এই যুগের বাঙ্গালা ভাষায় গুরু ও শিষ্যের সম্বন্ধ লইয়া পড়িবার মতন বহি বিশেষ লেখা হয় না। ইহাই নিয়ম। মহাত্মা আহমদ ছফা বিরচিত যদ্যপি আমার গুরু এই নিয়মের অতিক্রম।
পত্রিকার পাতায় প্রথম প্রকাশের সময় ইহার শিরোনাম আরো চওড়া হইয়াছিল। নাম ছিল ‘যদ্যপি আমার গুরু প্রফেসর রাজ্জাক’। আহমদ ছফা শেষ পর্যন্ত কাটিয়া নাম ছোট করিয়াছেন বলিয়া ধন্যবাদ পাইতেছেন। যদিও এই বই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের এক জাতীয় শিষ্য আহমদ ছফা লিখিত তবু ইহা গুরু-শিষ্য বিসম্বাদের অধিক হয় নাই। ইহাতে যে গুরুচিত্র পাইতেছি তাহাতে বলিতে গুরুতর লাভই হইয়াছে।
অধ্যাপক রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বনিয়াছিলেন ১৯৩৬ সালে। ১৯৯৯ সালে পরলোক যাইবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি নগরী ঢাকাতেই থাকিতেন। তাঁহার সম্পর্কে আহমদ ছফা যাহা যাহা লিখিয়াছেন তাহা তাহা এই অধ্যাপক মহোদয়ের জীবনের শেষ কিছু কম ৩০ বছর ব্যাপিয়া—১৯৭০ হইতে ১৯৯৮ সালের মধ্যে—ঘটিয়াছে। এইখানে শেষ জীবনের আবদুর রাজ্জাককে পাওয়া গেলেও যাইতে পারে—এহেন সম্ভাবনা আছে।
আহমদ ছফা সাক্ষ্য দিতেছেন তিনি দীর্ঘ আটাইশ ঊনত্রিশ বছর ধরিয়া অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্য পাইয়াছেন। তথাপি রাজ্জাক সাহেব একদিনের জন্যও তাঁহার নিকট পুরাতন হইয়া যান নাই। প্রতিবারই তাঁহার ব্যক্তিত্ব এবং জানাশোনার পরিধি ছাত্রের নিকট নতুন নতুন চমকের মতন মনে হইয়াছে। ইহাই আসল কথা। আহমদ ছফা জানাইতেছেন: প্রথম দিন তাঁহার সঙ্গে কথা বলিয়া যেভাবে বিস্মিত হইয়াছিলাম, এখনো—মানে বাংলা ১৪০৪ সনে (ইংরেজি ১৯৯৮)—একই ধরনের বিস্ময় তিনি আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করিতেছেন।
বিস্ময় আসে কোথা হইতে? নবীনত্ব হইতে। ফরাসি চলচ্চিত্রকর রোবের ব্রেসোঁ (Robert Bresson) বলিতেন নবীনত্বই আসল। ইহা আদিসত্তাও নহে, সর্বশেষাবস্থাও নহে। আহমদ ছফা গুরু মারা নবীন বিশেষ শিষ্য। ইহাতে সন্দেহ নাই।
১
১৯৭০ সালের কথা।
কেহ কিংবা কাঁহারা জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার যশোপ্রার্থী তরুণ আহমদ ছফাকে বলিয়াছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের তত্ত্ব অবধান করিয়া উপাধি গ্রন্থ লিখিতে। বাংলা একাডেমী হইতে বৃত্তি পাইয়া তিনিও সরেনজর গবেষণা করিবার মানস করিলেন অধ্যাপক রাজ্জাকের অধীনে। রাজ্জাক সাহেব বলিলেন গবেষণা করিবেন ভালো কথা। কিন্তু আমার অধীনে করিতে পারিবেন না। কারণ থিসিস যাঁহাদের অধীনে করা যায় তাঁহাদের প্রয়োজন বিশেষ যোগ্যতার—তাঁহাদিগকে প্রফেসর বা রিডার (এখনকার দেশীয় ভাষায় অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর) হইতে হয়। রাজ্জাক সাহেব বলিলেন, ‘আমি ত মোটে লেকচারার।’ (ছফা ২০০৭: ১৭)
প্রশ্ন উঠিতে পারে, কোন লোক প্রায় ৩৪-৩৫ বছর পড়াইয়াও মোটে ‘লেকচারার’ কেন? ১৯৭২ সালে তাঁহাকে সরাসরি জাতীয় অধ্যাপক বানানো হইয়াছিল। ততদিনে তাঁহার গুণগ্রাহী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা হইয়াছেন। অন্যায়ের শেষ হইল। এই যে সারাজীবন পদোন্নতি না লইয়া থাকা ইহা কি কম চমক সৃষ্টি করিবার মতন ঘটনা? নিয়মের অতিক্রম বা ব্যভিচার বলিতে কী বুঝায় যাঁহারা জানিতে চাহেন তাঁহারা এই ঘটনা আমল করিতেই পারেন।
শিক্ষক হিসাবে অধ্যাপক রাজ্জাকের প্রথম উপদেশটা আকর্ষণীয়। আহমদ ছফার গবেষণার বিষয় কী জিজ্ঞাসা করিয়া অধ্যাপক রাজ্জাক জানিলেন বিষয়টি অতি বড়। ‘১৮০০ হইতে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ এবং সাহিত্য সমাজ ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে তাহার প্রভাব’—এই চওড়ালম্বা নাম শুনিয়া রাজ্জাক সাহেব কহিলেন, ‘এক্কেরে ত সাগরসেঁচার কাম। কার বুদ্ধিতে এই গন্ধমাদন মাথায় লইছেন?’ (ছফা ২০০৭ ১৮) এই সন্দেহ যথার্থ ছিল। আহমদ ছফা নিজেই জানাইয়াছেন তিনি কোনদিন এই থিসিস লিখিয়া সারিয়া উঠিতে পারেন নাই। (ছফা ২০০৭: ১৩) এই সত্য কথাটি আরো সত্য হইত যদি তিনি বলিতেন রাজ্জাক সাহেবের সাহায্য পাইয়াও পারেন নাই। অথচ ছফা বলিয়াছেন ইহার জন্য—না পারার জন্য—তিনি মহান আবদুর রাজ্জাককেই দায়ী মনে করেন।
আহমদ ছফা ‘দায়ী’ কথাটি নিছক নিন্দা করিবার ছলে বলেন নাই। ইহার একপাটি ছক তো আছেই। রাজ্জাক সাহেব তাঁহাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান বই পড়িতে বলিয়া এক প্রকার সাগরে ডুবাইয়া দিলেন। সেই সাগর সেঁচার শেষ হয় নাই বলিয়াই আহমদ ছফার উপাধির বইটি লেখা শেষ হয় নাই। ইহা কি নিন্দার না প্রশংসার কথা পাঠিকা বলিবেন। আমি বলি ইহাও নিয়মের ব্যভিচার বৈ নহে। অধ্যাপক রাজ্জাকের চমক আরো এক দফা দেখিলেন আহমদ ছফা।
উপাধি পাওয়ার জন্য লিখিলেন। অতয়েব ‘কাম’চর্চা হইল। এমনি এমনি—মানে ‘আকাম’স্বরূপ—পড়িলেন। তাহাতে কী হইল? উত্তরে ছফা বলিলেন আকাম হইবে কেন? ইহার নাম তো ‘নিষ্কাম’ জ্ঞানচর্চা। নিষ্কাম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে আর প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করিয়া আপন বিশ্বাসের উপর স্থির থাকিবার ব্যাপারে আবদুর রাজ্জাক অদ্বিতীয় ছিলেন—ছফা লিখিয়াছেন।
আমরা অনেক সময় বলিয়া থাকি যেমন গুরু তেমন শিষ্য। কিন্তু ভাবিলে টের পাইতাম ইহার উল্টাটাও কম সত্য নহে: যেমন শিষ্য তেমন গুরুও বটে। আহমদ ছফার মতন শিষ্য না পাইলে রাজ্জাক সাহেবের গুরুজীবন চোদ্দ আনা আমাদের অজানাই থাকিত। স্থানে স্থানে আহমদ ছফার নিজ ‘মনো-উক্তি’ প্রকাশিত হইলেও আমরা দেখিতেছি তাঁহার গুরুভক্তি কোথাও শিথিল কবরী হয় নাই।
গ্রন্থনামেই তাঁহার প্রথম দৃঢ় প্রকাশ। আমার গুরু যদি শুঁড়ি বাড়িও যাইয়া থাকেন, তাহাতে ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। তিনি গুরুই থাকেন। শাস্ত্রমতে ইহাই ভক্তি। ভাগ করিয়া দেওয়ার মতন মনোভাবই ভক্তি। আহমদ ছফা এই গুরুভক্তি প্রকাশ করিতে গিয়া কোথাও কোথাও গুরুকে চাঁড়াল করিয়া ছাড়িয়াছেন। তাঁহার বিবরণ এক স্থানে এই রকম: তখন অধ্যাপক সাহেব শহিদ মিনারের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোয়ার্টারের একটিতে নিচের তলায় থাকিতেন। ছফা প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন ঘরটির পরিসর বিশেষ বড় নহে। চারিদিক বইপুস্তকে ঠাসা। ঘরটিতে একটিমাত্র খাট। না, খাট লিখা ঠিক হইবে না, চৌকি। সামনে একটি ছোট টেবিল। চৌকিটির আবার একটি পায়া নাই। সেই জায়গায় বইয়ের উপর বই রাখিয়া ফাঁকটুকু ভরাট করা হইয়াছে। চমৎকার ব্যবস্থা। পুরানা বইপত্রের আলাদা একটা গন্ধ আছে। ছফা সেই বইপত্রের জঞ্জালে হতবিহ্বল হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। এই ঘরে যে কোন মানুষ আছে তিনি প্রথমে খেয়ালই করেন নাই। হঠাৎ দেখিলেন চৌকির উপর একটা মানুষ ঘুমাইয়া আছেন। একখানা পাতলা কাঁথা সেই মানুষটার নাক অবধি টানিয়া দেওয়া। চোখ দুইখানি বোজা। মাথার চুল কাঁচা ও পাকা। অনুমানে ছফা বুঝিয়া লইলেন, ইনিই তাঁহার আরাধ্য অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। (ছফা ২০০৭: ১৫-১৬)
অধ্যাপক রাজ্জাকের সদুপদেশমালার একাংশ ছফা সাহেব আমাদের জানাইতেছেন। অধ্যাপক বলিলেন, যখন কোন নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানিবার চেষ্টা করিবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কী করে। কী খায় দেখিবার লাগিয়া কাঁচাবাজারে যাইবেন আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা উনারা কী গোছের করেন তাহা জানিবার লাগিয়া। কী খায় কী পড়ে এই দুইটা জিনিস না জানিলে কোন জাতির কোন কিছু জানিতে পারা যায় না। (ছফা ২০০৭: ২১-২২)
২
অধ্যাপক রাজ্জাক কী খাইতেন তাহার বিবরণ ছফার বইতে পাইবেন। একটা দৃষ্টান্ত: একটা বড় চীনামাটির প্লেটে চৌকোনা সাইজের পুরু পরাটার স্তূপ। ভুনা গরুর মাংস। চিতই পিঠার সঙ্গে ভাজা ইলিশের টুকরা। ফালি ফালি করিয়া কাটা পনির। ডিম ভাজা। ভাজা রূপচান্দা শুঁটকি। একপাশে গরম করা গতরাতের বাসি ভাত। আরেকটা বাটিতে ছফা দেখিলেন খুদ ভাত। রাজ্জাক স্যার বাসি ভাতের প্লেট হইতে চামচ দিয়া ভাত তুলিয়া লইলেন। তারপর ভাতের সঙ্গে কিছু তাজা মুড়ি মাখাইয়া লইলেন। ছফা জানিতে পারিলেন, ঢাকা জিলার কেরানিগঞ্জ এলাকার মানুষজন ভাতের সঙ্গে মুড়ি মাখাইয়া তৃপ্তির সহিত ভোজন করিয়া থাকেন। ইহা শুদ্ধ প্রাতঃকালের খাদ্য। ছফা দেখিলেন মাত্র।
শুদ্ধ খাদ্য আর পাঠ্যই নহে, মানুষ চিনিবার আরেক পন্থা আছে। কে কাহার লগে চলাফেরা করেন তাহাও দেখিতে হইবে। রাজ্জাক সাহেবের বন্ধু ছিলেন কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পী জয়নুল আবেদীন। বন্ধু তাঁহার আরো হইয়াছিল। দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদও তাঁহার শিষ্য অথবা বন্ধু। এগুলি ভালো বন্ধু। কিন্তু প্রদীপের নিচেও অন্ধকার থাকে। রাজ্জাক সাহেবের বন্ধু নানা প্রকারের। তাঁহার সকল বন্ধু আহমদ ছফার পছন্দের হয় নাই। ছফা স্পষ্টাক্ষরে লিখিয়াছেন: মতলববাজ মানুষরাই বেশির ভাগ সময় রাজ্জাক সাহেবকে ঘিরিয়া থাকিতেন। উদাহরণের মধ্যে এককালীন উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু মাহমুদ ও অধ্যাপক ওয়াহিদুল হকসহ অনেকেই। সর্বমহি কথা।
আহমদ ছফা রাজ্জাক সাহেবের সহিত প্রেম করিয়াছেন—নিজের প্রেমকে তিনি বলিয়াছেন নিষ্কাম। (ছফা ২০০৭: ২৮) আথেনস নগরীর তরুণদল দলে দলে যে অমৃতের টানে সক্রাতেসের ছাতার তলে ছুটিয়া যাইত, ছফা সাহেবও সেই রকম ‘নিষ্কাম টান’ খাইয়া রাজ্জাক সাহেবের ছাতার নিচে ছুটিয়া গিয়াছিলেন। বলিয়াছেন, তাঁহার ব্যক্তিত্বের এমন একটা সুন্দর সম্মোহন রহিয়াছে যাহার আকর্ষণ এড়ানো তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। তিনি মনে মনে রাজ্জাক সাহেবকে তাজমহল নামক একটি দালানের সহিত তুলনা করিলেন। বলিলেন তাজমহলকে সামনে হইতে, পিছন হইতে, ডাইন হইতে, বাম হইতে যেইদিক হইতেই দেখা হউক না কেন দর্শকের দৃষ্টিতে ক্লান্তি আসে না। আরো দেখার পিপাসা জাগে।
পরক্ষণেই ছফা ভাবিলেন এই তাজমহল সেই তাজমহল কিনা। তাঁহার ভাষায়: রাজ্জাক স্যার তাজমহল ঠিকই, তবে তাহাতে কোন দরজা জানালা নাই। থাকিলেও তাহাতে কোন ছিটকিনি নাই। এই দিকের হাওয়া ঢুকিয়া ওইদিক দিয়া চলিয়া যায়। ওইদিকের হাওয়া এইদিকে। এই রকম দীপ্তিমান মনীষাসম্পন্ন ব্যক্তি কেন এই অজস্র বামুন-পরিবেষ্টিত অবস্থায় সকলের মাপে নিজেকে ছোট করিতেছেন তাহার কারণ ছফা আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। ছফা দাবি করিয়াছেন অনেক সময় লাগিয়াছে আবিষ্কার করিতে। কিন্তু আমরা সবিনয়ে বলিব তাহার দাবি অসারই থাকিয়া গিয়াছে। (ছফা ২০০৭: ২৯)
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একটা থিসিস লিখিয়াছিলেন। ১৯৫০ সালে উহা শেষ না করিয়াই তিনি ইংরেজভূমি হইতে বঙ্গদেশে ফিরিয়া আসেন। অনেক পরে ১৯৮০ সালে তিনি তাঁহার ছাত্র মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর নামে একটা বক্তৃতা লিখিয়াছিলেন। ইহা ছাড়াও তাঁহার আরো ছোটখাট লেখা থাকিতে পারে। কিন্তু সেইগুলি আজি পর্যন্ত এক জায়গায় করা হয় নাই। তাই লোকে বলে তিনি বিশেষ লেখেন নাই। ছফা বলিয়াছেন ইহার কারণ দুই হইতে পারে। অনেক সময় উৎকৃষ্ট বীজ পাথরে পড়িয়া নষ্ট হয়। ছফা সাহেবের ধারণা রাজ্জাক সাহেবের বেলায় তাহাই ঘটিয়াছে। দেশ ও কাল তাঁহার সহায় হয় নাই। আরেকটা কারণ—রাজ্জাক সাহেবের মানসিক উন্নতি। সেই কালের বামনদের স্তরে তিনি নামিতে পারেন নাই। ছফা শুদ্ধ দুইটা উদাহরণ দিয়াছেন: রাজ্জাক সাহেব যৌবনে ট্রটস্কি নামা রুশীয় দার্শনিক রাজপুরুষের চিরস্থায়ী এনকেলাব (পারমান্টে রেভুলুশন) শীর্ষক বহিও তর্জমা করিয়াছিলেন। আর এদিকে বাংলাভাষায় লেখা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি পুস্তিকা বাংলার ব্রত ইংরেজিতে লিখিয়াছিলেন।
৩
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন সারা বাংলাদেশের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশে তাঁহার নাতিদীর্ঘ ছায়া পড়িয়াছে। ইহা ছফা জানেন। তিনি শুদ্ধ রাজনীতি বা অর্থনীতির বিষয়ই জানিতেন না, সাহিত্য, শিল্পকর্ম, সঙ্গীত ও অন্যান্য সূক্ষ্মকলা সম্বন্ধে তাঁহার জ্ঞান ও ভালোবাসা দুইটাই প্রবল ছিল।
রাজা রামমোহন রায় হইতে শুরু করিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত আধুনিক বাংলাদেশের নামজাদা বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে রাজ্জাক সাহেবের নানা বক্তব্যের সকলই চমকপ্রদ। রামমোহন রায়ের সকল কাজের মধ্যে বাংলা ভাষা চর্চাই প্রধান। ইহাই অধ্যাপক রাজ্জাকের মত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তিনি পুরুষসিংহ বলিতেন। সমাজনেতা হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে বিদ্যাসাগরের চেয়ে ছোট মাপের লোক বলিয়াছেন তিনি। ইহা চলিত জনমতের সহিত মিলিবে না। আহমদ ছফাও মানিতে পারেন নাই।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সম্বন্ধে প্রচার আছে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতিগণের মধ্যে পড়েন। কেহ কেহ বলেন আওয়ামী লীগ প্রণীত ছয়দফার মূল ধারণা তাঁহারই চিন্তার ফসল। এই সত্যের স্বীকৃতি পরোক্ষে পাওয়া যায় সারা পাকিস্তান যুগে তাঁহার পদোন্নতি না হওয়ার ঘটনায়। সবচেয়ে বড় কথা, পাওয়া যায় দেশ স্বাধীন হইবার পর তাঁহাকে মানবিক বিদ্যায় জাতীয় অধ্যাপক পদে বরণ করিবার সরকারি সিদ্ধান্তেও।
কিন্তু খটকা থাকিয়া যাইতেছে অন্য জায়গায়। একইভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও প্রাণ ঢালিয়াছিলেন তিনি। তিনি মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর অনুরাগী ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনকে তিনি শুদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা বলিয়া তুচ্ছ করিতেন না। বলিতেন উহাও বাংলার মুসলমান সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার ন্যায্য আন্দোলন ছিল। একইভাবে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য নামে ডাকিতেন না। আমি অদ্য কথা দুইটি বলিলাম তাঁহার দুই বইয়ের দোহাই দিয়া। একটি অপ্রকাশিত থিসিস, আমি উহা দেখিয়াছি। অন্যটি প্রকাশিত বক্তৃতা। আমি তাহার সমালোচনা এক সময় লিখিয়াছিলাম।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের রাষ্ট্রচিন্তার সহিত আমি দ্বিমত করিতাম। সেই পার্থক্য এখনো বজায় রহিয়াছে। কিন্তু তাঁহার মহত্ত্ব আমিও স্বীকার করিয়াছি। আহমদ ছফার সহিত একমত হইয়া আমিও বলিব নিজের দেশ ও সমাজের প্রতি নিঃশর্ত অঙ্গীকারই তাঁহাকে আর দশজনের নিকট হইতে আলাদা করিয়াছে। আহমদ ছফা বলিয়াছেন, বাঙালি মুসলমান সমাজকে বুদ্ধির দিক হইতে সাবালক করিবার পিছনে তাঁহার ভূমিকা আর সকলের তুলনায় উপরে আছে।
তিনি একদিন মনে করিয়াছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাইলে বাংলার মুসলমান সমাজের উপকার হইবে। এখন পাকিস্তান গিয়াছে, বাংলাদেশ আজও টিকিয়া আছে। রাজ্জাক সাহেব এই দুই যুগ, দুই সময় পার করিয়াছেন কিন্তু এক সমাজই রহিয়া গিয়াছে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান সমাজের সবচেয়ে সুন্দর প্রতিনিধি বলিয়া রায় দিয়াছেন। এই সুন্দর শব্দটার ইংরেজি অনুবাদ দাঁড়ায় সেকুলার বা সোজা মানুষ। ধর্ম বলিতে এয়ুরোপে যে বাঁকা বাঁকা চাকা বোঝাইত সেকুলার বা দুনিয়াদারি তাহার তুলনায় সোজাসাপ্টা।
ঢাকায় যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন রাজত্ব করিতেছেন জাতীয় পরিচয়ে তাঁহারা বাঙালি মুসলমান। সেকুলার বাঙালি মুসলমান কথাটা কাঁহারও পছন্দ না হইলে বলিতে পারেন চাঁড়াল মুসলমান। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক নিঃসন্দেহে এই মুসলমান ও বাঙালি চণ্ডালদের গুরু।
দোহাই
১. আহমদ ছফা, যদ্যপি আমার গুরু, ৪র্থ সংস্করণ (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৭)।
২. সলিমুল্লাহ খান, বাংলাদেশ: জাতীয় অবস্থার চালচিত্র, [প্রথম প্রকাশ ১৯৮৩] তৃতীয় সংস্করণ (ঢাকা: বাঙলা, ২০০৩)।
প্রথম প্রকাশ: বিডি নিউজ২৪ডটকম, ১৪ মার্চ ২০০৯