অনুবাদ · কবিতা

পারির পিত্ত: পুনশ্চ ছয় পদ্য

Spread the love

মুখবন্ধ

আজ শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭) প্রণীত ‘পারির পিত্ত’ কাব্যগ্রন্থের আরও ছয়টি গদ্য-কবিতা বা গদ্যপদ্য (১৩-১৮) লইয়া তৃতীয় কিস্তি প্রকাশিত হইল। বিষয়বস্তু বিচারে এই কিস্তির কবিতাগুলি দুই প্রকারের। প্রথম তিন কবিতায় (১৩-১৫) বোদলেয়ারের জগদ্দৃষ্টি সম্যক ধরা পড়িয়াছে। আমাদের দেশে—এবং বলা বাহুল্য অন্যান্য দেশেও— বোদলেয়ারের যে প্রতিকৃতি অধিক প্রচরিত তাহার সহিত এই তিনটি কবিতায় প্রতিফলিত প্রতিকৃতির বড় একটা মিল পাওয়া যাইবে না। তাঁহার আমূল মানবপ্রীতি এখানে পাওয়া পরিচ্ছন্ন রূপরেখার মধ্যে আঁকা সম্ভব।

একটি কবিতায় তিনি নিঃসঙ্গ এক বিধবার জীবনের একটি দিন অল্পকথায় বিবৃত করিয়াছেন। তিনি দেখাইয়াছেন, শোকের মধ্যেই থাকুন কিংবা নাই থাকুন, বিধবাদের চিনিয়া লওয়া সহজেই সম্ভব। কিভাবে? কারণ, “শোকের দিনেও গরিব মানুষের জীবনে কিছু না কিছু একটার অভাব লাগিয়াই থাকে, বসনে-ভূষণে সুষমার অভাবে শোকটা আরও করুণ দেখায়। দুঃখের উপর খরচ বাঁচাইয়া চলার ঘাটাও সহিতে হয়।”

‘বৃদ্ধ খেলারাম’ কবিতায় তিনি দারিদ্রের অঙ্গাঙ্গি বিষণ্নতা বিশ্লেষণ করিয়াছেন এইভাবে: “এইমাত্র একজন বয়োবৃদ্ধ জ্ঞানতাপসের ছবি দেখিলাম যিনি একদা বিশাল প্রতিভার দ্যুতি ছড়াইয়া গোটা যে পুরুষটার মনোরঞ্জন করিয়াছিলেন বয়সে তাহাদের ছাড়াইয়া গিয়াছেন; দেখিলাম বৃদ্ধ এক কবিকে যাঁহার বন্ধু-বান্ধব নাই, পরিবার-পরিজন অথবা সন্তান-সন্ততি নাই; দারিদ্র আর জনসাধারণের অকৃতজ্ঞতা যাঁহাকে পথে বসাইয়াছে, উদাসীন দুনিয়া যাঁহার তাঁবুতে আর পা ফেলিতে চাহে না।”

‘পিঠা’ কবিতার বয়ান যুগপদ করুণ ও ব্যঙ্গাত্মক। এখানে প্রকৃতি লইয়া যাঁহাদের ব্যসন তাঁহাদের উপর একহাত লইয়াছেন বোদলেয়ার। প্রকৃতির আড়ালে লুকাইয়া আছে দ্বিতীয় প্রকৃতি। এই দ্বিতীয় প্রকৃতি কম সত্য নয়: “এমন আশ্চর্য দেশও তাহা হইলে আছে যে দেশে রুটিকে বলে পিঠা; আর এই সুখাদ্যটি এতই দুর্লভ যে সাক্ষাৎ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ শুরু করিতে আর কিছুর দরকার পড়ে না।”

এই কিস্তির বাকি তিন কবিতার (১৬-১৮) মধ্যে প্রেমের অনিবার্য অনুষঙ্গেও প্রকৃতিপূজার একটা শ্রাদ্ধ হইয়াছে। ‘ঘড়ি’ কবিতায় বোদলেয়ার উপকথার অবতারণা করিয়া উপসংহারে জানাইয়াছেন উপকথাটি ছলনা বৈ নহে। তো তিনি ইহার অবতারণা করিলেন কেন? উত্তর এই মতো: “ওহে ভদ্রমহোদয়া! এই প্রাণমাতানো ছলটার ধরন আপনারই মতন ছেনাল নহে কি? হক কথা বলিতে কি, এই অহেতুক ছলনার জালটি বুনিতে আমি এতই আনন্দ পাইয়াছি যে ইহার বিনিময়ে আপনার সকাশ কোন মূল্যই দাবি করিব না।” ‘অলকদামে গোলার্ধ’ কবিতার ঝোঁকও একই দিকে। বোদলেয়ারের রূপক ক্ষুধা এখানে প্রেমের সঙ্গে অভেদ হইয়াছে: “তোমার মসৃণ আর অবাধ্য অলকদাম যখন চিবাইতে থাকি তখন মনে হয় আমি যেন স্মৃতি আহার করিতেছি।”

তথাকথিত বাস্তববাদীদের বালখিল্যতা বোদলেয়ারের দৃষ্টিতে হাস্যকর। ‘সফরের নিমন্ত্রণ’ কবিতায় তাঁহার উক্তি বিচারের প্রমাণ: “ধনদৌলতে ভরপুর বড় বড় জাহাজ এই সকলের উপর দিয়া চলাচল করে, যাহাদের মধ্য হইতে ভাসিয়া আসে নাবিকজনের একঘেয়ে গান, এসব তো আমারই ভাবনা, তোমার বুকে ঘুমাইয়া পড়ে আর ভাসিয়া চলে। তুমি যখন সন্তপর্ণে অনন্তকালের মহাসাগরে ইহাদের বাহিয়া লইয়া যাও তখন তোমার আত্মার নির্মল রূপের ভিতর আকাশের গভীর দেশ দেখা যায়;—আর যখন মহাসাগরের দুলুনিতে ক্লান্ত আর প্রাচ্যের পণ্যসম্ভারে ভারি জাহাজবহর স্বদেশের বন্দরে নোঙর করে তখন তাহারা আমারই ভাবনা, অনন্তের ঐশ্বর্যশোভিত হইয়া তোমার কাছে ফেরে।”

আগের দুই কিস্তির মতো এই কিস্তির কবিতাগুলিও লওয়া হইল ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত দুই খণ্ড বোদলেয়ার রচনাবলীর প্রথম খণ্ড হইতে। এই রচনাবলী সম্পাদনা করিয়াছেন ক্লদ পিশোয়া।

৬ এপ্রিল ২০২২

দোহাই

Charles Baudelaire, Oeuvres complètes, I, texte établi, présenté et annoté par Claude Pichois (Paris: Éditions Gallimard, 1975), pp. 292-303.

১৩

বিধবা

হ্বোবনার্গ বলিয়াছেন, সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত উদ্যানাদির মধ্যে কিছু কিছু অলিগলি থাকে যেখানে আনাগোনা করেন প্রধানত বঞ্চিত উচ্চাশা, করেন অসুখী আবিষ্কারক, করেন হৃতগৌরব, করেন ভগ্নহৃদয়, করেন সেইসব উথাল-পাতাল, হাল ছাড়িয়া দেওয়া, আত্মা যাঁহাদের প্রাণে ঝড়ের শেষ গোঙানির আওয়াজ এখনও শোনা যায়; আর যাঁহারা হাসিখুশি ও নিষ্কর্মা লোকজনের কোপদৃষ্টি হইতে দূরে থাকেন। এইসব ছায়াঢাকা নিবিড়কুঞ্জ জীবনযুদ্ধে হারিয়া যাওয়া লোকজনের তীর্থস্থান।

এই জাতীয় জায়গা তাক করিয়াই তো কবি আর দার্শনিক সোৎসাহে কল্পনার দৃষ্টিমুখ স্থির করেন। এই দুনিয়ায় যদি কোন জমি থাকে যেখানে পা ফেলিতে তাঁহাদের রুচি হয় না, একটু আগেই বলিতেছিলাম, সে আর কোথায়ও নয় শুদ্ধ ধনিক শ্রেণীর ফুর্তিবাজির জায়গায়। এই সকল শূন্যগর্ভ জায়গার হৈহৈ কাণ্ড রৈরৈ ব্যাপারের মধ্যে তাহাঁদের আকৃষ্ট করিবে এমন কোন বস্তু নাই। তাঁহাদের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বরং যাহা কিছু দুর্বল, বিধ্বস্ত, আক্রান্ত, অনাথ তাহার জন্য।

অভিজ্ঞ চক্ষু কদাচ ভুল করে না। এই সকল নিদারুণ কি অবনত চেহারায়, এইসব কোটরে বসিয়া যাওয়া কিংবা সংগ্রামের শেষশিখা-জ্বলজ্বল চোখে, এইসব গহন ও গণনাতীত বলিরেখায়, এইসব সুধীর কি সজোর ধাক্কা খাওয়া চলনে সে পলকেই বুঝিয়া লয় অগণিত ব্যর্থপ্রেমের, প্রত্যাখ্যাত নিবেদনের, নিস্ফল সাধনার, অসহায় এবং মুখ-বুজিয়া-সহা ক্ষুধা আর ঠাণ্ডার কাহিনী।

আপনি কি কখনো এইসব নিঃসঙ্গ বেঞ্চিতে বসা বিধবাদের, দরিদ্র বিধবাদের, দেখিয়াছেন? শোকের মধ্যেই থাকুন কিংবা নাই থাকুন, তাঁহাদের চিনিয়া লওয়া সহজেই সম্ভব। তাহা ছাড়া শোকের দিনেও গরিব মানুষের জীবনে কিছু না কিছু একটার অভাব লাগিয়াই থাকে, বসনে-ভূষণে সুষমার অভাবে শোকটা আরও করুণ দেখায়। দুঃখের উপর খরচ বাঁচাইয়া চলার ঘাটাও সহিতে হয়। ধনীরা নিজেদের দুঃখও জাঁকের সহিত যাপন করিতে পারেন।

কোন বিধবাটি তুলনায় বেশি বিষাদাচ্ছন্ন আর অধিক দৃষ্টিগ্রাহ্য, যে বিধবার হাতে একটি শিশু ধরা যে শিশুকে তিনি আপনার স্বপ্নসাধের কথা বলিতে পারেন না, না সেই বিধবা যিনি একান্তই একা? আমি জানি না…। আমি একবার বেশ কয়েকঘণ্টা ধরিয়া এ ধরনের দুঃখভারাক্রান্ত এক বৃদ্ধার পিছু পিছু গিয়াছিলাম; দৃঢ়কায়, খাড়া চেহারার এই ভদ্রমহিলা গায়ে দিয়াছিলেন পুরাতন একটা শাল আর মোট চালচলনে ফুটিয়া উঠিয়াছিল স্তোয়াবি দার্শনিকদের মতন একটা গরিমা।

মনে হইল, এই পরম নিঃসঙ্গতার সুবাদে তিনি বয়োবৃদ্ধা চিরকুমারীর জীবনে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন আর তাঁহার চালচলনে পুরুষালি ভাবের কারণে সাধিত কৃচ্ছ্রতার সহিত ঝাঁঝালো রহস্যের ভাবও একটা জুড়িয়া গিয়াছিল। দুপুরের খাবারটা তিনি কোন পাইচ হোটেলে কিংবা আদৌ কিছু খাইয়া সারিয়াছিলেন কিনা জানি না। তাঁহার পিছু পিছু একটা পাঠাগার পর্যন্ত গেলাম আর দেখিলাম অনেকক্ষণ ধরিয়া চঞ্চল চোখে—যে চোখ একদা অশ্রুতে পুড়িয়াছিল— তিনি পত্র-পত্রিকার পাতা ঘাঁটিয়া তরতাজা আর একান্ত আনন্দদায়ক খবরাখবর খুঁজিতেছেন।

শেষ পর্যন্ত, বিকাল নাগাদ, মনোজ্ঞ শারদীয় আকাশের ছায়ায়, যখন অনুতাপ-অনুশোচনা আর স্মৃতি ভিড় করিয়া নামে, তিনি এক উদ্যানে—যেখানে পারির সর্বসাধারণ সামরিক বাদ্যদলের গানবাজনা শুনিয়া তৃপ্তিলাভ করেন—এক বাদকদলের গান শুনিবার আশায় একটা পৃথক আসনে বসিয়া পড়িলেন।

এই অনভিজ্ঞ বৃদ্ধার (কিংবা পরিশোধিত বৃদ্ধার) জীবনে এই বসাটা ছিল নিঃসন্দেহে যৎসামান্য জীবনানন্দ উপভোগের সুযোগ, হয়তো—অনেক অনেক বছর ধরিয়া—বন্ধুবান্ধবহীন, কথাবার্তাবিহীন, সুখস্বাচ্ছন্দ্যহীন, সহচরবিহীন, বছরে খোদার তিনশত পঁয়ষট্টি দিন, ভারবাহী দুঃখের জীবন কাটাইবার মূল্যে উপার্জিত সান্ত¡নাবিশেষ।

আরো একজন:

যে হতভাগ্য জনতা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সঙ্গীতানুষ্ঠানের বহিঃসীমার বেড়া ঘিরিয়া ভিড় জমান তাহাদের দিকে—সর্বজনীন সহানুভ‚তিতে না হোক, কমসে কম কৌতুহলের সহিত—একবার দৃকপাত না করিয়া পারি না আমি। রাতের বাতাসে কোন উৎসবের, কোন বিজয়ের, কি কোন ইন্দ্রিয়সুখের ধ্বনি সমবেতকণ্ঠে ভাসিয়া আসে। এলাইয়া পড়ে ঝলোমলো পোশাকের ঢল; চোখ ছানাবড় হইতেই থাকে; করিবার মতো বিশেষ কিছু নাই বলিয়া অকর্ম্মণ্যের দল আড়মোড়া ভাঙে, উদাসীন ভাব ধরিয়া সঙ্গীত সমজদারির ভান করে। এই জায়গায় ধনদৌলতের আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রদর্শনী ছাড়া আর কিছুই নাই; শ্বাস-প্রশ্বাসে চিন্তালেশহীন মনোভাবের আর ইন্দ্রিয়পরায়ণতার স্পর্শ পাওয়া যায় না এমন কিছুই নাই; কিছুই নাই; একমাত্র ব্যতিক্রম শুদ্ধ বহিঃসীমার বেড়া ঘেঁষিয়া যে হতভাগ্যের দল দাঁড়াইয়া তাহাদের দৃশ্যটা—বায়ুপ্রবাহের অনুগ্রহে তাহারা দুই-চারিটি সুরের রেশ বিনামূল্যে শুনিতেছেন আর ভিতরের উজ্জ্বল ঝিকিমিকির দৌলতটা দেখিতেছেন।

ধনিক শ্রেণীর আমোদ-প্রমোদ গরিব মানুষের চোখে বিম্বিত হইতে দেখিলে সবসময়ই ভালো লাগার কথা। কিন্তু সেদিন ঐসব লম্বা লম্বা জামা পরা আর আপাদমস্তক একজোব্বা ঢাকা লোকজনের ভিড়ে এমন একজনের দেখা পাইলাম চারিপাশের তুচ্ছ পরিবেশের সহিত যাঁহার এই আশরাফ মেজাজ একেবারেই মানায় না।

দেখিলাম উঁচালম্বা, মহিয়সী একজন ভদ্রমহিলা—আদ্যোপান্ত অঙ্গসৌষ্ঠব বিবেচনায় যাঁহার সমকক্ষ কাহাকেও অতীতযুগের শ্রেষ্ঠ অভিজাত সুন্দরীমহলে দেখিয়াছি মনে হইল না। তাঁহার সমগ্র অভিব্যক্তি হইতে বীর্যবত্তার গৌরবমণ্ডিত একটা সৌরভ ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। চেহারাটা বিষণ্ন ও শীর্ণ, আর গায়ে চড়ানো শোকের পোশাকটা তাহার সহিত সম্পূর্ণ মানাইয়া গিয়াছে। যে জনতার মধ্যে তিনি মিশিয়া গিয়াছেন তাহার দিকে আদৌ দৃকপাত না করিয়া অন্দরের আলোঝলমল জগতপানে নিবিড় তাকাইয়া ছিলেন তিনি আর ক্ষণে ক্ষণে—সঙ্গীতের তালে তালে—মাথা ঝাঁকাইতেছিলেন।

তুলনাহীন দৃশ্য! আমি মনে মনে বলিয়া উঠিলাম, “এই জাতীয় দারিদ্রে—দারিদ্রই যদি বলি ইহাকে—কঠোর ব্যয়সংকোচ করিতে হইবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই; এমন আশরাফ চেহারা দেখিলে তো তাহাই মনে হয়। তো যে পরিবেশে তাঁহাকে এমনই দৃষ্টিকটু, এমনই বেমানান মনে হয় সেই পরিবেশটা তাঁহার পছন্দ হইল কেন?”

অবশ্য কৌতুহলবশত তাঁহার পাশ ঘেঁষিয়া যাইবার সময় আমার মনে হইল কারণটা আমি ঠাহর করিতে পারিয়াছি। তাঁহার হাতে ধরা একটি শিশু; তাঁহার মতন সেও কালোপোশাক পরা। প্রবেশমূল্যটা সাধ্যের মধ্যে হইলেও তাহাতে হয়তো এই ছোটনের কিছু একটা নিত্যপ্রয়োজনের কিংবা—আরো ভালো কথা—কোন বিনোদনের, খেলনাপাতির সংস্থান হইবে।

আর তিনি বাড়ি ফিরিবেন পায়ে হাঁটিয়া, ভাবিতে ভাবিতে, কল্পনায় ভাসিতে ভাসিতে, একাকী, সদা একাকী; কারণ শিশুরা সদা হৈচৈ লইয়া ব্যস্ত, তাহারা স্বার্থপর, তাহাদের না আছে ভদ্রতা, না আছে ধৈর্য; আপনকার একান্ত দুঃখের দিনে কোন সামান্য প্রাণীর সহিত—কুকুর কিংবা বিড়ালের সহিতও—যেটুকু মনের কথা বলা চলে শিশুদের সঙ্গে তাহাও চলে না।

১৪

বৃদ্ধ খেলারাম

ছুটির দিনে লোকজন চারিদিকে ছুটিতেছে, ছড়াইয়া পড়িতেছে, আনন্দে মাতোয়ারা হইতেছে। এমন উৎসবের দিনের জন্য বছরব্যাপী মন্দার ক্ষতিটা পোষাইয়া লইবার আশায় খেলোয়াড়, বাজিকর, চিড়িয়া ব্যবসায়ী আর ঠেলাওয়ালা দোকানদারেরা অনেকদিন ধরিয়া অপেক্ষায় থাকেন।

এমন দিনে মানুষ মনে হয় সবকিছুই ভুলিয়া যায়, ভুলিয়া যায় দুঃখকষ্ট আর পরিশ্রমের কথা; তাহারা শিশুর মতন হইয়া যায়। ছোটদের দৃষ্টিতে দিনটা ছুটির, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পাঠশালার ভয়ভীতিটা দূরে সরাইয়া রাখার। বড়দের চোখে দিনটা জীবনের অশুভশক্তির সহিত যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছিবার, বিশ্বজনীন সংঘাত-সংঘর্ষ হইতে খানিক ফুরসৎ পাইবার।

একান্ত সংসারী মানুষের দল আর কর্মব্যস্ত ধর্মপ্রাণ সাধকেরাও সর্বসাধারণের এই আনন্দ-উৎসব একেবারে এড়াইতে পারেন না। ইচ্ছা না হইলেও ভাবলেশহীন এই পরিবেশটাকে তাঁহারা নিজেদের মতো করিয়া কবুল করিয়া থাকেন। আমার কথা বলিতে—খাঁটি পারিওয়ালা আমি—এই উৎসবের দিন যত তাঁবু পড়ে তাহার সব না দেখিয়া কদাচ ছাড়ি না।

সত্য বলিতে, তাহাদের মধ্যে সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা লাগিয়া যায়: তাহারা চিল্লাচিল্লি করেন, বাঁশি-ভেঁপু ইত্যাদি বাজান, হাউমাউ করেন। চেঁচামেচির, তামা-পিতলে টোকাটুকির আর আতশবাজির বিস্ফোরণের আওয়াজ একাকার হইয়া যায়। লালঝুঁটি আর সঙের দল বাতাসে, বৃষ্টিতে আর রোদে সৃষ্ট বলিরেখা পড়া রোদেপোড়া মুখ বিকৃত করিয়া ভেংচি কাটিতেছিলেন; মলিয়েরতুল্য নিশ্চিত নিখাদ আর অব্যর্থ ফললাভে বিশ্বাসী অভিনেতারা নানাপ্রকার রঙ্গ-রসিকতা আর ব্যঙ্গ-কৌতুক ছুঁড়িয়া মারিতেছিলেন।

আপনাপন অঙ্গের বিশালতায় গর্বিত ওরাংওটাংসদৃশ পাহলোয়ানের দল—যাহাদের না আছে কপাল, না আছে চোয়াল—এ দিনের জন্য ধোলাই করা পুরাতন গায়ে-লেপ্টানো জামা চড়াইয়া বীরদর্পে মঞ্চ মাতাইতেছিলেন। ঝাড়বাতির নীচে ডিগবাজি আর লাফঝাপ দেওয়া পরীকন্যা কি রাজকুমারিতুল্যা রূপসী নাচুনিদের পরণের ঝকঝকে ঘাগরা বাতির আলোতে ঝিকমিক করিতেছিল।

সবখানেই শুদ্ধমাত্র আলো, ধুলো, চেঁচামেচি, মজা, হৈচৈ: কেহ খরচা করিতেছিলেন, অন্যরা কামাই-উপার্জন করিতেছিলেন; ইহারা আর উহারা সকলেই সমান মজা লুটিতেছিলেন। ছোট্ট শিশুরা কাঠি-লজেন্সের দাবিতে মামনিদের ঘাগরা ধরিয়া ঝুলিতেছিল; কিংবা বাবাদের কাঁধে উঠিতেছিল দেবদুর্লভ চেহারাওয়ালা কোন যাদুকরের মুখটা আর একটু ভাল করিয়া দেখিবে বলিয়া। আর সকল সুগন্ধি ছাপাইয়া একটা ভাজার গন্ধ—যাহা এই মেলার বিশিষ্ট সৌরভ—চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল।

দেখিতে পাইলাম এক কোণায়, একসারি তাঁবুর একেবারে শেষমাথায়, যেন বা লজ্জায় কুঁকড়াইয়া এই সমস্ত জাঁকজমক হইতে দূরে নির্বাসনে এক বৃদ্ধ খেলারাম, মাথা ঝোঁকাইয়া, ভাঙাচোরা চেহারায়, জীর্ণশীর্ণ, মানুষের হাড়গোড় হইয়া—একান্ত নির্বোধ বন্য মানুষের ঝুপড়ির চেয়েও জরাজীর্ণ ঝুপড়ির মতো তাঁবুটার খুঁটি ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া—আর সেখানে দুইটি মোমবাতির গলিত মাথা ধুমায়িত হইতে হইতে ঝুপড়িটার দারিদ্র বড় বেশি আলোকিত করিতেছিল।

চারিদিকে মজা, মুনাফা, ভোগ; চারিদিকে আগামীকালের রুটিরুজির নিশ্চয়; চারিদিকে জীবনাবেগের বেপরোয়া বিস্ফোরণ। এখানে চরম দারিদ্র, ভয়াবহ দারিদ্র চূড়ান্ত করিবার জন্য হাস্যকর ছিন্নবস্ত্রে ঢাকা হইয়াছিল—শিল্পের প্রয়োজনে নয়, প্রয়োজনের দায়ে এই বৈপরীত্য। তিনি—হতভাগা বেচারা—হাসেন না! তিনি কাঁদেন না, তিনি নাচেন না, তিনি অঙ্গভঙ্গি করেন না, তিনি ডাক পাড়েন না; তিনি গান গাহেন না, না হাসিখুশি না শোকাচ্ছন্ন তিনি আকুতি জানান না। তিনি নির্বাক আর নিশ্চল। তিনি পরিত্যাগ করিয়াছেন, তিনি বিসর্জন করিয়াছেন। তাহার ভাগ্য নির্ধারিত হইয়া গিয়াছে।

কিন্তু লোকারণ্যে আর আলোকমালার দিকে কি গভীর আর কি অবিস্মরণীয় দৃষ্টিই না তিনি নিক্ষেপ করিতেছিলেন, এই চলমান লোকারণ্য তাহার এই চরম দারিদ্রের কয়েক কদম দূরে থাকিতেই থামিয়াছে! আমার মনে হইল গর্ভসূতিকার ভয়ানক হাত আমার গলাটা চাপিয়া ধরিয়াছে, আর পড়ি পড়ি করিয়াও পড়িতে না চাওয়া অশ্রু জমিয়া আমার দৃষ্টিটা ঝাপসা করিয়া তুলিয়াছে।

এখন আমি কি করি? এই অভাগাকে কোন কোন কৌতুহল তিনি নিবৃত্ত করিয়া থাকেন জিজ্ঞাসা করিয়া কি কোন কাজ হইবে? কি কি আজব খেলা তিনি দেখাইতে পারেন এই বিবমিষা জাগানিয়া বিষণ্ন পরিবেশে, এই ছেঁড়াখোড়া পর্দার আড়ালে? সত্য বলিতে, আমার সাহস হয় নাই; আর আমার এই ভয়কাতরতার কারণটা আপনাদের হাসির উদ্রেকও করিতে পারে, তবু কবুল করিয়া বলিব ভয় হইয়াছিল পাছে জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার অপমান করি। যাহাই হোক, স্থির করিলাম, পাশ কাটিয়া যাইবার সময় তাহার তক্তা কয়টির একটির উপর কিছু টাকা ফেলিব। আশা: তিনি আমার উদ্দেশ্যটা বুঝিবেন; এমন সময়ে একটা কিছু গোলমালের কারণে লোকারণ্য হঠাৎ সামনে আছড়াইয়া পড়িয়া আমাকে তাহার কাছ হইতে কিছু দূরে ঠেলিয়া দিল।

আর এই দৃশ্যে আচ্ছন্ন আমি বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে আমাকে পাওয়া এই হঠাৎ বিষণ্নতা বিশ্লেষণ করিবার কোশেস করিলাম, নিজেই নিজেকে বলিলাম, এইমাত্র একজন বয়োবৃদ্ধ জ্ঞানতাপসের ছবি দেখিলাম যিনি একদা বিশাল প্রতিভার দ্যুতি ছড়াইয়া গোটা যে পুরুষটার মনোরঞ্জন করিয়াছিলেন বয়সে তাহাদের ছাড়াইয়া গিয়াছেন; দেখিলাম বৃদ্ধ এক কবিকে যাঁহার বন্ধু-বান্ধব নাই, পরিবার-পরিজন অথবা সন্তান-সন্ততি নাই; দারিদ্র আর জনসাধারণের অকৃতজ্ঞতা যাঁহাকে পথে বসাইয়াছে, উদাসীন দুনিয়া যাঁহার তাঁবুতে আর পা ফেলিতে চাহে না।

১৫

পিঠা

বেড়াইতে গিয়াছিলাম। যে প্রাকৃতির দৃশ্যের মধ্যে গিয়া পড়িলাম ঐশ্বর্যে আর মহিমায় তাহা ছিল অপ্রতিরোধ্য। সন্দেহ নাই, তাহার কিছুটা ঐ সময় আমার প্রাণেমনেও ঢুকিয়া পড়িয়াছিল। এই ফুরফুরে পরিবেশে আমার ভাবনাচিন্তাও নাচানাচি করিতেছিল; মনে হইল এই দুনিয়ার ঘৃণাবিদ্বেষ আর প্রেম-ভালোবাসার মতো দৈনন্দিন আবেগ-অনুভূতি যেন দূর হইয়াছে; মনে হইল আমার প্রাণমন যেন আমার পায়ের তলার গহ্বরের তলদেশে চলিষ্ণু মেঘের মিছিলের মতো, আকাশের যে গম্বুজটা আমাকে ঢাকিয়া রাখিয়াছে তাহার মতো বিশাল আর বিশুদ্ধ হইয়াছে; দুনিয়াবি কর্মকাণ্ডের স্মৃতি মনে জাগিলেও দূরে, বহুদূরে, আরেকটি পাহাড়ের সানুদেশে সঞ্চরণরত কয়টি পশুর গলায় ঝোলানো ঘণ্টাধ্বনি যেমন ক্ষীণ শোনাইতেছিল তেমন দুর্বল আর ক্ষীণ হইয়া গিয়াছিল। ছোট্ট অচঞ্চল—আর অপরিসীম গভীরতার সুবাদে কালো—হ্রদের আকাশে মাঝেমধ্যে এপার-ওপার উড়িয়া চলা বায়বীয় দৈত্যের আলখাল্লার প্রতিফলন মনে হয় এমন এক মেঘের ছায়া চলিয়া গেল। মনে পড়িল বিলকুল নীরব, বিশাল সঞ্চরণে সৃষ্ট এই গম্ভীর ও বিরল অনুভূতি একটা ভয়মিশ্রিত আনন্দে মনটা আমার ভরাইয়া ফেলিল। সংক্ষেপে বলিতে, মনে হইল চারিদিককার এই উদ্দীপনাময় রূপের দৌলতে আমি নিজের সঙ্গে আর নিখিলের সঙ্গে একটা সর্বাঙ্গীন শান্তিতে উপনীত হইলাম; এই সর্বাত্মক প্রশান্তির মধ্যে আর যাবত দুনিয়াবি অশুভের কথা আদ্যোপান্ত ভুলিতে পারিয়া, আমার বিশ্বাস, আমি একটা উপলব্ধিতে পৌঁছিলাম: মানুষ সাধু হইয়াই জন্মায় কোন কোন কাগজের এই দাবি যত হাস্যকর মনে হয় তত হাস্যকর নয়; ইতিমধ্যে চিকিৎসার অতীত বস্তুজগত আপনকার দাবিটা নবায়ন করিয়া লইল, আমি ক্লান্তি দূর করিতে আর এতখানি উপরে উঠিবার ফলে লাগা ক্ষুধার একটা হিল্লা করিতে মনস্থ করিলাম। পকেটে হাত দিয়া রুটির বড় একটা টুকরা, একটা চামড়ার পেয়ালা আর সে যুগে ওষুধওয়ালারা মাঝেমধ্যে বরফজল মিশাইয়া খাইবার জন্য যে অমৃত মুসাফিরদের কাছে বিক্রয় করিতেন সেই বিশেষ অমৃতের শিশিটা বাহির করিলাম।

আমি প্রশান্তমনে আমার রুটিটা কাটিতে লাগিয়াছি, এমন সময় মৃদু একটা শব্দ হওয়ায় মুখ তুলিয়া তাকাইলাম। দেখি আমার সামনে দাঁড়াইয়া ছোটখাট এক জীব, এবড়োথেবড়ো, কৃষ্ণ, উসকোখুসকো চেহারা, কোটরে বসিয়া যাওয়া রক্তমাখা আর সকাতর চোখে রুটির টুকরাটা গিলিতেছে। চাপা আর ভাঙ্গাগলায় ঝরিয়া পড়া এই শব্দটি শুনিতে পাইলাম: পিঠা।

যে নামে ডাকিয়া আমার চৌদ্দ আনা শাদা রুটিটাকে সে সম্মান জ্ঞাপন করিতে প্রয়াস পাইল তাহা শুনিয়া না হাসিয়া পারিলাম না আমি, তাহার জন্য রুটির ভালোমতো একটা টুকরা কাটিলাম আর তাহাকে দিলাম। ধীরে ধীরে, সাধের জিনিশটা মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টির আড়াল না করিয়া, সে কাছে আসিল; তারপর টুকরাটা ছোঁ মারিয়া হাতে লইবা মাত্র পিছু হটিল যেন বা তাহার ভয় আমি খুব একটা দিল খুলিয়া জিনিশটা দিই নাই কিংবা দিয়াই সঙ্গে সঙ্গে পস্তাইতেছি।

এদিকে সঙ্গে সঙ্গে কে জানে কোথায় হইতে আরেক ছোটখাট বন্য আসিয়া তাহাকে শোয়াইয়া ফেলিল; আর এইটিও দেখিতে এমন হুবহু প্রথমটির মতন যে তাহাকে প্রথমের যমজ ভ্রাতা মনে করা চলিত। মহামূল্য শিকার লইয়া কাড়াকাড়ি করিতে করিতে দুইজনে একযোগে মাটিতে গড়াগড়ি খাইতেছিল; সন্দেহ কি, অর্ধেকটা ভাইকে দিতে দুইয়ের একজনও রাজি ছিল না।

প্রথমটি—হয়রান হইয়া—দ্বিতীয়ের চুল মুঠি করিয়া ধরিল; সে দাঁতে তাহার কান কামড়াইয়া ধরিল, আর গ্রাম্যভাষায় চমৎকার একপ্রস্ত গালির সঙ্গে রক্তমাখা ছোট্ট একটা মাংসের টুকরাযোগে থুতু ফেলিল। পিঠার আইনসম্মত মালিক আপনকার ক্ষুদে ক্ষুদে নখ জবরদখলকারের চোখে ঢুকাইবার কোশেস করিল; পালাক্রমে পরের জন এক হাতে সমস্ত শক্তি জড়ো করিয়া প্রতিদ্বদ্বীর শ্বাসরোধ করার প্রয়াস পাইল, আর সঙ্গে সঙ্গে অন্য হাত দিয়া লড়াইয়ের উদ্দিষ্টটা নিজের পকেটে চালান দিতে চাহিল। কিন্তু হতাশার উত্তেজনায় নববলে বলীয়ান পরাজিতটা আবার আপন পায়ে খাড়া হইল আর বিজয়ীর উদর বরাবর মাথার এক ঘা মারিয়া তাহাকে ধরাশায়ী করিল। ইহাদের অপরিপক্ক সহ্যশক্তির কথাটা হিসাবে ধরিলে এই ভয়াবহ মারামারি যতক্ষণ চলিতে থাকিবে বলিয়া মনে করা সম্ভব তাহার ঢের বেশি চলিয়াছিল; সে বিবরণ লিখিয়া কি লাভ! পিঠাখানি একহাত হইতে আরহাতে পার হইতে আর এক পকেট ছাড়িয়া আর পকেটে যাইতে থাকিল; কিন্তু হায়! আকার-আকৃতিতেও বদলাইয়া গেল জিনিশটা; আর অবশেষে যখন, ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায়, হাঁপাইতে হাঁপাইতে, রক্তে সিঞ্চিত অবস্থায় আর চালাইয়া যাওয়া অসম্ভব হইল তখন তাহারা থামিল; ততক্ষণে, সত্য বলিতে, লড়াই করার মতন কিছুই আর অবশিষ্ট রহিল না; রুটির টুকরাটি উধাও হইয়াছে আর গুঁড়া গুঁড়া হইয়া যে বালিকণার সহিত মিশিয়াছে দেখিতে সে বালির মতন হইয়া গিয়াছে।

আমার কথা বলিতে, এই দৃশ্য প্রাকৃতিক দৃশ্যটাকে ঘোলাটে করিয়া দিল; আর এই ক্ষুদে মানুষগুলির দেখা পাইবার আগে আমার প্রাণমন যে প্রশান্তিময় স্নিগ্ধতায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিল তাহা একদম হারাইয়া গেল; বেশ কিছুক্ষণ বিষণ্ন হইয়া রহিলাম আমি। নিজেই নিজেকে বারবার বলিতে লাগিলাম: “এমন আশ্চর্য দেশও তাহা হইলে আছে যে দেশে রুটিকে বলে পিঠা; আর এই সুখাদ্যটি এতই দুর্লভ যে সাক্ষাৎ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ শুরু করিতে আর কিছুর দরকার পড়ে না।”

১৬

ঘড়ি

চীনদেশের লোকজন বিড়ালের চোখ দেখিয়া সময় কত হইয়াছে বলিতে পারে।

একদা এক ধর্মপ্রচারক, নানজিঙের উপকণ্ঠে হাঁটিতে বাহির হইয়া হঠাৎ বুঝিতে পারিলেন ঘড়িটা ফেলিয়া আসিয়াছেন, আর ছোট্ট একটা ছোড়াকে জিজ্ঞাসিলেন তখন কয়টা বাজিয়াছে।

মহাবিশ্ব সাম্রাজ্যের ছোকরা পয়লা খানিক ইতস্তত করিল; একটু পরে ভাবিয়া-চিন্তিয়া বলিল: “আচ্ছা, আপনাকে বলিতেছি”। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড়সড় একটা বিড়াল কোলে লইয়া আসিল সে, আর লোকে যেমন বলে চোখের শাদাভাগ দেখা তেমন বিড়ালের চোখে চোখ রাখিয়া বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করিয়াই বলিয়া ফেলিল: “ঠিক বারোটা বাজে নাই এখনও”। তাহার কথাটা নির্ভুল ছিল।

আমার কথা যদি বলি, মনের টানটা আমার রূপসী ‘বিড়ালিনী’র দিকে হেলিয়া থাকে—নামটি উহার যথার্থই হইয়াছে—কারণ সে যুগপদ আপনার নারীজাতির মুকুট, আমার অন্তরের অন্তস্থলের অহংকার আর আত্মার সৌরভ, কি দিবাভাগে কি রাত্রিনিশীথে, কি উজ্জ্বল আলোতে কি গাঢ় ছায়ায় তাহার আদরিণী চোখের গহনলোকে আমি সর্বদা দেখিতে পাই সময় কত হইয়াছে; সেখানে সময় সর্বদা এক, বিপুল পবিত্র সময় মহাকাশের মতন বিশাল, সময় শত শত পল আর অনুপলে ভাগ করা নয়। এই যে নিশ্চল সময় ঘড়ির গায় তাহার কাটা দাগ নাই; অথচ তাহা দীর্ঘশ্বাসের মতন হালকা, ভ্রুক্ষেপের মতন চঞ্চল।

আমি আমার এই মহানন্দময় ঘড়ির পানে তাকাইয়া আছি—এমন সময় কোন ফপর দালাল আসিয়া যদি শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায় কি কোন অসাধু, অসহিষ্ণু জিনের বাচ্চা, অতিচালাক কোন দানবের বেটা আসিয়া যদি বলে, “এত তন্ময় হইয়া কি দেখিতেছ, মিয়াঁ? এই অবলার চোখের মধ্যে কি খুঁজিতেছ? ঐখানে সময় দেখিতেছ বুঝি, হতচ্ছাড়া, অকর্মার ধাড়ি, যমের দোসর কোথাকার?” তো আমি তাহাকে এই জবাবটা দিব: “আজ্ঞে, আমি সময়টা কত দেখিতেছি; এখন বাজিতেছে অনন্তকাল!”

ওহে ভদ্রমহোদয়া! এই প্রাণমাতানো ছলটার ধরন আপনারই মতন ছেনাল নহে কি? হক কথা বলিতে কি, এই অহেতুক ছলনার জালটি বুনিতে আমি এতই আনন্দ পাইয়াছি যে ইহার বিনিময়ে আপনার সকাশ কোন মূল্যই দাবি করিব না।

১৭

অলকদামে গোলার্ধ

অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ ধরিয়া আমাকে শ্বাস টানিতে দাও তোমার অলকগুচ্ছের সৌরভে, তৃষ্ণাকাতর মানুষ যেমন আকুল হইয়া ঝর্ণাধারায় ডুব দিয়া থাকে তেমন করিয়া তাহার মধ্যে চোখমুখ ডুবাইতে দাও আর স্মৃতিকে ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য সুগন্ধিমাখা রুমালের মতো হাতে ধরিয়া নাড়াচাড়া করিতে দাও তাহাদের।

তোমার অলকগুচ্ছের অন্দরে আমি যত কিছু দেখি, যত কিছু বুঝি, যত কিছু শুনি তাহা যদি তুমি জানিতে পারিতে! আর আর মানুষের আত্মা যেমন সঙ্গীতের রাজ্যে ভ্রমণ করে আমার আত্মা তেমন ভ্রমণ করে সৌরভের রাজ্যে।

তোমার অলকগুচ্ছ ধারণ করে পালে আর মাস্তুলে পরিপূর্ণ এক স্বপ্নলোক; তাহারা ধারণ করে মহা মহা সব সমুদ্র যাহাদের মৌসুমী বায়ু আমাকে লইয়া চলে মোহন জলবায়ুর দেশে, নিসর্গ যে দেশে প্রগাঢ় নীল আর ঢের সুগভীর, যে দেশের বায়ুমণ্ডল ফলমূল, লতাপাতা আর মনুষ্যচর্মের ঘ্রাণে পরিপূর্ণ।

তোমার অলকদামের মহাসাগরে আমি দেখি কলরবমুখর এমন এক বন্দর যাহা বিষাদমাখা গানে, সকল দেশের বীর্যবন্ত নাবিকে আর চিরকাল উষ্ণতা বিলানো সুবিশাল আকাশে ছায়া ফেলা নানা প্রকারের পরিশীলিত আর জটিল নকশা অনুসারে নির্মিত বিচিত্র সব নৌযানে ভরপুর।

তোমার অলকদামে হাত বুলাইতে বুলাইতে আমি বন্দরের আলতো ঢেউয়ের দোলায় দোলায়মান অভিরাম এক নৌযানের অন্দরগাহে ফুলদানি আর শান্তিদায়ী পানির সুরাহির মাঝখানে রাখা আধশোয়া গদিতে শুইয়া অনেকক্ষণ অলস সময় কাটাইবার স্বাদ পাই।

তোমার অলকদামের আকুল উনুনে আমি পান করি আফিম আর চিনি দেওয়া তামাকের গন্ধ; তোমার অলকদামের নিশীথে দেখি বিষুবজগতের নিবিড় নীলের অগাধ ঝিকিমিকি; তোমার অলকদামের ভাঁটিতে দোদুল ঢেউয়ের দোলায় আমি মাতাল হইয়া পড়ি আলকাতরা, কস্তুরী আর নারিকেল তেলমাখা সুগন্ধে।

অনেক অনেকক্ষণ ধরিয়া আমাকে দাঁত বসাইতে দাও তোমার ঘন কালো চুলের গোছায়। তোমার মসৃণ আর অবাধ্য অলকদাম যখন চিবাইতে থাকি তখন মনে হয় আমি যেন স্মৃতি আহার করিতেছি।

১৮

সফরের নিমন্ত্রণ

সে এক পরমাশ্চর্য দেশ, যাহাকে বলে সব পেয়েছির দেশ, সে দেশে পুরানা প্রেমিকা সঙ্গে লইয়া বেড়াইতে যাইবার স্বপ্ন দেখি আমি। আমাদের দেশের উত্তরদিকে ঘন কুয়াশায় ডোবা অতুলনীয় এই দেশটার নাম হইতে পারিত পশ্চিমা দুনিয়ার পূর্বদেশ, এয়ুরোপ মহাদেশের চীন; দেশটির প্রাণের উত্তাপে আর আবেগের তাড়নায়, বিপুল ধৈর্য আর সাধনার কল্যাণে, অবাধ কল্পনার আকাশকুসুম ফোটে, দানেশমন্দ আর স্পর্শকাতর যত সবুজ গাছগাছালি গজায়।

এই সত্যকার সব পেয়েছির দেশে সকলই রূপবান, ধনাঢ্য, প্রশান্তিময়, অকপট; সেখানে বিলাসবৈভবের মধ্যে একটা পারিপাট্য; সেখানে জীবন প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ আর শ্বাসপ্রশ্বাসে সচ্ছন্দ; সেখানে নৈরাজ্যের, অস্থিরতার আর অজানা আশংকার স্থান নাই; সেখানে সুখের সঙ্গে নৈঃশব্দ্যের পরিণয়; সেখানে খোদ রন্ধনকলাও কবিতার মতন, যুগপদ বিলাসবহুল আর রসনাবিলাসী; সেখানে যাহা কিছু সকলই তোমার মতন, প্রিয়তমা আমার।

হিমশীতল দুঃখের দিনে তপ্তজ্বরের আলামত লইয়া যে বিমার দেখা দেয়, অচিনদেশের টানে যে প্রাণ কাঁদে, ঔৎসুক্যের তাড়নায় যে উৎকণ্ঠা জাগে তাহার সহিত তোমার পরিচয় আছে? এই যে এলাকাটা দেখিতে তোমার মতন, সেখানে সকলই শোভন, ধনাঢ্য, প্রশান্ত আর অকপট; সেখানে আকাশকুসুম কল্পনা পশ্চিমা দুনিয়ার চীন গড়িয়া লইয়াছে, সেখানে নিঃশ্বাস লইলে জীবন সুখকর হয়; সেখানে সুখ পরিণীত নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে। জীবনধারণের জন্য এই দেশে যাওয়া চাই; প্রাণত্যাগের জন্য এই দেশে যাওয়া চাই।

আজ্ঞে, শ্বাসপ্রশ্বাস চালাইতে, স্বপ্ন দেখিতে, সংবেদনের অনন্ত বিস্তারে সময়ক্ষেপণ করিতে যাওয়া চাই এই দেশে। এক সঙ্গীতাচার্য হ্বালৎসের নিমন্ত্রণ রচনা করিয়াছেন; সে কোন জন যিনি লিখিবেন সফরের নিমন্ত্রণ, যাহা আমাদের প্রেমপাত্রীর হাতে, আমাদের নির্বাচিত ভগিনীর হাতে উপহারস্বরূপ তুলিয়া দেওয়ার মতো হইবে?

আজ্ঞে, এই সে আবহাওয়া যাহাতে জীবনটা সুন্দর কাটাইয়া দেওয়া চলে—ঐখানে, সেখানে ধীরস্থির সময় সমধিক ভাবনাচিন্তার খোরাক যোগায়, সেখানে ঘন্টাধ্বনি সুখের সঙ্গে গভীরতর আর যথার্থ পবিত্রতার মেলবন্ধন ঘোষণা করে।

আলোঝলমল পালায়, কি সোনাবাঁধাই চামড়ায় আর নিকষ ঐশ্বর্যের পৃষ্ঠদেশে, অজস্র স্বেচ্ছায় সপ্রাণ, গাম্ভীর্যপূর্ণ, প্রশান্ত ও প্রগাঢ় চিত্রকর্ম, এইগুলি তাহাদিগের স্রষ্টা শিল্পজীবীগণের আত্মার মতন। যে অস্তাচলগামী সূর্য আহারকক্ষ কি বৈঠকখানা দারুণ জৌলুসে বর্ণময় করে সে সূর্যকে ছাঁকিয়া লয় সুন্দর সুন্দর সমস্ত কাপড়ের ঝালর কিংবা ঝুল নামাইয়া শত খণ্ডে খণ্ডিত করা উঁচু উঁচু কারুকার্যমণ্ডিত জানালা। এখানে আসবাব বড় বড় মাপের, কৌতুহলের সামগ্রী, পরমাশ্চর্য, সুশিক্ষিত মানুষের আত্মার মতন, তালাবদ্ধ দেরাজে দেরাজে গোপন কাহিনীসজ্জিত। নয়ন জুড়ানো আয়নারাজি, ধাতব পাত্রনিচয়, বস্ত্রসম্ভার, রূপার থালাবাসন আর চীনামাটির পাত্র নীরব ও রহস্যাবৃত সুরসঙ্গতির যোজনা করে, আর গোটা বস্তুজগত, ঘরের কোণাকাঞ্চি, দেরাজের ফাঁকফোকর আর কাপড়চোপড়ের ভাঁজ হইতে বাহির হয় অতুলনীয় সুবাস, সুমাত্রার জাগ্রত স্মৃতি—এই সুবাস বাড়িটির আত্মাতুল্য।

এই এক সত্যকার সব পেয়েছির দেশ, তোমাকে বলিতে চাই, সে দেশে সকলই ধনাঢ্য, যথাস্থানে স্থাপিত আর আলোকে আলোকময়, পরিষ্কার বিবেকের মতন, রান্নাঘরে একপ্রস্ত চমৎকার তৈজসের মতন, ঝকমকে সোনারূপার ছুরিকাটার মতন, বর্ণাঢ্য উজ্জ্বল গহনার মতন।

সারা দুনিয়ার ধনদৌলত সেখানে জমা হয়, যেমন হয় সারা দুনিয়ার প্রশংসাধন্য কোন কঠোর পরিশ্রমী ভদ্রলোকের বাড়িতে। সে এক অত্যাশ্চর্য দেশ, সে দেশ আর সকল দেশের ঢের উপরে, কলাশিল্প যেমন স্বপ্নের জোরে প্রকৃতির সংস্কার—প্রকৃতির সংশোধন, অলংকরণ, পুনস্থাপন করে বলিয়া প্রকৃতির ঢের উপরে থাকে।

উদ্ভিজ্জচাষী যাদুকরের দল খুঁজিতে থাকুন, বার বার খুঁজিতে থাকুন, আপনাদিগের সুখের সীমা তাঁহারা বিরতিহীন বাড়াইতে থাকুন! যিনি তাঁহাদের উচ্চাভিলাষী সব সমস্যার সমাধান বাতলাইবেন তাহার নামে তাঁহারা ষাট হাজার কি লক্ষ ফ্লোরিন পুরষ্কার ঘোষণা করুন! আমি কিন্তু আমার কালো টিউলিপ আর নীল ডালিয়া খুঁজিয়া পাইয়াছি।

অতুল ফুল, হারাইয়া আবার ফিরিয়া পাওয়া টিউলিপ, রূপকলোকের ডালিয়া, তো ঐখানে, ঐ ভারি শান্ত আর ভারি সুন্দর স্বপ্নের দেশে, ঐ দেশেই তো যাইতে হয় বাস করিতে আর সমৃদ্ধির স্বাদ লইতে, তাই না? তুমি কি তোমার আপনকার উপমার কাঠামোর মধ্যে স্থিত হইবে না, আর অতীন্দ্রিয়পন্থীরা যেমন বলেন নিজের যথাযথ প্রতিচ্ছবির মধ্যে নিজেকে দেখা তেমন দেখিতে পারিবে না?

স্বপ্নবাহার! সদা বিরাজমান স্বপ্ন! আর আত্মা যতই উচ্চাভিলাষী আর নিবিষ্ট হয়, স্বপ্ন ততই সম্ভাবনার সীমা সম্প্রসারিত করে। সকল মানবসন্তানই যে যাহার মাত্রায় নিরন্তর প্রকৃতি কর্তৃক নিঃসৃত আর নবায়িত আফিম বহন করে, এবং, জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত কতটা সময় যে আমরা প্রাণ ভরিয়া আনন্দ উপভোগে, সার্থক ও দ্বিধাহীন কর্মসম্পাদনে, কাটাই তাহার হিসাব কি রাখি আমরা! এই যে ছবি আমার মন আঁকিয়াছে, এই যে ছবি তোমার অবিকল রূপ, তাহার মধ্যে কি আমরা কখনও বসবাস করিব না, কখনো গমনাগমন করিব না তাহার মধ্যে?

এই ধনদৌলত, এই আসবাব, এই বিলাস, এই বিন্যাস, এই সমস্ত সুগন্ধি, এই অলৌকিক পুষ্পপল্লব সকল, সে তো তুমি। সে আবারও তুমি, এই যে বিশাল বিশাল সব নদী আর শান্ত-সমাহিত যত খাল-নালা।

ধনদৌলতে ভরপুর বড় বড় জাহাজ এই সকলের উপর দিয়া চলাচল করে, যাহাদের মধ্য হইতে ভাসিয়া আসে নাবিকজনের একঘেয়ে গান, এসব তো আমারই ভাবনা, তোমার বুকে ঘুমাইয়া পড়ে আর ভাসিয়া চলে। তুমি যখন সন্তর্পণে অনন্তকালের মহাসাগরে ইহাদের বাহিয়া লইয়া যাও তখন তোমার আত্মার নির্মল রূপের ভিতর আকাশের গভীর দেশ দেখা যায়;—আর যখন মহাসাগরের দুলুনিতে ক্লান্ত আর প্রাচ্যের পণ্যসম্ভারে ভারি জাহাজবহর স্বদেশের বন্দরে নোঙর করে তখন তাহারা আমারই ভাবনা, অনন্তের ঐশ্বর্যশোভিত হইয়া তোমার কাছে ফেরে।

তর্জমা: সলিমুল্লাহ খান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *