ছাড়িলে দাঁড়াইবার জায়গাই পাইবে না। রাষ্ট্রের জন্য আত্মত্যাগ স্বরূপ মৃত্যু স্বাগত। ইহাকে স্বেচ্ছামৃত্যু বলা ছাড়া উপায় কী?

অথচ এয়ুরোপের যুক্তরাষ্ট্র (European Union) সহ অনেক আধুনিক রাষ্ট্র আজ দাবি করিতেছে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আইনসঙ্গত কাজ হইতে পারে না। কারণ কোনো মানুষের পক্ষেই হাজারকরা এক হাজার ভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় যাহাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইতেছে সত্যি সত্যি তাহা তাহার প্রাপ্য কিনা। মানুষের ভুলচুক হওয়া স্বাভাবিক। দ্বিতীয় কথা, যদি কখনো প্রমাণিত হয় যাহাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইয়াছে তাহা সঠিক হয় নাই, তখন মড়াকে আবার জিয়াইয়া তোলার কোনো পথই থাকে না।

যাহারা গোঁড়া নাসারা ধর্মাবলম্বী নহে, এমনকি কোনো ধর্মেরই তাঁবেদার নহে, যাহারা ইহলোকের বরপুত্র, মানবজাতির ঝাণ্ডাবহ, তাহারাও কবুল করিয়া থাকে নির্দয় মৃত্যুদণ্ডের তুলনায় মানুষকে অনুতাপ অনুশোচনার সুযোগ দেওয়াই বেহতর—মানুষ নীতিশিক্ষার মধ্যবর্তিতায় নিজ নিজ আত্মার শুদ্ধি ও শুচিসাধন করিতে পারে। এই বিশ্বাসের সহিত ধর্মধারাসূত্রে আগত মানবমুক্তির ধারণার আত্মীয়তা আবিষ্কার করিতে হইলে বেশি দূরকল্পনার আশ্রয়ও লইতে হয় না।

অসংখ্য সংস্কার-ব্যবসায়ী বলিয়াছেন মহাত্মা ইসার যন্ত্রণার সহিত একালের কোনো পাপী-তাপীর অনুতাপ তুলনীয় নহে বটে। কিন্তু কেহ যদি সত্য সত্য অনুতাপ করিয়া উৎকণ্ঠায় ভোগে তবে তাহা হইতে ধরিয়া লওয়া যায় সত্যি অনুশোচনা হইয়া গিয়াছে—উৎকণ্ঠাতেই শোচনা, উৎকণ্ঠাই শোচনা নহে।

মহাত্মা ইসার ক্রুশবিদ্ধ মৃত্যু স্বর্গেই পরিকল্পিত। তাহাতে মানবজাতির পাপের কারণে একজন নিরপরাধ, মাসুম মনুষ্যের মৃত্যুর ব্যবস্থা হইয়াছিল। এই নিষ্ঠুর মৃত্যুর বিনিময়ে মানবজাতি এমন এক ভয়াবহ উপহার পাইয়াছে যাহা ভাবিলেও শিহরণে হাত পা অবশ হয়। এই উপহার বা পুরস্কারের নাম অনন্ত জীবন। এই চরম পুরস্কারের পরম মূল্য সত্যি বড় নিষ্ঠুর, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত এই শয়তানসুলভ হত্যাকাণ্ড।

মানবজাতিকে যে পরম মূল্য গুণিয়া দিতে হইল তাহা খোদ শয়তানকেও লজ্জা দিতেছে। মহাত্মা ইসার সহিত তাঁহার শিষ্য এয়াহুদা (Jahuda) সরাসরি বেইমানি করিলেন আর তিনি নিজেই তাহা সহযোগ করিলেন। পবিত্র ধর্মপুস্তকের নতুন নিয়মে তাহার বিবরণ পরিষ্কার। ‘যোহন লিখিত সুসমাচার’ বলিতেছেন:

এই কথা বলিয়া যীশু আত্মাতে উদ্বিগ্ন হইলেন, আর সাক্ষ্য দিয়া কহিলেন, সত্য, সত্য, আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, তোমাদের মধ্যে এক জন আমাকে সমর্পণ করিবে। শিষ্যেরা এক জন অন্যের দিকে চাহিতে লাগিলেন, স্থির করিতে পারিলেন না, তিনি কাহার বিষয় বলিলেন। তখন যীশুর শিষ্যদের এক জন, যাঁহাকে যীশু প্রেম করিতেন, তিনি তাঁহার কোলে হেলান দিয়া বসিয়াছিলেন। তখন শিমোন পিতর তাঁহাকে ইঙ্গিত করিলেন ও কহিলেন, বল, উনি যাহার বিষয় বলিতেছেন, সে কে? তাহাতে তিনি সেইরূপ বসিয়া থাকাতে যীশুর বক্ষঃস্থলের দিকে পশ্চাতে হেলিয়া বলিলেন, প্রভু, সে কে? যীশু উত্তর করিলেন, যাহার জন্য আমি রুটীখণ্ড ডুবাইব ও যাহাকে দিব, সেই। পরে তিনি রুটীখণ্ড ডুবাইয়া লইয়া ইষ্করিয়োতীয় শিমোনের পুত্র যিহূদাকে দিলেন। আর সেই রুটীখণ্ডের পরেই শয়তান তাহার মধ্যে প্রবেশ করিল। তখন যীশু তাহাকে কহিলেন, যাহা করিতেছ, শীঘ্র কর। কিন্তু তিনি কি ভাবে তাহাকে এ কথা কহিলেন, যাঁহারা ভোজনে বসিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ তাহা বুঝিলেন না; যিহূদার কাছে টাকার থলী থাকাতে কেহ কেহ মনে করিলেন, যীশু তাহাকে বলিলেন, পর্ব্বের নিমিত্ত যাহা যাহা আবশ্যক কিনিয়া আন, কিম্বা সে যেন দরিদ্রদিগকে কিছু দেয়। রুটীখণ্ড গ্রহণ করিয়া সে তৎক্ষণাৎ বাহিরে গেল; তখন রাত্রিকাল। (পবিত্র বাইবেল, ‘যোহন লিখিত সুসমাচার,’ ১৩: ২১-৩০)

এই বর্ণনায় যাহা চোখে পড়িবার মতন কথা তাহা এই: ‘আর সেই রুটীখণ্ডের পরেই শয়তান তাহার মধ্যে প্রবেশ করিল।’ এই মহান নাটকের অপরার্থ এই যে চরম দুষ্ট ও পরম অনিষ্ট এক হইয়াই মাত্র মানবজাতির হিতের ইষ্ট পথ খুলিতে পারিল।

মহাত্মা ইসাকে যে অতুলনীয় পীড়া দিয়া হত্যা করা হইল, নিষ্ঠুরতা শুদ্ধ তাহাই নহে। তাঁহার এই বেদনাদায়ক, উৎপীড়িত মৃত্যুতে যাহারা নির্বিকার থাকিতে পারে তাহাদের নির্বিকারত্ব-পাপে আরো নিষ্ঠুরতা বর্তমান। ক্রুশের কাঠে পেরেকে পিষিয়া মারায় যত নহে তাহার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতা দেখিতেছি মনুষ্য জাতির নিষ্পৃহতায়। তাহাদের বেপরোয়া ভাবে।

মহাত্মা ইসা প্রাণ দিয়াছিলেন শুদ্ধ এয়াহুদি জাতিগোষ্ঠীর নিমিত্ত নহে, গোটা মানবজাতির জন্য। ইহাই ইসার সর্বজনীন ভাব। একই সঙ্গে ‘মানব’ পদবাচ্য সকলের জন্য এই প্রাণোপহার দিয়া তিনি ইহাও প্রমাণ করিলেন শুদ্ধ আত্মহত্যাকারী প্রাণদানের মধ্যেই মানবজাতির মুক্তি—তাহার ইষ্টলাভ—সম্ভব। এই প্রাণদান একাধারে নিষ্ঠুরতার, অন্যাধারে নির্বিকার উদাসীনতার চিহ্নও বহন করিতেছে। প্রাণে ধিক্কার জাগায় এমন প্রাণদানই প্রাণ দানের পূর্বশর্ত।

আধুনিক যুগের মানব-ব্যবসায়ী (humanist) সংস্কার অনুসারে সেই পুরাতন ধর্মীয় উন্মাদনা হইতে একালের মানবজাতি স্বাধীন হইয়াছে। কিন্তু তালাল আসাদ দেখাইতেছেন, এই দাবিও গুজব বৈ নহে। দয়ার্দ্র প্রাণের সলিলে চরম নিষ্ঠুরতার ‘রুটীখণ্ড’ আজও কম ডোবানো হইতেছে না। মনুষ্য-সন্তানকে পশুর মতন হত্যা করাকে একই সঙ্গে বলা হইতেছে জঘন্যতম শয়তানি এবং পরম মঙ্গল।

উদাহরণ হিসাবে আধুনিক রাষ্ট্রমণ্ডলির শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা পাড়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের দেশনায়কগণ এই জাতীয় কথা হরহামেশা বলিতেছেন, হজরত ইসার আত্মত্যাগের সহিত মার্কিন সেনাবাহিনীর হত ও আহতদের তুলনা নিতুই পাঠ করিতেছেন। যথা:

মানবজাতি যাহাতে করিয়া স্বর্গরাজ্য পাইতে পারে তাহার নিমিত্ত যিশুখ্রিস্ট আপন প্রাণ ক্রুশকাঠে উৎসর্গ করিয়াছিলেন। আর অদ্য রাত্রিবেলা আমরা পরম পবিত্রতার সহিত ঘোষণা করিব মানবজাতির মুক্তি অর্জনের জন্য, বিশ্ব জুড়িয়া মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করিবার খাতিরে পৃথিবীর যে কোনো জাতি পরম আত্মত্যাগ স্বীকারের যে চূড়ান্ত করিয়াছে আমরাও তাহাই করিতেছি। (গেম্বল: ২০০৩; দেখুন, আসাদ ২০০৭: ৮৭)

জাতির স্বার্থে আত্মোৎসর্গের গল্প একেবারে নতুন নহে। আত্মোৎসর্গের শেষ সর্গে মানবজাতি এখনো পৌঁছে নাই। সভ্যতা বিস্তারের (civilizing mission) বর্তমান পর্বে শুদ্ধ ‘মুক্তি ও স্বাধীনতা’র নাম চলিতেছে। কোথাও কোথাও ইহা নাম ধারণ করিয়াছে ‘গণতন্ত্র’। পার্থক্যের মধ্যে ইহাই।


তালাল আসাদের অনিবার্য প্রস্তাব অনুসারে নাসারাধর্মের এই ঐতিহ্য, এই উত্তরাধিকার আধুনিক মানব-ব্যবসায়ী রাষ্ট্রও পুরাপুরি গ্রহণ করিয়াছে।

আত্মোৎসর্গ, রক্তপাত এবং প্রাণদণ্ড—এইসব বস্তু একালের দুনিয়াদারি করা স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীগণ মোটেও পছন্দ করেন না। এইগুলি, তাঁহারা মনে করেন, স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের আগের যুগের নাসারাধর্মের বৈশিষ্ট্য মাত্র। অথচ দেখা যাইতেছে গর্হিত, পরিত্যাজ্য এই সমস্ত বস্তু অধুনাতম স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীগণের জননপর্বেই পূর্ণমাত্রায় জড়াইয়া আছে। মাত্র ন্যায়যুদ্ধের কথা হইতেছে না, সর্বত্রই দেখা যায় পরম রক্তারক্তির সহিত গা জড়াইয়া আছে চরম কোমলতা।

প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের কবি বলিয়া যেসব কবি সুবিদিত সেই কবিদের কবিতায়ও চরম স্নেহের প্রকাশ সম্ভব হইয়াছে কেবল তখনই যখন কোমল মনের সহিত ‘দরকার হয় হত্যা করিব’ ধরনের কঠোরতা যোগ হইয়াছে। ইঁহাদের মধ্যে আছেন রুপার্ট ব্রুক (Rupert Brooke), সিগফ্রিড সাসুন (Sigfried Sassoon), উইলফ্রেড ওয়েন (Wilfred Owen), রবার্ট গ্রেবস (Robert Graves) প্রমুখ। একালের বহুল পরিচিত রাষ্ট্রীয় প্রচারের—যে কোন মূল্যে দেশরক্ষার—প্রাঞ্জল অর্থ আর কিছু নয়: আত্মোৎসর্গ, রক্তপাত ও প্রাণদণ্ড।

দুঃখের মধ্যে নাসারাধর্মের মধ্যযুগ হইতে স্বাধীনতা-ধর্মের অনন্তযুগ পর্যন্ত একই স্ববিরোধ অমীমাংসেয় অবস্থায় পড়িয়া আছে। মীমাংসার কোনো সংকেত এখনো পর্যন্ত দেখা যাইতেছে না। স্ববিরোধের এক মাত্রায় জীবনের প্রতি মমতা দেখানো কর্তব্য, অন্য মাত্রায় যে কোনো মূল্যে (মানে হত্যা ও আত্মহত্যাসমেত) এই জীবন বিয়োগ করাও কর্তব্য। দুই কর্তব্যের দোলাচলে আধুনিক স্বাধীনতার-ব্যবসায় আজও আগাইয়া চলিয়াছে। ইহার প্রকাশ স্বভাবতই নানাবিধ হইয়াছে।


মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচাকেনার সাদা ও কালো বাজারের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন তালাল আসাদ। জীবন কখন শেষ হইল আর কখন হইল না, তাহাও কিন্তু জীবন-ধারণকারীর সিদ্ধান্ত নহে। আইনের অর্থাৎ রাষ্ট্রের এখতিয়ার আছে তাহা নির্ধারণ করার। চক্ষু, কিডনি প্রভৃতি অঙ্গ যাঁহারা দান করেন তাঁহারা কেহ কেহ জীবিতাবস্থায়ও তাহা করিয়া থাকেন। আবার এইসব জিনিস মরণোত্তর দান করিবার পথ একটা আছে। এইসব দান গ্রহণ করিবার মত যত সংস্থা রহিয়াছে তাহারা সকলেই ‘জীবনদান’ কথাটি ব্যবহার করিয়া থাকে। ইহাতে—বিশেষ পশ্চিম জগতের নাসারা ধর্মধারার প্রভাবাধীন সমাজে—হজরত ইসার ‘জীবনদান’ স্মরণপথে উদিত না হইয়া পারে কি? ইহার সহিত জীবিত মনুষ্যের অঙ্গদানের কী সম্বন্ধ? টাকা নামক বাহ্যবস্তুরই বা কী যোগাযোগ ইহার সঙ্গে? সেই প্রশ্ন না তুলিয়াই তাঁহারা আগাইয়া যাইতেছেন বীরদর্পে।

তালাল আসাদ আগের দুই বক্তৃতায় বলিয়াছিলেন এয়াহুদি-নাসারা সভ্যতার সহিত এসলামি সভ্যতার দ্বন্দ্ব বলিয়া যাঁহারা বর্তমান বিশ্বের প্রধান দ্বন্দ্বের পরিচয় জাহির করিতেছেন তাঁহারা ভুল করিতেছেন। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন: আসল দ্বন্দ্ব সেখানে নহে, দ্বন্দ্ব খোদ এসলামেরই অন্দরমহলে। সেখানে দুই ধরনের মুসলমান আছে। এক দল আধুনিক ও স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী, আর দল উন্মাদ। স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী দলের সহিত উন্মাদনার বেপারি দলের সংঘাতই বর্তমান দুনিয়ার প্রকৃত সংঘাত।

talal-a-5.jpg
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি বক্তৃতায় তালাল আসাদ

আসাদ কিন্তু এই রোগ নির্ণয়ের সহিতও ঐকমত্য পোষণ করিতেছেন না। তিনি মনে করেন বর্তমান যুগের নেতৃত্বে রহিয়াছে পশ্চিম জগৎ। তাঁহারাও অন্তর্দ্বন্দ্বমুক্ত নহেন। পরম মমতার সহিত চরম নিষ্ঠুরতার একটা বিবাদ তাঁহাদের মধ্যেও আছে। সেই বিবাদের রসায়নে স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীর মন যখন দিশাহারা হয় তখন তাহার নাম দাঁড়ায় শিহরণ। এই দ্বন্দ্বের মালিকানা, এই শিহরণ প্রজননের শক্তি তালাল আসাদের মতে একান্তই পশ্চিম জাগতিক। ইহা আদৌ এজমালি নহে। চিনদেশে যুবকের দেহ শতখণ্ডে কাটিবার যে গল্প ফরাসি মনীষী জর্জ বাতায়ি (Georges Bataille) শোনাইয়াছেন তাহার সহিত এই শিহরণের যোগাযোগ সামান্য।

শিহরণ কথাটার অর্থ একেক জনের কাছে একেক রকম। তবে পশ্চিম জগতের মনীষীবৃন্দের পথ ধরিয়া আসাদ তাহার কুলজি নির্ণয় করিয়াছেন অনেকটা এইভাবে—অনেক দর্শক-শ্রোতার চোখ কানে তালা লাগে, তাহারা দেখে হঠাৎ কাণ্ড, নিমেষেই জীবন পরিণত হয় মৃত্যুতে, পরিচিত মানুষ হইয়া যায় অপরিচিত দ্রব্য, রক্ত ও মাংসের সমষ্টি।

ইহাতে যে অনুভূতি হয় তাহা কোনো কোনো মনীষীর মতে একাধারে বেদনার, দুঃসহ বেদনার, ও চরম আনন্দের। আনন্দ বা হর্ষটা ক্ষণস্থায়ী হইলেও আছে। লোমহর্ষক কথাটার মধ্যে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট। কাজে কাজেই এক ধরনের অসহায় শিহরণ হয়। ইহার উৎস অজানা হইলেও গতি স্পষ্টই সামনের দিকে। এই ঘাতক বলপ্রযোজকের বিরুদ্ধে প্রাণ-মন-দেহ একযোগে ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ পোষণ করিবে ইহাই স্বভাবধর্ম-সঙ্গত।

কিন্তু ঘাতক তো সঙ্গে সঙ্গে নিজের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বা পরমপ্রাপ্য মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করিল। তাহাতে তো ক্রোধের উপশম হইবার কথা। কিন্তু হয় না তো!

ইচ্ছা হয় অপরাধ ও শাস্তি যেন আলাদা থাকে। ঘাতক আদমবোমারু সেই ইচ্ছাপূরণের পথও বন্ধ করিয়া যায়। ধর্ম ও রাষ্ট্রের ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুদণ্ড বিধানের হকও সে লঙ্ঘন করিয়া চলিয়া যাইবার পথ পায়। ইহাতে রাষ্ট্রের প্রতিশোধ গ্রহণের যে শক্তি তাহাকেও একই ক্রিয়ার মধ্যবর্তিতায় অবশ বা পরাস্ত করা হইল বৈ কি!

একালের প্রতিশোধগ্রহণ ক্রিয়াটি প্রতিশোধ (revenge) শব্দে পরিচয় পায় নাই। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের মুখ হইতে আমরা শুনিতে শুরু করিয়াছিলাম নতুন শব্দ ‘প্রতিদান’ (retribution)। অপরাধ যদি হয় মৃত্যু ঘটানোর ক্রিয়ায় তবে শাস্তি হইবে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মধ্যবর্তিতায়। ইহাই শাস্ত্রসম্মত। দুইটাই প্রাকৃতিক ঘটনাস্বরূপ এক, কিন্তু সামাজিক ঘটনাস্বরূপ অন্য অন্য। হত্যা করা পশুসুলভ অপরাধ, অন্যায় আর মৃত্যুদণ্ড প্রদান ন্যায়সঙ্গত ও মনুষ্যসুলভ শাস্তি মাত্র।

ফরাসি এমিল দুর্খাইম বলিতেন শাস্তি মাত্রই প্রতিশোধের আবেগ হইতে জন্ম লইয়াছে, জনচিত্তে যে ক্রোধ জাগে তাহার নিরসন করিবার জন্যই সকল শাস্তি উপশমস্বরূপ দান করিবার কথা। যখন অপরাধ ও শাস্তির ক্রম নষ্ট হইবার উপক্রম ঘটে তখন প্রতিশোধ কথাটার কোনো অর্থই থাকে না।

আদমবোমারুর অন্যতর অপরাধ এইখানেই। প্রাণের বদলে প্রাণ, নাকের বদলে নাকের যে গণতান্ত্রিক নীতি সে তাহাই অকার্যকর করিয়া তোলে। এমনকি প্রাণের বদলে ক্ষমা করিবার যে সন্তুষ্টি তাহার সুযোগও থাকে না আদমবোমার ঘটনায়। ইহাও কি শিহরণের অন্যতম শিকড়?


তাহা হইলে কী দাঁড়াইল? তালাল আসাদ কয়েকটি কারণ এক জায়গায় করিয়া দেখাইয়াছেন আদমবোমার অভিজ্ঞতা আধুনিক ইহলৌকিক স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী পশ্চিম জগতকে একাধিক জায়গায় হতাহত করিয়াছে। প্রথম জায়গায় অর্থাৎ রাষ্ট্রের এখতিয়ার বা আইনসঙ্গত ক্ষমতায় সে হাত দিয়াছে। তাই আদমবোমার শিহরণ হইয়াছে অনন্য। সমরক্ষেত্রে প্রাণদান বা প্রাণগ্রহণ লইয়া কোনো শিহরণ নাই—থাকিলে বড়জোর বেদনা আছে। কারণ এই দান ও গ্রহণ উভয় ক্রিয়াই বৈধ। বিধিসম্মতি বা ধর্মসঙ্গতি (legitimacy) এখানে একই কথার এপিঠ ওপিঠ বৈ নহে।

যতই বেদনাদায়ক, যতই ভয়ানক হউক যুদ্ধে মৃত্যুবরণই সঙ্গত, সুতরাং তাহা শিহরণমুক্ত। যুদ্ধ বৈধ কেন? বৈধ কারণ মানবের মাঝে আমাদের জীবনধারা,আমাদের ধর্মবিশ্বাস, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা বাঁচাইতে হইলে মরিতে হইবে সুন্দর ভুবনে। জাতি ও রাষ্ট্রের বিধানের বাহিরে প্রাণ দেওয়া বা নেওয়া কোনোটাই প্রার্থনীয় বা সমর্থনীয় হইতে পারে না। গোড়ার কথা এই।

দুই নম্বর কথা, আদমবোমারু অপরাধ করিবার পর শাস্তি দেওয়ার কোনো জায়গাও রাখে না। এই জায়গায় সে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিশোধ কিংবা প্রতিদান লইবার ক্ষমতাই জব্দ করিয়া বসে। ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের মধ্যে ব্যবধান রহিত করিয়া দেওয়াও আরেক দফা অপরাধ। অথচ এই ব্যবধান বজায় রাখার উপরই প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে আধুনিক স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের সকল পরিচয়কাণ্ড।

তিন নম্বর জায়গাটিও আমরা প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় আনিয়াছি। সকল মানুষই মরণশীল কিন্তু মানবজাতির জীবনকে আমরা অনন্ত বলিয়াই মানি। জানি আর না-ই জানি, অন্তত বিশ্বাস করি। মরজীবন ও অনন্ত জীবনের মধ্যে সমর একটা আছে। তাহাই রাষ্ট্রের মধ্যে মূর্ত হইতে চাহে। রাষ্ট্র অমর বলিয়া দাবি করিতে না পারিলে মরের জীবন দাবি কী করিয়া করিতে পারিত? তাই আমরা একদিকে সমস্ত জীবনই পবিত্র ও অবধ্য বলিয়া দাবি করি, আবার পরক্ষণেই জীবন দিবার আহ্বান জানাই। জানাই কী করিয়া? আইনের কোনো শর্ত লঙ্ঘন না করিয়া, কোনো অঙ্গকে টুস্কিটি পর্যন্ত না মারিয়া কী করিয়া জানাই? রাষ্ট্র অমর না হইলে আমরা কী করিয়া একই মুখে দুই কথা বলিতাম? ব্যক্তি স্বাধীন এবং সকলে আইনের অধীন এই দুই কথাই যুগপৎ সত্য। ইহা বলিতে কোনো কপটতা নাই—কিন্তু দুই কথা একই সঙ্গে সত্য হয় কী করিয়া?

talal-a-6.jpgস্বীকার করিতে দোষ নাই: এই বিবাদসমষ্টি বর্তমান আছে। শুদ্ধ আছে বলিলেই হইবে না। এই সকল বিবাদ লইয়াই স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিয়াছে। এই রাষ্ট্র ও সমাজের সার্বভৌম ক্ষমতা বা রাজশক্তি যে সত্য ধারণ করে তাহার গোড়ায় আঘাত করিতেছে আদমবোমা। তাহার আঘাতে রাষ্ট্রের অস্থি-মজ্জা-কশেরুকা উড়িয়া যাইতেছে। আদমবোমায় যে জীবনদান ও গ্রহণের নাট্য চলে তাহার অর্থও অমীমাংসেয় হইয়া দাঁড়াইতেছে। এই ঘটনার প্রকাশ্য অনুষ্ঠান ও সমবায়-মৃত্যু ক্ষমার অযোগ্য প্রতিভাত হইতেছে। বৈধতা ও অবৈধতা, অপরাধ ও শাস্তি, জীবন ও রাষ্ট্রের ভেদরেখাটুকু মুছিয়া যাইতেছে। মুক্তির সম্ভাবনাও তিরোহিত হইতেছে।

পরিশেষে, তালাল আসাদ দেখাইতে চাহেন, আরো একপ্রস্ত পরিণামদারুণ ঘটনা ঘটে। ইহা বিশেষ করিয়া এয়াহুদি-নাসারা পরম্পরা হইতে আগত মানবগোষ্ঠীর জন্য দুর্বহ ভারস্বরূপ। হজরত ইসার প্রাণদানকে অনন্ত জীবনের মূল্য বলিয়া মানিয়া লইবার একটা যুক্তি আছে। অনন্ত মৃত্যুর মূল্য বলিয়া কোনো প্রাণদান মানিয়া লইবার তো কোনো সান্ত্বনা নাই—হোক না তাহা আদমবোমারুর প্রাণ।

আদমবোমাবাজকে আপনি যদি মানবেতর পশু বা ঐ রকম অশ্লীল কোনো গালিগালাজ দিয়া শান্তি পাইতে আগ্রহীও হইলেন হয়েন গিয়া। সে যাহাদিগকে মারিল তাহাদের মনুষ্যত্বের কী হইবে? তাহারা কেন মরিল? মানবজাতির পাপের জন্য? তাহা হইলে আমাদের প্রভু যিশুখ্রিস্টের নতুন নিয়ম কি বৃথা যাইবে? তিনি কি আমাদের সকলের পাপের জন্য প্রাণদান করেন নাই?

এয়াহুদি জাতিভুক্ত এয়ুরোপীয় মনীষী ফ্রানৎস কাফকা বলিয়াছেন জীবনের অর্থ স্রেফ মৃত্যু, মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই নহে। এই সত্য এয়াহুদি-নাসারাদি হজরত এব্রাহিমের ধর্মে কল্পনাও করা যায় কি? নিরপরাধের মৃত্যুর মধ্যবর্তিতায় আমরা সকল মৃতকে আবার প্রেমের বন্ধনে বাঁধিতে পারিব। এই বিশ্বাস যদি বজায় রাখিতে হয় তো কবুল করিতে হইবে, আত্মহত্যাকারী আদমবোমারুটিও সেই প্রেম পাইবার অধিকারী। তাহা কি সম্ভব?

ইহাও যদি সম্ভব হয় তো বলিতে হয় কী ঘাতক,কী শিকার, কী নিছক পথচারী সকলেই বোধ করি অপরাধী। সকলেই বোধ করি একই প্রতিকারহীন অপরাধ করিয়াছে।

তালাল আসাদ, সবশেষে, সিদ্ধান্ত করিয়াছেন আদমবোমার আসল ঘটনা কী মরায়, কী মারায়, কী মরিয়া মারায়—কোনোটাতেই পাইবেন না। দুনিয়াবি আধুনিক স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীরা যাহা প্রাণপণে লুকাইতে চাহেন আদমবোমাবাজ তাহাই প্রকাশ করিয়া দেয়। শিহরণের ইহাই বোধ করি সবচেয়ে নিগূঢ় কারণ।

আদমবোমারুর অভিযান মনে হয় অনন্ত স্বাধীন। প্রতিষ্ঠান হইতে স্বাধীন থাকিয়া কোনো মানুষই নিজের অন্তস্তলের বিকাশ ঘটাইতে পারে না। আদমবোমারু সেই অসম্ভবের পায়েই আত্মনিবেদন করে। আধুনিক পৃথিবীর স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের এই গোপন বিবাদ ক্ষণকালের জন্য বে-আবরু করিয়া মরিয়া যায় আদমবোমারু। তাহার এই অন্তহীন স্বাধীনতার অলীক আবদার প্রকৃত প্রস্তাবে একালের স্বাধীনতা-ব্যবসায়েরই অকথিত বিলাস। সেই অর্থে কি বলা যায় না আদমবোমাবাজিও বর্তমান পৃথিবীর মাপে এক প্রকার স্বাধীনতা-ব্যবসায়?

এই প্রশ্নেই শেষ হইয়াছে তালাল আসাদের শেষ বক্তৃতা। আমাদের মামলা ন্যায়যোদ্ধা বনাম দুষ্ট সন্ত্রাসীর মামলা নহে। তিনি প্রস্তাব করিতেছেন, ‘স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী’ বনাম ‘স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী’র মামলা হইলেই তাহা ভালো হইত।


তালাল আসাদের পরামর্শ কতখানি যুক্তিগ্রাহ্য তাহা বিচার করিতে আরেকটি মামলা আমাদের খানিক সহায় হইবে। পাঠিকা নিজেই বলিবেন। এই ঘটনার নায়ককে কি আমরা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী ন্যায়যোদ্ধা’ বলিব নাকি বলিব ‘জঘন্য বোমাবাজ সন্ত্রাসবাদী’?

ঘটনার সূত্রপাত পুরানা ফিলিস্তিন রাজ্যে। এসরায়েলের সন্তানগণ সদাপ্রভুর দৃষ্টিতে যাহা মন্দ তাহা আরো একবার করিলে সদাপ্রভু চল্লিশ বৎসর তাহাদিগকে ফিলিস্তিনি জাতির হাতে সমর্পণ করিলেন। সেই সময়ের কথা। তৎকালে দানীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সরানিবাসী মানোহ নামে এক ব্যক্তি ছিলেন, তাঁহার স্ত্রী বন্ধ্যা হওয়াতে অনেক দিন তাঁহাদের কোনো সন্তান হয় নাই। পরে তাঁহাদের এক সন্তান হইলে তাঁহার নাম শিমশোন (ইঙ্গভাষায় স্যামসন) রাখা হয়।

শিমশোন সদাপ্রভুর দয়ায় জন্মিয়াছেন বলিয়া তাঁহার শক্তি অমিত হয়। তিনি ফিলিস্তিনিদের অনেক অনিষ্ট করেন। তাঁহার সর্বশেষ ফিলিস্তিনি প্রণয়িনীর নাম ছিল দলীলা। একদিন তিনি দলীলার অনুনয়ে হার মানিয়া তাহার কাছে নিজের অমিত শক্তির গোপন কথা প্রকাশ করিলেন। কহিলেন, ‘আমার মস্তকে কখনও ক্ষুর ওঠে নাই, কেননা মাতার [গর্ভ] হইতে আমি ঈশ্বরের উদ্দেশে নাসরীয় (উৎসর্গিত); ক্ষৌরি হইলে আমার বল আমাকে ছাড়িয়া যাইবে, এবং আমি দুর্বল হইয়া অন্য সকল লোকের সমান হইব।’

গোপন তত্ত্ব ফাঁস হইবার ফলস্বরূপ শিমশোন একদিন ধরা পড়িলেন। ফিলিস্তিনিরা তাঁহাকে ধরিয়া তাঁহার দুই চক্ষু উৎপাটন করিল, বন্দি অবস্থায় তাঁহার মাথায় চুল আবার গজাইল কিন্তু ইহার অর্থ ফিলিস্তিনিরা ধরিতে পারে নাই। একদিন তাহারা অন্ধ শিমশোনকে মজা করিবার জন্য তাহাদের মহাযজ্ঞানুষ্ঠানে লইয়া আসিল। তাঁহাকে কৌতুক করিতে ডাকিল। ধর্মপুস্তক লিখিতেছেন:
…তাহারা স্তম্ভ সকলের মধ্যে তাঁহাকে দাঁড় করাইয়াছিল। পরে যে বালক হস্ত দিয়া শিম্শোনকে ধরিয়াছিল, তিনি তাহাকে কহিলেন, আমাকে ছাড়িয়া দেও, যে দুই স্তম্ভের উপরে গৃহের ভার আছে, তাহা আমাকে স্পর্শ করিতে দেও; আমি উহাতে হেলান দিয়া দাঁড়াইব। পুরুষে ও স্ত্রীলোকে সেই গৃহ পরিপূর্ণ ছিল, আর পলেষ্টীয়দের [ফিলিস্তিনিদের] সমস্ত ভূপাল সেখানে ছিলেন, এবং ছাদের উপরে স্ত্রী পুরুষ প্রায় তিন সহস্র লোক শিম্শোনের কৌতুক দেখিতেছিল। তখন শিম্শোন সদাপ্রভুকে ডাকিয়া কহিলেন, হে প্রভু সদাপ্রভু, অনুগ্রহ করিয়া আমাকে স্মরণ করুন; হে ঈশ্বর, অনুগ্রহ করিয়া কেবল এই একটী বার আমাকে বলবান করুন, যেন আমি পলেষ্টীয়দিগকে আমার দুই চক্ষুর নিমিত্ত একেবারেই প্রতিশোধ দিতে পারি। পরে শিম্শোন, মধ্যস্থিত যে দুই স্তম্ভের উপরে গৃহের ভার ছিল, তাহা ধরিয়া তাহার একটীর উপরে দক্ষিণ বাহু দ্বারা, অন্যটীর উপরে বাম বাহু দ্বারা নির্ভর করিলেন। আর পলেষ্টীয়দের সহিত আমার প্রাণ যাউক, ইহা বলিয়া শিম্শোন আপনার সমস্ত বলে নত হইয়া পড়িলেন; তাহাতে ঐ গৃহ ভূপালগণের ও যত লোক ভিতরে ছিল, সমস্ত লোকের উপরে পড়িল; এইরূপে তিনি জীবনকালে যত লোক বধ করিয়াছিলেন, মরণকালে তদপেক্ষা অধিক লোককে বধ করিলেন। (পবিত্র বাইবেল, ‘বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ,’ ১৬: ২৫-৩১; বাঁকা অক্ষর বর্তমান লেখকের)

কাকতালীয় মনে হইতেছে এই সংখ্যা—হতের সংখ্যা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে নব্য ইয়র্ক নগরীর বিশ্বব্যবসায় ভবনে নিহতের সংখ্যার কাছাকাছি। আসাদ কহিতেছেন হতাহতের সংখ্যাটাই আসল ঘটনা নহে, জীবিতরা এই ঘটনার কোন অর্থ করিতেছেন তাহাতেই পাওয়া যাইবে সত্য ঘটনা। শিমশোনের উদ্দেশ্য বা মতলব লইয়া ধর্মপুস্তক বেশি জায়গা খরচ করেন নাই। তাঁহারা লিখিয়াছেন শুদ্ধ এই কথা: ‘পরে, তাঁহার ভ্রাতৃগণ ও তাঁহার সমস্ত পিতৃকুল নামিয়া আসিয়া তাঁহাকে লইয়া সরা ও ইষ্টায়োলের মধ্য-স্থানে তাঁহার পিতা মানোহের কবরস্থানে তাঁহার কবর দিল। তিনি বিংশতি বৎসর ইস্রায়েলের বিচার করিয়াছিলেন।’ (পবিত্র বাইবেল, ‘বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ,’ ১৬: ৩১)

হাল জমানার এসরায়েল রাষ্ট্রে শিমশোনের গল্প বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। সেখানে তাঁহাকে বলা হয় ‘দুর্ধর্ষ এয়াহুদি’। শুদ্ধ তাহাই নহে, ব্রিটিশ দখলভুক্ত ফিলিস্তিনে বলপূর্বক এয়ুরোপীয় কায়দায় প্রতিষ্ঠিত আধুনিক রাষ্ট্রের নামও রাখা হইয়াছে এসরায়েল। ফিলিস্তিনে এয়াহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাহিনীকে এই দুনিয়ায় এয়াহুদি জাতির মুক্তিলাভের রূপকল্পস্বরূপ প্রচার করিবার জন্যও এই শিমশোন গল্পটি বয়ান করা হইয়া থাকে। ১৯২৭ সনে জিয়েব ইয়াবোতিনস্কি (Ziev Jabotinsky) নামে পরিচিত জনৈক জায়নপন্থী নেতা এক আধুনিক উপন্যাস লিখিয়া এই কাহিনীর সমকালীন রূপও প্রচার করিয়াছিলেন।

হজরত ইসার অনুসারীদের মধ্যেও এই গল্পটা নানাভাবে প্রচলিত আছে। কেহ কেহ ইহাকে নৈতিক আত্মশুদ্ধির গল্প হিসাবে পড়িতেছেন। শিমশোন খানিক ইন্দ্রিয়কাতর ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। ধর্মপুস্তকেই তাহার বিবরণ পাই। তিনি মা-বাবার কথা অগ্রাহ্য করিয়া ফিলিস্তিনি জাতির মধ্যে মনোহরা কন্যা দেখিতে পাইতেন। সেই দোষেই তাঁহার বন্দিত্ব, দাসত্ব ও অন্ধত্ব।

কিন্তু আধুনিক বিপ্লবী খ্রিস্টান, ১৭ শতকের ইংরেজ কবি মিল্টনও তাঁহার শেষ বয়সে অন্ধাবস্থায় নিজেকে শিমশোন ভাবিয়াছিলেন এবং রাজতন্ত্রী বদমায়েশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শিমশোনের মতন জয়ী হইবার আশা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। তিনি দেখিয়াছিলেন শিমশোনের কঠিন নৈতিক রূপ। বাংলাদেশের কবি মহাত্মা শামসুর রাহমানও এই রূপের অন্যথা দেখেন নাই। (রাহমান ২০০৯: ১০৫-০৭; দেখুন, সংবর্ধনা ৩) বিস্ময়ের কী আছে, এই নীতির পরাকাষ্ঠাকেই একালের এসরায়েল রাষ্ট্রের মুক্তির প্রতীক গণ্য করা হইতেছে।

কী বিচিত্র এই দুনিয়া! শিমশোনের আত্মদানের মধ্যবর্তিতায় এসরায়েল-সন্তানগণ ফিলিস্তিনিদের হাত হইতে মুক্ত হইয়াছিল। কিন্তু মুক্ত করিয়া তিনি তাহাদের আবার বন্দিও করিয়াছিলেন। ইহা জানিয়াও না জানিবার ভান করা ছাড়া এসরায়েল-সন্তানদের এখন অন্য উপায় কোথায়?

এই অসহায়তার কথা মধ্যে মধ্যে গোপনে প্রকাশিত হয়। যেমন এসরায়েল রাষ্ট্রের গোপন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের নাম রাখা হইয়াছে ‘শিমশোন কৌশল’ (The Samson Option)। হাতের তালুর সমান সামান্য ভূ-ভাগে এই পথ গ্রহণের অর্থ মানে অকল্পনীয়ের জয়ধ্বনি করা—দুশমনের সঙ্গে সঙ্গে ‘আমারও প্রাণ যাউক’ বলিয়া ওঠা।

দুঃখের মধ্যে, বর্তমান এসরায়েল রাষ্ট্রে এই কৌশল আমল করিবার লোকও কম নাই। কথা সেই লোকদের লইয়া নহে। আমাদের কালের স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীগণ যে বলেন: যে কোন মূল্যে আমাদের জীবনধারা বাঁচাইতে হইবে—শিমশোনের পথও কি সেই মূল্য তালিকারই অন্তর্গত নহে?

পাঠিকা বলিবেন, আমাদের সুন্দর স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীও কি এই হিসাব মাফিক এক ধরনের আদমবোমারু নহেন?

……………
আদমবোমা, ফেব্রুয়ারি ২০০৯

দোহাই
১. পবিত্র বাইবেল, নূতন নিয়ম, যোহন লিখিত সুসমাচার (বাঙ্গালোর: ভারতের বাইবেল সোসাইটি, সনতারিখ নাই)।
২. পবিত্র বাইবেল, পুরাতন নিয়ম, বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ (বাঙ্গালোর: ভারতের বাইবেল সোসাইটি, সনতারিখ নাই)।
৩. শামসুর রাহমান, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ৮ম মুদ্রণ (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ ২০০৯)।
৪. Eqbal Ahmad, The Selected Writings of Eqbal Ahmad, eds. C. Bengelsdorf et al. (New York: Columbia University Press, 2006/ka), pp. 298–317, 377–80.
৫. Talal Asad, On Suicide Bombing (New York: Columbia University Press, 2007).
৬. Richard Gamble, The War for Righteousness: Progressive Christianity, the Great War and the Rise of the Messianic Nation (Washiston, DC: ISI, 2003), p. 153.
৭. John Milton, Samson Agonistes, ed. F. T. Prince, 2nd imp. (Delhi: Oxford University Press, 1982).
৮. Jacqueline Rose; ‘Deadly Embrace,’ London Review of Books, vol. 26, no. 21 (4 November 2004).

দলিলপত্র
৯. The Indian Law Commissioners, A penal code prepared by the Indian Law Commissioners, and published by command of the Governor General of India in Council (London: Pelham Richardson, Cornhill, 1838), reprint (Union, NJ: Lawbook Exchange, 2002).

 

প্রথম প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০০৯, arts.bdnews24.com

‘আদমবোমা’ বইটি সংগ্রহ করতে অনলাইনে অর্ডার করুন: https://www.rokomari.com/book/2367/adomboma

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *