স্মৃতি

আমার শিক্ষক তারেক মাসুদ

Spread the love
তারেক মাসুদ, সলিমুল্লাহ খান ও আলম খোরশেদ; ছবি: নাসির আলী মামুন, যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯২

যাঁহারা মূর্তি ভাঙ্গিবার কাজে হাত দিয়া থাকেন, তাঁহারা নিজেরাই মূর্তি হইয়া উঠিবার ঝুঁকি লয়েন। — জাঁ ককতো

তারেক মাসুদ এন্তেকাল করিয়াছেন। একা করেন নাই, সঙ্গে করিয়াছেন আরো চারি জন। তিন জন সঙ্গী গুরুতর জখম হইয়াছেন, একজন সামান্য। ২৯ শ্রাবণ, শনিবার, বারবেলায় এই ঘটনা ঘটিয়াছে পুরানা ঢাকা জেলার ভিতরে, নতুন জেলা মানিকগঞ্জ সদরের অদূরে।

যখন পহিলা খবরটি পাইলাম তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল ছাত্রছাত্রীর সহিত বসিয়া আলাপ করিতেছিলাম। যখন শুনিলাম, প্রথম অবিশ্বাস করিলাম, তারপর অবাক হইলাম। শেষ পর্যন্ত বুঝিলাম বিশ্বাস করিতে হইবে অবিশ্বাসকে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ করিতেই হইবে। অবাককে কথা বলিতে হইবে।

এই শেষের দিকে তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। মোবাইল ফোন কোম্পানির সংযোগ যেমন মধ্যে মধ্যে বন্ধ হইয়া থাকে তেমন অনেকখানি। কিন্তু তারেক মাসুদের কথা দিনে একবার ভাবি নাই এমন দিন আমার কমই গিয়াছে। এই অন্তরের দিনেও। তিনি আমার উত্তমর্ণ। নানা সুবাদে। একাধিক কারণে।

তারেক মাসুদ উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তাঁহার সহিত পহিলা যেদিন দেখা হইল সেদিনই তাহা টের পাইয়াছিলাম। সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইয়াছি। ইহা ইংরেজি মতে ১৯৭৬ সালের কথা। তারেক মাসুদ ও পিয়াস করিম একযোগে দেখা দিয়াছিলেন। সেকালের শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন নামে খ্যাত আশ্রয়কেন্দ্রের আশেপাশে তাঁহারা ঘুরিতেছিলেন। তখন লেখক শিবির নামে একটি দল জীবিত ছিল। তাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা হইয়াছিলেন তারেক মাসুদ।

তারেক মাসুদের সাথে আমার নতুন করিয়া পরিচয় করিয়া দিয়াছিলেন মোহন রায়হান। ১৯৭৮ সালে মোহন রায়হানের পহিলা বহি ‘জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ’ প্রকাশ করিয়াছিলেন ‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির’। আমার ধারণা তাহাতে তারেক মাসুদের হাত ছিল। প্রথমদিকে তারেকের নাম সামান্য লম্বা ছিল—আবু তারেক মাসুদ। সেই নামে তিনি ছড়া লিখিতেন। পরে তিনি—আবু পদটি বর্জন করিবার পর—কখনো কখনো আ. তা. মাসুদ নামেও সিনেমার গান লিখিয়া থাকিবেন। সত্য বলিতে আমি তারেকের ছড়ার তুলনায় তাঁহার কথা বেশি শুনিতে চাহিতাম। কিন্তু সে কথা তাঁহাকে বলিতে সাহস করি নাই।

তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন, জোর করিয়া ছড়া শুনাইয়া তিনি কখনো আমাদিগকে লজ্জা দেন নাই। এইরকম জোরাজুরি আমিও কখনো কখনো করি নাই এমত নহে। বলা বাহুল্য, কবিতার দোষ হইতে আমিও আজ পর্যন্ত ষোল আনা ছাড়া পাই নাই।

প্রথম পরিচয়েই তারেক আমাকে বলিয়াছিলেন তিনি চলচ্চিত্রকেই জীবনের ধ্রুবতারা করিয়াছেন। আমাদের বন্ধুদের বেশির ভাগই যে যাহার ধ্রুবতারা সময়মত হারাইয়া ফেলিয়াছেন। তারেক হারাইতে পারেন নাই। তিনি ছিলেন সংকল্পে দৃঢ়। তিনি ইতিহাস বিভাগে পড়িতেন। আনন্দের কথা, এই পড়া তাঁহার চিন্তার পথে কোন ব্যাপক ব্যাঘাত সৃষ্টি করিতে পারে নাই। তারেক আমাকে কথাটা নিজেই বলিয়াছিলেন: ‘ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক হওয়া আমার জীবনের লক্ষ্য নহে।’ তিনি কথা রাখিয়াছিলেন।

১৯৭৮ সালের শেষের দিকে আমি সিদ্ধান্ত লইয়াছিলাম একটি বিশেষ চরিত্রের পত্রিকা প্রকাশ করিব। আমি লেখক শিবিরের সদস্যপদ লাভ করিবার গৌরবে তারেকের শরিক হইতে পারি নাই। অবশ্য শিবিরের মধ্যে থাকিলেও শিবির জিনিশটাকে ইতিহাস বিভাগের অধিক মর্যাদা তারেক মাসুদ দিতে পারেন নাই। শিবিরের অন্য পাঁচটি সভ্য আমাকে যতখানি অনাত্মীয় ভাবিতেন তারেক মাসুদ ততখানি ভাবেন নাই। তাহার কারণ আছে।

‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীতে তারেক মাসুদ, থিয়েটার ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম

লেখক শিবির জিনিশটার তখন আর প্রাণ ছিল না, ছিল কতক আচার মাত্র। আমি যখন ‘প্রাক্সিস জর্নাল’ কাগজটা বাহির করি তখন তারেক আমাকে আত্মীয় ধরিয়া লইলেন। তিনি আমাদের সম্পাদনা পরিষদে নিজের নামটি যুক্ত করিতে কুণ্ঠিত হয়েন নাই।

কয়েক বছর পর আমরা একটি পুস্তিকা বাহির করি। নাম ছিল ‘সমকালীন সাহিত্যের প্রবণতা ও শ্রেণীচরিত্র প্রসঙ্গে’ বা ইহার কাছাকাছি কিছু। এই পুস্তিকা মোটের উপর আমিই লিখিয়াছিলাম। আর ইহাতে আমার প্রধান সহায় হইয়াছিলেন তারেক মাসুদ। তিনি আমাকে জগতের যত নতুন খবর সবই জানাইতেন। বই আনিয়া দিতেন। সেই পুস্তিকায় প্রায় তিরিশ-বত্রিশ জনের স্বাক্ষর ছিল। আমার এবং তারেক মাসুদের নাম দুইটিও বর্ণানুক্রমে যথাস্থানে ছাপান হইয়াছিল। আহা, পুস্তিকাটি এখন হারাইয়া কোথায় গিয়াছে জানি না! একটা কথা অবশ্য মনে আছে: কবি অসীম সাহার নাম প্রথম মুদ্রণে ছাপা না হওয়ায় পরে রবার স্ট্যাম্পযোগে যুক্ত করিতে হইয়াছিল।

তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার অনেক বিষয়ে আলাপ হইত। সত্যের খাতিরে বলিতে হইবে চলচ্চিত্র বিষয়ে আমার আগ্রহ যাঁহারা শিক্ষকের মতন যত্ন করিয়া তৈয়ার করিয়া দিয়াছেন তারেক মাসুদ তাঁহাদের মধ্যে একেবারে সামনের কাতারে। তারেকের ইংরেজি জ্ঞানও ছিল উত্তম।

সত্য আরো বলিতে হইবে। আমার চরিত্রের মধ্যেই নিহিত আমার নিয়তি। শিক্ষকগণের সহিত দ্বিমত করাই আমার বিধিলিপি। শেষের দিকে আমি আর তাঁহার শিক্ষা হইতে উপকার লাভ করিতে সমর্থ ছিলাম না। হয়ত তাহাতে আমারই হয়রানি বাড়িয়াছে।

১৯৮৬ সালে আমি ছাত্রবেশে মার্কিন মুলুকে চলিয়া যাই। তাহার বছর কয় পরে তারেকও সেই দেশে সাময়িক হিজরত করেন। জীবিকা সংগ্রহের প্রয়োজনে আমি তখন একটি বইপত্রের দোকানে চাকরি গ্রহণ করি। একদিন সেই দোকানে দেখি ক্যাথরিন শাপির নামে এক ভদ্রমহিলা আসিয়া হাজির। তিনি জানাইলেন তারেক মাসুদ তাঁহার আত্মীয় হইবেন। সংবাদটা অবশ্য আমার জানা হইয়াছিল তাহার মাত্র কিছুদিন আগে।

তারপর একদিন দেখি সত্য সত্যই তারেক মাসুদ নতুন ইয়র্ক শহরে নাতিদীর্ঘ ছায়া ফেলিতেছেন। আমরা পাঁচ হইতে সাত বছর সেই জগজ্জোড়া শহরে একটানা বসবাস করিয়াছি। যখন পিছনে ফিরিয়া দেখি, আমাদের সেই দিনগুলি সত্যই রবিবাবুর গানে কথিত রঙ্গের মতন নানা রঙ্গে রঞ্জিত ছিল।

শেষ পর্যন্ত তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নতুন ইয়র্কের অঙ্গস্বরূপ স্ট্যাটেন আয়ল্যান্ড নামা এক দ্বীপে বাসা লইলেন। বাসাটি ছিল একটি টিলার উপর নির্মিত কাঠের ঘর। বড়ই মনোরম। আমি বহুদিন সেই ঘরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছি। কারণ আমি আসিতাম অনেক দূর হইতে। অধিক রাতে ফেরা সম্ভব হইত না।

তারেক মাসুদ, আলম খোরশেদ, নাসীর আলী মামুন

তারেকও তখন আমার মতন বইপত্রের দোকানে কাজ করিতেন। তাঁহার কর্মস্থল ছিল নতুন ইয়র্ক শহরের বাঁকাপথ ওরফে ব্রডওয়ে আর ১২ নম্বর রাস্তার সংযোগবিন্দুতে। এই দোকানটি পাঁচতলা ভবন জুড়িয়া বসিত। বিজ্ঞাপন অনুসারে তাহার বইপত্রের সকল তাক একটার পর একটা সাজাইলে দৈর্ঘ্য হইবে মোটে আট মাইল। নাম স্ট্রান্ড বুকস।

আমি কাজ করিতাম ৫ নম্বর অ্যাবিনিয়ু ও ১৪ নম্বর রাস্তার সংযোগস্থলে। আমার বিদ্যালয়ের বইয়ের দোকানটার নাম ছিল ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস বুকস’। অনেক মধ্যাহ্নে আমরা একত্রে ব্রডওয়ে ও ১৪ নম্বর রাস্তার সংযোগস্থলে অবস্থিত ইয়ুনিয়ন স্কয়ার পার্কে বসিয়া দুপুরের খাবার খাইয়াছি। বলা বাহুল্য নহে, তারেক ভাল রান্নাও করিতেন। দুপুরের আহার্য স্যান্ডুয়িচটি তাঁহার সঙ্গেই থাকিত।

কাঠমিস্ত্রী হইলেও তারেক মাসুদ জীবনে তেমন মন্দ করিতেন না। এই সময় তিনি সেই কাজটাও মাঝে মধ্যে করিতেন। নিজের বাসার ছোটখাট মেরামতির কাজ তিনি নিজেই করিয়া সারিতেন। কখনো কখনো ভাড়ায়ও যাইতেন। এমনই এক যাত্রায়—তারেক একদিন আমাকে বলিতেছিলেন—তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু দলিলচিত্র আবিষ্কার করিলেন।

ঘটনাটা শুদ্ধ কাক আসিবার পর তাল পড়িবার বিষয় নহে। ইহার পিছনে কঠোর সাধনা ছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের স্মৃতি হিশাবে এই দলিল-দস্তাবেজ অমূল্য রতন। মার্কিন চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেবিনের সহিত তারেক মাসুদের পরিচয় ও ১৯৭১ সালের ফুটেজ উদ্ধারপর্ব এতদিনে কিংবদন্তি হইয়াছে। নতুন ইয়র্কে থাকিতেই তারেক সেখানে ইহার একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করিয়াছিলেন। সেখান হইতে একটি পুস্তিকাও ছাপা হইয়াছিল। সেই পুস্তিকায় আর পাঁচজনের সহিত আমিও দুইকথা লিখিয়াছিলাম।

এই যে শেষের দিকে শিক্ষক-বন্ধুর সহিত আমার যোগাযোগ স্থগিত হইয়া আসিল তাহার বীজ এখন দেখিতে পাইতেছি সেই সময়েই রোপা হইয়াছিল। আগেই বলিয়াছি, তারেক মাসুদ ছিলেন একাধারে উচ্চাভিলাষী এবং দৃঢ়সংকল্প। এখন বুঝিতেছি, ভক্তির জন্য নিজের প্রাণকেও তিনি তুচ্ছ করিতে পারিতেন। আমাদের সহিত তাঁহার বিচ্ছেদ প্রাণের সহিত প্রাণের বিচ্ছেদ বৈ নহে। এই ছেদে তিনিই নেতা ছিলেন—আমি বিনীত অনুসারী মাত্র।

তিনি তবে ‘ভক্তি’ করিয়াছিলেন কাহাকে? তাঁহার ছবি যাঁহারা দেখিয়াছেন সে কথা তাঁহারাই ভাল বলিতে পারিবেন। বাংলাদেশের হৃদয়কে তিনি ভাষা দিতে চাহিয়াছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাস তিনি পড়িয়াছিলেন তাঁহার নিজের মত করিয়া।

তারেক মাসুদ যে জায়গায় জন্মিয়াছিলেন সেই ফরিদপুর অঞ্চল ছিল পরাধীন যুগে কৃষক সংগ্রামের কেন্দ্রভূমি। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মুসলমান কৃষক—মজদুর ও গৃহস্থ উভয় স্তরের কৃষকই—এসলাম ধর্মের সংস্কারকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আদর্শ আকারে গ্রহণ করে। এই আন্দোলন বাংলাদেশে আজও ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ নামে জাহির আছে। এসলামের এই ভাষ্য তারেক মাসুদ গ্রহণ করেন নাই।

এসলাম এ দেশে আসিবার আগে এ দেশে যে সকল ধর্মাচার প্রতিষ্ঠা পাইয়াছিল আর যেসব আচার এসলামের মধ্যে আসিয়া ভিড় জমাইয়াছিল সমূলে তাহাদের বিনাশ করা ছিল ফরায়েজি আন্দোলনের লক্ষ্য। তারেক মাসুদ এসলামকে লোকধর্ম হিশাবে দেখিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহার ‘মাটির ময়না’ ছবিতে এই বিশ্বাস এস্তেহার আকারে হাজির আছে।

আমি জানি ‘মাটির ময়না’ ছবিটি বাংলাদেশে অনেকেই পছন্দ করিয়াছেন। অনেকে ইহার মধ্যে নতুন বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের নান্দীগান শুনিতে পাইয়াছেন। আমিও এই ছবিটি দেখিয়াছিলাম। আমার মনের কথাটি একদিন দুই স্তবক আকারে লিখিয়াও ফেলিলাম। বলা বাহুল্য, তিনি তাহা পছন্দ করেন নাই।

‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রের পোস্টার

আমি কি লিখিয়াছিলাম তাহা এখন আমার আর মুখে আসিতেছে না। যাহাই লিখি না কেন, আমি এখনো বলিব ছবিটিতে যে ময়না মাটির নির্মিত, তাহাতে প্রাণের সঞ্চার করা কঠিন কাজ। সেই কাজে তিনি সফল হইয়াছেন কিনা তাহা বলিতে আরো সময় লাগিবে। তবে তিনি যে হাত দিয়াছিলেন তাহা আমাকে অবাক করে নাই।

বাংলাদেশে এসলামের সূচনা যে কারণেই হৌক, এসলাম প্রচারের কারণে বর্ণাশ্রম ধর্মের অবয়বে একটা বড় আঘাত নামিয়া আসে। দুঃখের মধ্যে, খোদ এসলামও এ দেশে আসিয়া বর্ণাশ্রম ধর্মের আঘাতে খানিক পঙ্গু হইয়াছে। বর্ণাশ্রম ধর্মের এই আঘাতই শেষ পর্যন্ত দেশটাকে দ্বিখণ্ডিত করে। আমি এখানে ১৯৪৭ সালের কথাটাই তুলিতেছি।

১৯৪৭ সালের ইতিহাস বাদ দিয়া বর্তমানে বাংলাদেশের ইতিহাস সাধনা চলিতেছে। তারেক মাসুদের সাধনা তাহাকে পুরাপুরি মানিয়া লয় নাই। এখানেই আমি একদা তাঁহার সহিত আত্মীয়তার একটা ভিত্তি আবিষ্কার করিয়াছিলাম। আর যেদিন দেখিলাম তিনি ভূতত্ত্ববিদ্যায় কথিত মহাদেশের মতন ক্রমশ অন্য স্রোতে ভাসিতে শুরু করিয়াছেন, সেদিন আমাদের মধ্যে একটা মহাসাগরের দূরত্ব দেখা দিল।

সবকিছুর পরও আজ স্বীকার করিয়া বলি, বাংলাদেশে আমরা যে সাধনায় আজও সফল হই নাই সেই মুক্তির সাধনায় তারেক মাসুদের নাম অক্ষয় অক্ষরে লিখিত থাকিবে। যে সাধনা প্রশ্ন জাগায় না, কেবল আবেগ উসকাইয়া দেয় সে সাধনা ধর্মসাধনা মাত্র। আর যে সাধনা প্রশ্ন করে, ধর্মাচারের গোড়ার কথাও প্রকাশ করে তাহাকে বলে অর্থসাধনা।

আমার ভয় হয় তারেক মাসুদ কখনো ধর্মসাধনার পথে হাঁটিয়াছেন, আবার কখনো অর্থসাধনার খবর লইয়াছেন। আমার অপূর্ণ বুদ্ধিতে যতটুকু বুঝিয়াছি আমি ততটুকুই তাঁহার ধর্মসাধনার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছি, অর্থসাধনার বিরুদ্ধে কখনো হাত তুলি নাই।

এখন তারেক মাসুদ আর সমুখে নাই। তাই এই কথাটি বিশেষ বলিবার আবশ্যক হইয়াছে। যৌবনের প্রারম্ভে—একটা কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম—একদা আমরা দুই জনেই আহমদ ছফার পদতলে বসিয়া প্রজ্ঞাভিক্ষা করিয়াছিলাম। কিন্তু আমাদের পথ একসময় আলাদা হইয়া যায়।

২০০১ সালে আহমদ ছফা বিগত হইলে পর এই বিচ্ছেদ আরো বড় হইতে শুরু করিল। পরের বছর হইতে আমরা দরিদ্র সাধারণের দেয় চাঁদা ভর করিয়া একটা বার্ষিক বক্তৃতামালার আয়োজন করিতেছিলাম। ভাবিয়াছিলাম কোন এক বছর একটা বক্তৃতা হয়ত তারেক মাসুদও দিবেন। আমরা ভাবিলাম এক কিন্তু খোদা করিলেন আর।

তারপরও আজ আমি বলিব ঢাকা শহরে তারেক মাসুদ নাই বলিয়া এই শহর বসবাসের আরো অযোগ্য মনে হইতেছে।

 

প্রথম প্রকাশ: বিডিনিউজ২৪.কম, ১৫ আগস্ট ২০১১
পরিমার্জিত সংস্করণ: সলিমুল্লাহ খান, প্রার্থনা (ঢাকা: মধুপোক, ২০১৯), পৃ. ৪৯-৫৫।
‘প্রার্থনা’ বইটি সংগ্রহ করতে অনলাইনে অর্ডার করুন: https://www.rokomari.com/book/180641/prarthona–jatiyo-sahityo–2nd-part

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *