প্রবন্ধ

আদমবোমা: ২, আত্মহত্যা না সত্যাগ্রহ?

Spread the love
iraqbombingad.jpg
ভয়াবহতার ধারণা আত্মঘাতী হামলা কমাতে পারে, এ আশায় ইরাকে সম্প্রচারের জন্য আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে বিজ্ঞাপন বানানোর কাজ চলছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

‘আদমবোমা’ নামক পুস্তিকায় তালাল আসাদ তিনটি প্রস্তাব প্রচার করিয়াছেন। প্রথম প্রস্তাবে তিনি দেখাইয়াছেন পশ্চিমা সাম্রাজ্য শাসকরা যে জিনিশকে “সন্ত্রাসবাদ” বলিয়া গালি দিতেছেন তাহার সহিত তাহারা যে বস্তুকে “যুদ্ধ” বলিয়া সালাম করেন তাহার ভেদ বিশেষ নাই। সাম্রাজ্য শাসকদের বিচারে আইনসম্মত হত্যাকাণ্ডকে যুদ্ধ বলা যায় আর আইন বহির্ভূত হত্যা ইত্যাদিরই অপর নাম ‘সন্ত্রাসবাদ’। পার্থক্যটা হত্যা ও অহত্যায় নয়। বরং হত্যা ও হত্যায়। এক হত্যার উদ্দেশ্য—তাঁহারা বলেন—জীবন দান। অন্য হত্যার উদ্দেশ্য নিছক অথবা জীবননাশ।

asad.jpg

 

 

 

 

 

 

……
তালাল আসাদ
……..

কিন্তু—তালাল আসাদ দেখাইতেছেন—জীবন বা সভ্যতার সুন্দর প্রহরা দিবার উদ্দেশ্য যাঁহারা যুদ্ধ ঘোষণা করেন তাঁহারা তো তাঁহাদেরই পূর্বঘোষিত যুদ্ধের আইন—যেমন ‘জেনেভা কনভেনশন’—মানিয়া চলেন না। বলপ্রয়োগের যে সীমা আইনে বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে—যেমন যুদ্ধবন্দি নির্যাতন না করা—তাহা মানিয়া চলেন না। প্রমাণ—গুয়ানতানামো উপসাগরের মার্কিন বন্দিশিবির, প্রমাণ ইরাক, প্রমাণ আফগানিস্তান, প্রমাণ ভিয়েতনাম, প্রমাণ আলজিরিয়া। তাহা হইলে ‘মানবাধিকার আইন’ কথাটি একটি কথার কথা বৈ নহে!

book_t-a.jpgঅথচ এই শক্তিমন্ত দেশের নায়ক ও সেনানায়কগণ সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করিতেছেন। কিন্তু কোন মুখে? তাঁহারা বন্দিজনের পায়ুপথে বিদ্যুতবায়ু প্রবেশ করাইয়াও শান্তি পাইতেছেন না। বলিতেছেন সন্ত্রাসবাদ সভ্যতার অথবা মানবাধিকারের দুশমন। তালাল আসাদ চোখে আঙ্গুল ঢুকাইয়া কহিতেছেন—প্রকৃত প্রস্তাবে পশ্চিমা সভ্যতার যুক্তি হইল, সন্ত্রাসবাদ যাহারা আঁকড়াইয়া আছে তাঁহারা সভ্যতার বাহিরে বাস করিতেছে। কাজেই তাঁহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার সময় সভ্যতার আইনকানুন—যথা মানবাধিকার আইন—প্রয়োগের প্রয়োজন নাই।

১৯২৭ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর কাপ্তেন এলব্রিজ কোলাবি এক প্রসঙ্গে যাহা বলিয়াছিলেন—আসাদের মতে—তাহা আজও পাশ্চাত্য শাসক শ্রেণীসমূহের প্রকৃষ্ট আদর্শ আকারে জিয়াইয়া আছে। কোলবির কথায়:

“বন্যজাতি যুদ্ধের মূল কৌশল হিসাবে শুদ্ধ ধ্বংসসাধন ও বিলপ্তির পথই গ্রহণ করে—ঘটনার সার কথা ইহাই। যাহারা এই রকম নির্দয় পদ্ধতি বাছিয়া লয় তাহাদিগের মোকাবেলায় আমাদিগেরও নির্দয়ার পথ লইতে হইবে। অতিশয় মানবাধিকার মানবাধিকার করিয়া এই পথ হইতে সরিয়া দাঁড়ানো ঠিক হইবে না। কারণ আপনার শত্রুর সমক্ষে বেশি দয়া দেখাইতে গিয়া সেনাপতি হিসাবে আপনি তো আপনার আপন জাতির প্রতি নির্দয়তা প্রকাশ করিতেছেন মাত্র।” (আসাদ ২০০৬: ৩৪-৩৫)

পাশ্চাত্য শাসক শ্রেণীর নেতারা ‘মানবাধিকার আইন’ লঙ্ঘনের অভিযোগে অসভ্য (বা বন্য ও বর্বর) জাতির নিন্দা করেন। অদ্য তাঁহারা সভ্য জাতির দুশমন বলিয়া যাহাদের চিহ্ন দিয়াছেন তাহারা হইয়াছেন ‘সন্ত্রাসবাদী’। ইহাদেরও প্রধান দোষ ইহারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করিয়া নিরীহ মানুষ হত্যা করিতেছে। সুতরাং ইহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানবাধিকার আইন মানিয়া চলিবার কোন বাধ্যবাধকতা থাকিতে পারে কি? মানবাধিকার রক্ষা করিবার স্বার্থে মানবাধিকার ভঙ্গ করা কোন অপরাধ নয়—পাশ্চাত্য যুক্তির নিহিতার্থ যদি ইহাই হয় তাহা হইলে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীরাও যে একই যুক্তির আশ্রয় লইবেন তাহাতে আপনার বিস্ময় কেন?

এই প্রশ্ন সম্বল করিয়া তালাল আসাদ দ্বিতীয় প্রস্তাব সায়ের করিয়াছেন। এই প্রস্তাবে তাঁহার বিচারের বিষয় তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের অন্যতম প্রধান ঘটনা—খোদ আদমবোমা। কেহ কেহ ইহার নাম রাখিয়াছেন শহীদ (martyrdom) বোমা। (আসাদ ২০০৬: ৪৩)


আত্মঘাতী বা আদম বা শহীদ বোমার প্রকোপ দুনিয়ার নানাদেশে, নানা সময়ে দেখা গিয়াছে। তাহা সত্ত্বেও পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর অন্তর্গত ধুরন্ধর ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এই বোমা আবিষ্কারের কৃতিত ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দান করিতে গ্রীবা উঁচু করিয়া আছেন। ১৯৮৭ সালের পর ফিলিস্তিনের পামর জনসাধারণ এক প্রকার ঢেলাযুদ্ধ শুরু করিয়াছিলেন। এই ঢেলার অনুবাদ আমরা একদা করিয়াছিলাম ‘কংকর’ শব্দ দিয়া। আরবি জবানে এই যুদ্ধ ‘এন্তেফাদা’ বা গণজাগরণ অভিধা অর্জন করিয়াছিল। ইহার ফলাফল কী হইয়াছে তাহা সকলেই অবগত আছেন।

দোসরা এন্তেফাদা শুরু হইয়াছে ২০০০ সালের অক্টোবর মাস হইতে। প্রাচীন জেরুজালেম শহরের বনিয়াদি আল আকসা মসজিদের কর্তৃত্ব গ্রহণ করিবার অভিলাস চরিতার্থ করিতে ঐ মাসের একদিন এসরায়েল রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল আরিয়েল শ্যারন [Ariel Sharon] উস্কানিযোগে পবিত্র মসজিদে ঢুকিয়া পড়িলেন।

fathi-al-shikakai.jpg
ফতি শিকাকি

ফিলিস্তিন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতর বড় শরিক হামাস দল সেই উস্কানির স্পর্ধা আপনকার কাঁধে তুলিয়া লইল। ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারি এই দলের প্রথম ‘শহীদ’ বোমাভিযান শুরু হইলে। ইহার পর অন্যান্য দুনিয়াবি রাষ্ট্রনৈতিক দল এমনকি নির্দলীয় পামর পর্যন্ত বুকে-পিটে বোমা বাঁধিয়া এসরায়েল সীমান্তের চৌকি পার হইল। মনে রাখিতে হইবে ‘এসলামি জেহাদ’ নামা দলের স্থপতি ফতি শিকাকি (Fathi Shikaki) ১৯৮০ সালের কয়েক বৎসর পর এসরায়েলের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করিয়াছিলেন। পরাজয়ে না ডরাইয়া বীরেরা এখন বুকে বোমা বাঁধিয়া মরিতেছেন আর এসরায়েলি নাগরিক-অনাগরিক যাহাকে পাওয়া সম্ভব মারিতেছেন।

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আকাশযোগে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে আদমবোমা ফাটিবার পর দুনিয়া জুড়িয়া নতুন হৈ চৈ উঠিয়াছে। উদাহরণ দিয়া বলিব মার্কিন দার্শনিক রিচার্ড রোর্টি (Richard Rorty) রটাইয়াছেন পাশ্চাত্য জগতের কোথাও যদি সন্ত্রাসবাদীরা ঐ রকম বড় হামলা আরো একবার করিতে পারে তো পশ্চিমে এতদিন ‘গণতন্ত্র’ বলিয়া যে সামাজিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে তাহা শেষ হইয়া যাইবে। প্রমাণ, ইহার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র পামর সাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার কিছু পরিমাণ সংকোচনের শিকার হইয়াছে। সে দেশে তথাকথিত ‘দেশপ্রেম আইন’ (Patriot Act) পাশ হইয়াছে।
Richard Rorty
রিচার্ড রোর্টি (১৯৩১-২০০৭)

রিচার্ড রোর্টির উদ্বেগ শুদ্ধ তাঁহার একার হইলে কথা চলিত না। চলিতেছে কারণ ২০০১ সালের অনেক আগে হইতেই বিশেষজ্ঞ গবেষক ও প্রচারক মহলে বলা হইতেছে ‘সভ্যতার সংঘাত’ বা সভ্যতায় সভ্যতায় যুদ্ধ শুরু হইয়া গিয়াছে। তালাল আসাদ তদীয় ‘আদমবোমা’ প্রবন্ধের প্রথম প্রস্তাবে আমাদের দর্শন করাইয়াছেন প্রকৃত প্রস্তাবে প্রচারকগণ বলিতেছেন—পাশ্চাত্য সভ্যতার সহিত যাহারা কড়িবর্গাশুদ্ধ এক হইয়া মিশিতেছেন না তাহারা সভ্য হইয়া সারেন নাই। উনিশ শতকের পররাজ্যাভিলাষী বা ‘কলোনিয়াল’ যুদ্ধের আদলে তাঁহারা নতুন যুদ্ধ শুরু করিয়াছেন। এই যুদ্ধের মূল নৈতিক ভিত্তিও সেই পুরানা অজুহাতই: ‘সভ্যতা বিস্তারের স্বার্থে অসভ্যকে ধ্বংস করিতে হইবে’। আমরাও ‘পশ্চিমা সাম্রাজ্যের বর্ণপরিচয়’ প্রবন্ধে তাহার কিছু বয়ান পেশ করিয়াছি। (খান ২০০৭)

সকলেই বলিতেছেন আত্মঘাতী ওরফে আদমবোমা জিনিসটা সত্যই বড় ভয়াবহ জিনিশ। তালাল আসাদ সওয়াল করিলেন—কেন? কথাটার মধ্যে দুই সত্য লুকাইয়া আছে। এক নম্বরে, অনেকেই পাশ্চাত্য বিশেষজ্ঞাদের সুরে সুর মিলাইয়া বলিবেন, আদম বোমারুরা কেবল নিরীহ, বেসরকারি, যায় বেসামারিক লোক ধরিয়া মারিতেছে। ইহাই ভয়াবহতার গূঢ় কারণ। নিরীহ লোকহত্যা শুদ্ধ আত্মঘাতী বোমারুরাই করিতেছেন—ইহা কিন্তু সত্য নহে। এই কাজ অনেক দেশের সেনাবাহিনীও করিয়া থাকে। মহাযুদ্ধের সময় জার্মানিতে এই ঘটনা দেদার ঘটিয়াছে। জাপানের কথা না হয় বলিব না।

তাহা হইলে আত্মঘাতী অভিযান জিনিশটার বিশেষ গুণ কোনখানে? আখ্যান অনুসারে যদি বলি বলিতে হইবে যে অভিযানে শত্রুপক্ষের লোককে কি নিরীহ কি দোষী নির্বিচারে হত্যার নিমিত্ত আমি নিজেকে পর্যন্ত ধ্বংস করিয়া ফেলিতে রাজি হইয়াছি তাহাই আত্মঘাতী অভিযান বা ‘সুইসাইড অপারেশন’। তাহা হইলে আসল কথা আত্মহত্যা, নিরীহহত্যা নহে। কিন্তু ইহাতেও সমস্যা দেখিতেছি। দেশের মুক্তির জন্য, জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কত বীরই না আত্মোৎসর্গ করিয়াছেন, ইতিহাসে তাহার কতক কাহিনী লেখা হইয়াছে, কতক লেখাও হয় নাই। আমাদের দেশের ইতিহাসেও শ্রেষ্ঠ আত্মোৎসর্গকারী সৈনিকগণকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ অভিধা দেওয়া হইয়াছে। কই আমরা তো ইহাঁদের কখনও ভয়াবহ বলি নাই। বলিয়াছি কি? আর ব্যক্তিগত বা মনোগত গভীর গভীর অসুখের কারণে কত মানুষই না আত্মহত্যা করিয়া থাকেন। আমরা তাহাদিগের জন্য দুঃখ প্রকাশ করি, কেহ বা গালিও দিয়া থাকি। কিন্তু ভয়াবহ তো বলি না।

ধর্মীয় ধারায় ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’ বলা হয় বটে তবে আমাদের দেশে ইংরেজ সরকার প্রবর্তিত দণ্ডবিধি অনুসারে আত্মহত্যার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইলে শুদ্ধ এক বছরের কারাভোগ করিবার বিধান (দ্রষ্টব্য ৩০৯ ধারা) রহিয়াছে অথচ অন্যহত্যার চেষ্টা করিয়া বিফল হইলে দণ্ড কম করিয়া হইলেও ১৪ বছর।

১৮ শতকের ইতালি দেশীয় মনীষী সেসার বেকারিয়া [Cesare Beccaria] বলিয়াছেন যাহারা পরিণত বয়সে দেশত্যাগ করিয়া বিদেশে চলিয়া যান তাহাদের পাপের তুলনায় আত্মহত্যা কোন পাপই নহে। কারণ—
Cesare Beccaria

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

……..
সেসার বেকারিয়া, ১৭৩৮-১৭৯৪
……..

বেকারিয়ার ধারণা —হিজরতকারী সঙ্গে টাকা-পয়সা ধনদৌলত লইয়া যান আর তাহার নতুন দেশ যদি পুরানা দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয় তো তিনি প্রকারান্তরে শত্রুদেশের সহায়তাই করেন। অথচ আত্মঘাতী শুদ্ধ নিজের কায়াটা ছাড়া কিছুই লইয়া যাইবেন না। [He who kills himself does a less injury to society than he who quits his country for ever; to the other leaves his property behind him, but this carries with him at least a part of his substance. Besides, as the strength of society consists in the number of citizens, he who quits one nation to reside in another, becomes a double loss.] (বেকারিয়া ১৯৯২: ৭৮)

কাজেই দেখা যাইতেছে আত্মঘাতী বোমার ভয়াবহতা ঠিক আত্মঘাতে নিহিত নাই । আর—আগেই তো দেখিলাম—ইহার কারণ নিরীহহত্যায়ও নিহিত নাই। তাহা হইলে এই ভয়াবহতার কারণ কোথায় ? অন্য কোথা, অন্য কোনখানে?

আত্মঘাতী বোমা ফাটিবার পর যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়, যে প্রাণহানি ঘটে তাহা লইয়া বিশেষজ্ঞরা বিশেষ সময় ব্যয় করিবেন না। তাহারা জানিতে উৎসুক যে বা যাহারা বোমা ফাটাইল তাহার বা তাহাদের ব্রত বা মতলব [motif] কী। সকলেই জিজ্ঞাসা করেন সে কেন এই কাজ করিল? প্রশ্ন হইতেছে আত্মহত্যা—বিশেষ সফল আত্মহত্যা—শাস্তিযোগ্য অপরাধ নহে। আপনি তাহাকে কোথায় পাইবেন? অতয়েব প্রমাণ করা চাই—‘আত্মহত্যা যে করিয়াছে আত্মহত্যা সে করে নাই।’ কেহ তাহাকে দিয়া করাইয়াছে। অতয়েব তাহাদিগকে ধর, মার, কাট, পোড়াও। ইহাই বিশেষ এসরায়েল রাষ্ট্রে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চিন্তাধারা ।

ইহাতে কিন্তু আসল প্রশ্নের উত্তর মিলিল না। আত্মঘাতী অভিযানে যাইবার ইচ্ছা যাহার মনে জাগিয়াছে তাহার মনে তাহা কখন ও কীভাবে জাগিল? এই প্রশ্নের উত্তর কোনদিনই পাওয়া যাইবে না—এমন কথা তালাল আসাদ বলেন নাই। তিনি মাত্র বলিতেছেন, উত্তর পাওয়াটা সহজকর্ম নহে। এই জায়গায় দুই ঘটনার স্রোত একটি ধারায় আসিয়া মিলিয়াছে। তাই কেহ কেহ প্রশ্ন করিয়াছেন—‘লোকটি কি মারিবার জন্য মরিয়াছে না কি মরিবার জন্য মরিয়াছে?’

জঁ বেশলে (Jean Baechler) নামক জনৈক ফরাশি পণ্ডিত বুফে (Buffet) নামক একজন আততায়ীর উদাহরণযোগে বলিয়াছেন কেহ কেহ মরিবার পথ প্রশস্ত করিবার জন্য পর ধরিয়া মারে। বুফে তাহার শেষ অভিলাষ হিসাবে ফরাসি রাষ্ট্রপতি সমীপে আর্জি পাঠাইয়াছিলেন। তিনি দাবি করিয়াছিলেন তাহাকে গিয়োতিন (Guillotine) নামক তলোয়ারের নিচে মরিবার সুযোগ দেওয়া হউক। তিনি বলিতেন, ‘আমি আত্মহত্যার সুযোগ চাহিব বলিয়া পরহত্যা করিয়া থাকি। ইহাই আমার নীতিধর্ম।’ [To kill in order to commit suicide, that’s my morality!] ইহা মরিবার ফন্দিস্বরূপ মারিবার চমৎকার দৃষ্টান্ত। (আসাদ ২০০৬: ৪০)

মঁসিয়ে বেশলে আবার অন্য দৃষ্টান্তও পেশ করিতে পিছপা হয়েন নাই। ২ নম্বর মহাযুদ্ধের জমানায় জাপানের আত্মঘাতী বৈমানিকগণ (বা কামিকাজি) ইহার উল্টা করিয়াছেন। তাহারা মরিবার জন্য মরিয়াছেন। জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় ইজ্জত তাহাদের কাছে নশ্বর জীবনের তুলনায় ঈশ্বরস্বরূপ বা অবিনশ্বর। আর বুফের মতন জাত অপরাধীরা দুই পয়সার বিষ না কিনিয়া খামোকা লোকক্ষয় করিয়াছেন। প্রভেদ এই নয় কি? এইখানেও আমাদের উত্তর মিলিল না। এইখানে শুদ্ধ জানিতে পারিলাম আত্মহত্যাকারীর উদ্দেশ্য নিজেকে শেষ করা। আর আত্মঘাতী বোমারুর উদ্দেশ্য অন্যকে শেষ করা—নিজেকে শেষ করা তাহার উপায় মাত্র। প্রশ্ন থাকিল: অন্যকে শেষ করিবার ব্রত লইলেন কেন তিনি? অন্যকে শেষ করার অন্য উপায় থাকিবার পরও যদি তিনি সেই পথে ধরিয়া থাকেন তবে বলিতে হইবে তিনি সত্য সত্যই কোন মতাদর্শের—যেমন ধর্মীয় জবানের—বন্দী হইয়াছেন।

তালাল আসাদ বলিয়াছেন—পাশ্চাত্য বিশেষজ্ঞরা ইহাই প্রমাণ করিতে তৎপর। কিন্তু তাঁহাদের যুক্তিপ্রমাণ ও সাক্ষ্যসাবুদ দেখিয়া আমরা আশ্বস্ত হইতে পারিতেছি না। তাঁহারা আসলে কিছু একটা লুকাইতে চাহিতেছেন। আত্মঘাতী বোমার জন্ম মানুষের আত্মহত্যা প্রবণতায় হয় নাই, পরহত্যালিপ্সাও এই বোমার জননী নহেন। এসলাম ধর্মের মূলসূত্র ধরিয়া যতই টানাটানি করিবেন না কেন ইহার ‘মুদা’ পাইবেন না। এসলাম জীবনের সাক্ষাৎ মৃত্যুকে মহীয়ান করিয়া তুলিয়াছে বলিয়া যে প্রচার বহাল আছে তাহা—তালাল আসাদ দাবি করিতেছেন—মোটেও সত্য নহে।

তাহা হইলে—সিদ্ধান্ত হইতেছে—আদমবোমার জন্ম খোদ ইতিহাসে। আত্মঘাতী বোমা হইতেছে অসহায়ের শেষ সহায়। ভাষাহীনের শেষ ভাষা মাত্র। এসলামের হৃদপিণ্ডে বোমা নাই—বোমা বাঁধা নিছক কোমরবন্ধে।

Jon Elster
ইয়ন এলস্টার

আত্মঘাতী বোমার প্রকৃত ঠিকানা ইতিহাস। কিন্তু বিশেষজ্ঞ গোয়েন্দা না শোনে ইতিহাসের কাহিনী। যেমন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ন এলস্টার [Jon Elster] প্রচার করিতেছেন—আত্মঘাতী বোমা মারা সাময়িক উত্তেজনার কাজ। তিনি কি করিয়া জানিলেন এই সত্য? তিনি আরেকজন বিশেষজ্ঞের কাছে শুনিয়াছেন। এই বিশেষজ্ঞের নাম আরিয়েল মেরারি [Ariel Merari]। মার্কিন সিনেটে সাক্ষ্য দিবার সময় তিনি জানাইয়াছেন, “আত্মঘাতী বোমা ফাটাইবার পূর্বক্ষনে বোমারতদের কেহ কেহ খুব উল্লাস বোধ করে আর চরম মুহূর্তে কেহ কেহ পায় পরম পুলক।” (আসাদ ২০০৬: ৪১)

Ariel Merari
আরিয়েল মেরারি

সংগত কারণেই জিজ্ঞাসা করা চলে, মরিবার পূর্বসন্ধিক্ষণে বোমারু বেচারার মনে কি ছিল তাহা আপনি জানিলেন কোন পথে? আত্মঘাতীর মনের গভীর গভীর অসুখ সম্বন্ধে আগে হইতেই আপনি জানিতেন । তাহা ছাড়া নতুন খবর আর কি এখানে আছে? আত্মহত্যা মনের বিকার মাত্র এই পূর্বধারণা না থাকিলে আত্মহত্যাকারীর মনের খবর পাইয়াছি পাইয়াছি বলিয়া চীৎকার করিলে তাহা কোন অর্থই বহন করিত না।

আত্মঘাতী বোমারু মনোবিকার—পণ্ডিতেরা কল্পনা করেন—দুই প্রকার। এক নম্বরে, মাথা খারাপ হইয়া গেলেই লোকে এহেন কাণ্ডে মাতে। সকলেই বলেন না এই কথা, তবে অনেকেই বলেন। দুই নম্বরে বলা হয়, সমাজ ও সভ্যতার সহিত খাপ খাওয়াইতে অসমর্থ হইয়া কিছু লোক আত্মঘাতী বোমার ঝুড়ি বাছিয়া লইতেছে। মনে রাখিবেন এইখানে সমাজ বলিতে বুঝিতে হইবে—পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সাম্রাজ্য।

বোমা বিশারদগণ একই মুখে দুই কথা বলিতে কদাচ কসুর করেন না। একমুখে তাঁহারা বলেন—বোমারু যোদ্ধাটি খুব হিমশীতল মাথায় বোমা ফাটাইল। ইহার অর্থ নিজের উপর উহার নিয়ন্ত্রণ ষোল আনা আছে। দোসরা মুখে তাঁহারা বলিবেন—অন্য লোকে, মানে মন্ত্রণাদাতারা তাহাকে শিখাইয়া পড়াইয়া এই গর্হিত কর্মে নামাইয়াছে। যোদ্ধাটি—ইহার মানে দাঁড়াইল—খুবই উনো বুদ্ধির লোক আর তাঁহার মন্ত্রণাদাতৃমণ্ডলী ভারি দুনো লোক। তাঁহারা সাংঘাতিক, ভয়াবহ রকমের নিদয়া, নিঠুর, পাঁজি।

তালাল আসাদ প্রমাদ গণিতেছেন ইহাঁদের। ব্যাখ্যা দিবার ছলে তাঁহার শুদ্ধ নতুন সমস্যা হাজির করিতেছেন। আমাদের জ্ঞানচক্ষু মুছিয়া আসিল বলিয়া, আসাদ বলিলেন, আত্মঘাতী বোমারু বোমাবাজিতে নিজের ইচ্ছায় নামুন আর পরের সাধ্যসাধনায়ই নামুন কিছুই যাইয়া আসিতেছে না। নামাটা কাজের শর্ত [Conditions] মাত্র, ব্রত বা মতলব [motives] নহে।

কেহ কেহ বলিতেছেন আত্মঘাতী বোমাবাজি নিছক মনের ভুলে করিবার মতন কাজ নহে। ইহার জন্ম মনের শুদ্ধে বটে। কী সেই শুদ্ধ? মহাপরাক্রমশালী, অজেয় অপার শত্রুর সমক্ষে পড়িয়া—তাহার দয়ামায়াহীন যাঁতাকলে পিষ্ট হইয়া যুগপৎ নিজ ও পরকে ধ্বংস করিবার পথ ছাড়া তাহার সামনে আর কোন সড়ক থাকে না। আবার কেহ কেহ বলেন এসলাম ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষাই সমস্ত নষ্টের গোড়ায়। মাথাধোলাই করিয়া আত্মঘাতী বানাইবার কারখানারই অপর নাম এসলাম—বলিতেছেন পাশ্চাত্য বিশেষজ্ঞগণ। ফিতার ভিতর অচিন ভাষায় রেকর্ড করা বিবৃতি শুনিয়া তাঁহারা নিশ্চিত হন আত্মঘাতীর মনের প্রকৃত সত্য ধরা পড়িয়াছে। অথচ তাঁহারা ভুলিতেছেন এই মুখস্থ ভাষা আচার মাত্র।

সত্য কি আসলে তাহাই? আসাদ বলিয়াছেন—বিশেষজ্ঞদের মতলব বিশেষ করিয়া বিচার না করিলে এইখানে ঠকিবার সম্ভাবনা প্রবল। বোমাব্রত ব্যক্তি ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে জীবনের জায়গায় মৃত্যুকে বাছিয়া লইল। ইহাতে প্রমাণিত হইতেছে কী? হইতেছে যে ধর্ম এহেন শিক্ষা প্রচার করে সেই ধর্মের জীবনাদর্শ মৃত্যু, তাহার সংস্কৃতি মরণের মহোৎসব মাত্র। অথচ এই যুক্তির প্রণেতা ও প্রচারকগণ ভাবিয়া দেখেন নাই—আত্মঘাতী বোমার ব্রত বা লক্ষ্য মৃত্যু নয়, মৃত্যু এক প্রকার পরিণতি মাত্র। [But death here is an effect not a motive] (আসাদ ২০০৬: ৪২) ব্রতসন্ধানী পশ্চিমা পণ্ডিতসমাজ—আপাতত মনে হইতেছে এই সমালোচনায়—তেমন বিব্রত হইবেন না।

আত্মঘাতী বোমার ব্যাখ্যাস্বরূপ পশ্চিমা পণ্ডিতসমাজের অনেক ব্যাখ্যাই পূর্বসংস্কারের পরিমার্জনা বৈ নয়। লাভের মধ্যে, ধর্মপরায়ণতা (religious subjectivities) ও দুনিয়াবী গায়ের জোর বা রক্তপাত (political violence) সম্বন্ধে অনন্ত স্বাধীনতাবাদীগণ (liberals) কী চিন্তা করেন তাহার পরিচয় পাইলাম। বোমা বা এসলাম সম্পর্কে নতুন কিছু জানা হইল না।

পশ্চিমা সাম্রাজ্যের ধুরন্ধরগণ বলিতেছেন আত্মঘাতী বোমা এসলাম ধর্মীয় চিন্তাধারার ফসল। তালাল আসাদ এই ব্যাখ্যা সঠিক মনে করেন না। ধুরন্ধরগণ প্রমাণ করিতে চাহেন আত্মঘাতী বোমা বোমাবাজগণের ব্রতের (বা মোটিভেশনের) ফসল। ধর্মবিদ্যার খ্যাতনামা পণ্ডিত আইভান স্ট্রেনস্কি [Ivan Strenski] বলিতেছেন বোমা ফাটাইয়া আত্মহত্যা করিবার ব্রত এক ধরনের ধর্মীয় আত্মোৎসর্গ বা জান ‘কোরবানি’ বৈ নহে। গবেষক বেগম মে জায়ুসি লিখিয়াছেন এই জাতীয় আত্মোৎসর্গের আসল উদ্দেশ্য রাষ্ট্রনৈতিক নিপীড়ন ও অপমান হইতে মুক্তির প্রয়াস, তবে শেষ বিচারে ইহাও আত্মদানের মতন ধর্মীয় বিশ্বাস হইতেই জন্ম লইয়াছে।

আরেকজন বিশারদ, ফরাসিদেশের রাষ্ট্র-বৈজ্ঞানিক ব্রুনো এতিয়ন, একই পথে জানাইতেছেন আত্মঘাতী বোমা আরব জাতির অস্থিমজ্জায় প্রোথিত ‘মরণকামড়’ (বা ‘ডেথ উয়িশ’) বৈ নহে। এই তিন ব্যাখ্যার সামান্য দিক—তালাল নির্ণয় করিয়াছেন—আর কিছু নহে, এক ধরনের ব্রত বা মোটিভ। সেই ব্রত মৃত্যু। মৃত্যু কেন? কারণ এসলাম ধর্ম জীবনের সাক্ষাৎ মৃত্যুকে ঢের মহিমাযোগে দেখিয়া থাকে। এসলাম তাঁহাদের মতে এক জাতীয় ‘মরণ সভ্যতা’ (বা ‘কালচার অব ডেথ’)।

আইভান স্ট্রেনস্কি যাত্রা করিয়াছেন ফরাসি সমাজ-বৈজ্ঞানিক এমিল দুর্খাইমের আত্মহত্যাবিদ্যা হইতে। দুর্খাইমের অনুসারী বলিয়া পরিচিত একজন বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতের নাম হাবোয়াকস [Halbwacks]। তিনি আত্মহত্যা [suicide] ও আত্মোৎসর্গের [sacrifice] মধ্যে ভেদ দেখিয়াছেন। এই ভেদ কি তাহা জানিবার প্রধান উপাদান সমাজ। সমাজ দুই জিনিশকে এক চোখে দেখে না। আত্মনিগ্রহ বা আত্মহত্যার সঙ্গে সমাজের অনুমোদন যখন যোগ করা হয় তখন তাহা আচারানুষ্ঠানযোগেই [ritual] করা হয়। শুদ্ধ কি তাহাই? আত্মোৎসর্গ মানে ‘পবিত্র করিয়া তোলা’। লাতিন শব্দ সাক্রিফিকিয়ুম [sacri-ficium] অর্থও ইহা বৈ নহে। (যাহা হইতে ইংরেজি বুলি ‘স্যাক্রিফাইস’ আসিয়াছে)। স্ট্রেনস্কি দেখাইতে চাহেন ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মঘাতী বোমা ফিলিস্তিনি জাতি (বা উম্মা) সমীপে বোমারুর আত্মোৎসর্গ বা উপহার (আরবি ‘হাদিয়া’) মাত্র। আদমবোমা জেহাদি যোদ্ধার বিবেচনায় যুদ্ধের কৌশলও বটে। স্ট্রেনস্কি তাহা অস্বীকার করিতেছেন না। তারপরও তিনি যোগ করিতেছেন এই ঘটনার প্রকৃত বিচার করিতে হইলে ইহার ধর্মীয় ভিত্তিটুকু হিসাবে লইতেই হইবে। তাঁহার মতে আত্মোৎসর্গের সহিত রক্তপাতের সম্বন্ধ অঙ্গাঙ্গী। তাঁহার বিচারে ধর্ম মানেই আত্মনিগ্রহ বা আত্মোৎসর্গ। অতয়েব রক্তপাতে বিলম্ব কেন?

স্ট্রেনস্কির কহতব্য কতখানি যুক্তিসম্মত? তালাল আসাদ মনে করেন স্ট্রেনস্কি বৃথাই দুর্খাইমের নাম ভাঙ্গাইতেছেন। দুর্খাইম দেখাইয়াছিলেন আত্মহত্যা যদিও এই দুনিয়ার মধ্যে মনুষ্যসন্তানের সবচেয়ে বেশি আপন বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তথাপি ইহার মধ্যে অপর বা সমাজ নানাভাবে জড়াইয়া থাকে।

তালাল আসাদ মনে করেন এমিল দুর্খাইম [Emile Durkheim] বাঁচিয়া থাকিলে আত্মঘাতী বোমার ঘটনাকে ‘পরার্থপর বা পরোপকারী আত্মহত্যা’ [altruistic suicide] বলিয়া গণিতেন। অথচ স্ট্রেনস্কি একহাতে এই ঘটনাকে কৌশলে ব্যক্তির ব্রত বলিয়া ধরিয়া রাখিয়াছেন, আবার অন্যহাতে ইহার সহিত আচার (বা রিচুয়াল) যোগ করিয়াছেন। এইভাবে ব্যক্তির সহিত, সমাজকে পাশ কাটাইয়া, ধর্ম যোগ করিয়াছেন তিনি । করিয়া প্রমাণ করিলেন (এসলাম) ধর্মই আত্মহত্যা বোমার জননী।

emile_durkheim.jpg
এমিল দুর্খাইম

তালাল আসাদের দ্বিতীয় মন্তব্য অনুসারে এসলাম ধর্মে আত্মোৎসর্গ বলিয়া কিছু নাই। যাহা আছে তাহা হইল পশু জবাই [আরবি ‘জবিহা’] করা। ইহার যুক্তি: আল্লাহ আদেশ করিয়াছেন পশু হত্যা করিবে, যেন তোমার মানুষ হত্যা না করিতে হয়। ইহাই হজরত ইব্রাহিম শিখিয়াছিলেন। কোরবানির সময় ইহাই পালন করা হয়। আরেক ধরনের উৎসর্গ করা কোন বিপদ বা ফাঁড়ার হাত হইতে বাঁচিয়া উঠিলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ওয়াস্তে করা হয়। তেসরা ধরনের উৎসর্গ হয় কোন অতিশয় অন্যায় বা ভ্রান্তির হাত হইতে ফিরিয়া আসিবার পর খেসারত (বা ‘কাফফারা’) স্বরূপ। আত্মঘাতী বোমারুর কৃত্য ইহাদের কোনটার সহিতই মিলিতেছে না। তাই বাধ্য হইয়া স্ট্রেনস্কিকে নাস্তি, নাস্তি বলিতে হইবে।

তিন নম্বর কথা, স্ট্রেনস্কি আত্মোৎসর্গ কথাটি আরবি ‘কোরবান’ শব্দের তর্জমা আকারেই ব্যবহার করিয়াছেন। কিন্তু আরবিতে কোরবান মানে কখনো ‘হাদিয়া’ বা উপহার দাঁড়ায় না। অথচ তিনি দুই অর্থকে গুলাইয়া যে অপূর্ব খিচুড়ি করিয়াছেন তাহা আরবিভাষাভাষি খ্রিস্টান জাতির সম্পদ মাত্র। হজরত ঈসা—আল্লাহ তাঁহার নাম অনুমোদন করুন—নিজেকে ‘উপহার’ দিতে পারেন। তিনি পিতার কাছে ফিরিবার হকদার। অন্যের বিশেষ মুসলমানের সেই হক কই? কোরবান কথাটা পবিত্র কোরান গ্রন্থে যে তিন জায়গায় পাওয়া যাইতেছে (৩: ১৮৩, ৫: ২৭ এবং ৪৬: ২৮) তাহাদের কোনটাতেই স্ট্রেনস্কির ধারণার সমর্থন পাওয়া যাইবে না। (আসাদ ২০০৬: ৪৪)

এতক্ষণে আশা করি আইভান স্ট্রেনস্কির ব্রত কি তাহার পথ পরিস্কার হইয়াছে। তিনি দাবি করিতেছেন আত্মোৎসর্গের সিদ্ধান্ত যিনি লইতেছেন ইহা তাহার ব্রত মাত্র। এই ব্রত হইতে অপরাধ জন্ম লইতেছে। অনেকে যে বলিয়া থাকেন এসরায়েল রাষ্ট্রের পাশবিক দমন ও পীড়ন-নীতির কারণে আত্মঘাতী বোমার বিস্তার তাহা ঠিক কথা নহে—ইহাই স্ট্রেনস্কির দাবির নির্গলিতার্থ।

স্ট্রেনস্কি এই এক ঢিলে দুই পাখি বধ করিতে চাহিয়াছেন। তিনি একে তো প্রমাণ করিলেন এই বোমাপরাধ ধর্ম হইতে জাত। সুতরাং ইহাকে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বলিয়া ডাকা যাইবে। দ্বিতীয় স্থানে প্রমাণিত হইল অপরাধের দায় খোদ বোমাবাজের। কাজেই এসরায়েল দেশের বিপদ কোথা হইতে আসিতেছে তাহাও সনাক্ত হইল। অতয়েব এই বিপদ হইতে ত্রাণ পাইতে হইলে যাহা যাহা করা দরকার (রক্তপাতের চৌহদ্দি আরো বাড়াইয়া লওয়া তাহার মধ্যে) তাহা তাহা করিবার অধিকার এসরায়েলের হাতে প্রকাশ্যে সংরক্ষিত রহিল।

মে জায়ুসি [May Jayyusi] নামী একজন গবেষকও এই একই ধারণা গ্রহণ করিয়াছেন। তিনিও ধরিয়া লইয়াছেন আত্মঘাতী বোমাবাজি এক প্রকার জান কোরবানির বিষয়। তিনিও বিশ্বাস করিতেছেন এসলামের সহিত ‘মরণ সভ্যতা ’ বা কালচার অব ডেথ’ কথাটি জোড়া লাগাইয়া দেওয়া যায়। তালাল আসাদ বলিতেছেন, ইহাতে আমরা যে সমস্যার সমাধান খুঁজিতেছি—অর্থাৎ আত্মঘাতী বোমার কারণ নির্ণয় করিতেছি—তাহার কোন রাহা কিন্তু হইতেছে না। ‘মরণ সভ্যতা’ শুদ্ধ এসলামের মৌরসী সম্পত্তি হইবে কেন? ‘অনন্ত স্বাধীন’ গণতান্ত্রিক সভ্যতাও কি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য মরণকে তুচ্ছ করিবার শিক্ষা দেয় না? না দিলে ন্যায়যুদ্ধ কথাটি কি সোনার পাথরবাটি শোনাইত না?

জায়ুসিও দেখিয়াছেন জাতির ওয়াস্তে আত্মদানই ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মঘাতী বোমা বুকে বাঁধিবার আসল উদ্দেশ্য। ইহাকে তিনিও এসলামি সভ্যতার শরিক বলিয়া ধরিয়া লইয়াছেন। তবে তাঁহার বিচারে এসলাম এই ঘটনার কারণ নহে। কারণ এসরায়েল রাষ্ট্রের দমননীতির মধ্যে খুঁজিতে হইবে। আত্মঘাতী বোমার উৎপত্তি, জায়ুসির বিচারে, অসলো [Oslo] চুক্তির পর। ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তির সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হইয়াছে এই চুক্তির কারণে। ফলে যে জাতীয় হতাশা গোটা জাতিকে গ্রাস করিয়াছে ইহাতে তাহারই প্রতিফলন ঘটিয়াছে।

জার্মান এয়াহুদি বংশোদ্ভূতা মার্কিন দার্শনিক ও রাষ্ট্র-বৈজ্ঞানিক খানম হানা আরেন্টের [Hanna Arendt] বরাত দিয়া বেগম জায়ুসি বলিয়াছেন এসরায়েলের নিপীড়ন ও অপমানজনক ব্যবহার হইতেই ফিলিস্তিনি জাতির সদস্যগণের মনে ন্যায়সংগত ক্রোধের সঞ্চার ঘটিয়াছে। এই ক্রোধেরই অপর নাম দাঁড়াইয়াছে আত্মঘাতী বোমা। কিন্তু সত্যের খাতিরে তিনিও কবুল করিলেন এখানে রক্তপাত বা ‘ভায়োলেন্স’ আসল কথা নহে, আসল কথা স্বাধীনতার স্পৃহা।

যখন আইনসঙ্গত রাজনীতির পথ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় তখন রাজনীতির পানি আপনার পথ করিয়া লয় রক্তপাতের পথে। হানা আরেন্ট বলিয়াছিলেন, দেশের রাষ্ট্রনীতিতে শরিক হইতে না পারিলে মানুষ মানুষই হইয়া উঠিতে পারিত না। রাষ্ট্রনীতি যাহার মাধ্যমে ব্যক্ত হয় না তাহাকে ‘ব্যক্তি’ বলা মানে ভাষার সর্বনাশ করা মাত্র। আর রোমক সাম্রাজ্যের পতনের আগে বা আরো বিশদ বলিতে ঈসা পয়গম্বরের আগের যুগে মানুষের অমর হইবার পথ শুদ্ধ রাষ্ট্রনীতির জমিতেই কাটা ছিল। খ্রিস্টধর্ম সেই পথ টানিয়া ধর্মের জগতে আনিয়াছে।

তাহা হইলে বলিতে হইবে, মে জায়ুসির বিচার আইভান স্ট্রেনস্কির জমি হইতে সরিয়া আসিয়াছে খানিকটা। তিনি ধর্মীয় আত্মোৎসর্গকে রাষ্টীয় স্বাধীনতা ও অমরতার বাসনার সহিত যোগ করিয়াছেন। ইহাতে ভুল বোঝাবুঝির একটুখানি ছুটি থাকিয়াই যাইতেছে। যেমন স্ট্রেনস্কি ‘শহিদ’ কথাটি শুদ্ধ ধর্মীয় আচার আকারে গ্রহণ করিবার উপদেশ দিতেছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের সংগ্রামে যাহারা এসরায়েলি সেনাবাহিনীর বা পুলিশের গুলিতে মারা যাইতেছে তাহাদের সকলকেই শহিদ বলা হয়; কেবল আত্মঘাতী যোদ্ধাদেরই শহিদ বলা হয় না। শহিদের মৃত্যু মানে ধরা হয় বিজয়, কোনক্রমেই আত্মোৎসর্গ বা পরাজয় নহে।

ফরাসি রাষ্ট্র-বৈজ্ঞানিক ব্রুনো এতিয়েন (Bruno Etienne) উত্তর আফ্রিকা বিশেষজ্ঞ। তিনি আলজিরিয়ার ইতিহাস ঘাঁটিয়া প্রমাণ করিয়াছেন আরব জগতে রক্তপাতের ঐতিহ্য অনেক লম্বা। তাঁহার বিশ্লেষণ পড়িয়া দেখিলে মনে হয় তিনি ফিলিস্তিনের আত্মঘাতী বোমাযুদ্ধ আর উত্তর আফ্রিকার ঐতিহ্য পরস্পরের আত্মীয় বলিয়া চিনিতে পারিয়াছেন। কিন্তু ইহাদের মধ্যে কাহার স্থান কারণস্বরূপ আর কাহার স্থান কার্যস্বরূপ তাহা বলিতে তিনি ব্যর্থ হইয়াছেন। (আসাদ ২০০৬: ৫১)

যুক্তির এই ধাতুদৌবর্ল্য হ্রাস করিবার মানসে এতিয়েন করিয়াছেন কী? তিনি আশ্রয় লইয়াছেন মহাত্মা ফ্রয়েডের। ফ্রয়েড বলিয়াছিলেন মানুষ সমাজের আদ্যাবস্থায় যে বড় অপরাধটি করিয়াছিল অর্থাৎ গোত্রপিতার জীবননাশ করিয়াছিল পশুহত্যা তাহারই পুনরাবৃত্তি বৈ নহে। আত্মহত্যা বা আত্মোৎসর্গ—পশুহত্যার মত—প্রকৃত প্রস্তাবে পিতৃহত্যারই পুনরাবৃত্তি। এই শেষোক্তস্থলে হননেচ্ছা শুদ্ধ ‘হাদিয়া’ বা উপহার আকারে হাজির থাকে। পার্থক্য শুদ্ধ এইটুকু।

এতিয়েন এই যুক্তির শরণ লইয়া বলিতেছেন এসরায়েল রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান নিপীড়নের মুখে আরব জাতির অসহায় পরাজয় আরবদের মনে আত্মধিক্কারের জন্ম দিয়াছে। এসরায়েলের তৈয়ারি বিশাল বিশাল দেওয়াল আর সীমান্তচৌকি সেই ধিক্কার পাকা করিয়াছে। এই সকল দ্রব্য অবজ্ঞা ও ঘৃণা উৎপাদন করিতেছে আর আত্মগ্লানিকে পরহত্যা বাসনায় রূপান্তরিত করিতেছে।

এতিয়েনের এই প্রস্তাব কতখানি যুক্তিসংগত? এই প্রশ্ন তালাল আসাদ তুলিয়াছেন। এতিয়েন প্রকৃত প্রস্তাবে ফ্রয়েডের ‘মরণ কামড়’ (বা ‘ডেথ উয়িশ’) কথাটি বুঝিতেই পারেন নাই। ফ্রয়েডের বিচারে ‘জীবনতৃষ্ণা’ ও ‘মরণ কামড়’ সমানে সমান, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সক্রিয় এই দুই বাসনা। অজ্ঞান হইতে তাহারা আসা যাওয়া করেন জ্ঞানের বা সংজ্ঞার জগতে। এতিয়েন সেখানে হাত দিয়া একটাকে প্রধান করিয়া তুলিয়াছেন। কিন্তু যুক্তি কোথায় এই হস্তক্ষেপের পশ্চাতে?

তাঁহার দাবি অনুসারে যখন রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে শরিক হইবার সুযোগ বন্ধ হইয়া যায়—ফিলিস্তিনে তাহাই ঘটিয়াছে বৈ কি!— তখন মানুষের বাড়তি যে জীবনীশক্তি ছিল তাহা উপচাইয়া উপচাইয়া ‘মরণ কামড়’ আকারে প্রকাশ পায়। তাঁহার এই বক্তব্যের সহিত ফ্রয়েড প্রবর্তিত ‘মরণ কামড়’ ধারণার কোনই সংযোগ নাই। এই কল্পিত সংযোগ অনুমান করিয়া তিনি বলিয়াছেন রাজনৈতিক কল্পনায় টান পড়িয়াছে বলিয়াই ফিলিস্তিনী মুক্তিযোদ্ধারা আত্মঘাতী বোমার ভার বহন করিতেছেন। কিছুক্ষণ আগে আমরা দেখিলাম মে জায়ুসি ইহার বিপরীত অনুমানই সিদ্ধ মনে করিয়াছেন। জায়ুসি বলিয়াছেন—রাজনীতি যে অমরত্ব দেয় সেই অমরত্ব লাভের বাসনা বা অনন্ত জীবনতৃষ্ণাই আত্মঘাতী বোমার জননী। আর এখন এতিয়েনের মুখে শুনিতেছি মন্থরার বাণী—মানুষ মরিতে চাহে বলিয়াই আত্মঘাতী বোমার কারখানা বসায়!

এতিয়েনের এই ধারণার গোড়াও রহিয়াছে হানা আরেন্টের আরেকটি ভ্রান্ত-ধারণায়। আরেন্ট একা নহেন, সকল অনন্ত স্বাধীনতাবাদী বা লিবারেল দার্শনিকই মনে করেন রক্তপাত ও রাজনীতি ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। একের যেখানে সারা অন্যের সেখানে শুরু। রক্তপাত ও রাজনীতি যে একে অপরের গাত্র জড়াইয়া সর্বদা মাখামাখি করিতেছে ইহা তাঁহাদের শিখাইবে কে? আমার সে সাধ নাই। পশ্চিমা সাম্রাজ্যের ভিত্তি পশ্চিমা দেশের ইতিহাসে। সেই শিক্ষা সেখানেই আছে। সতের শতকের ইংরেজ দার্শনিক জন লকই দেখাইয়াছেন রক্তপাত বিহনে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে নাই। এখন যে কথা যোগ করা দরকার তাহাও এই : রক্তপাতের একচ্ছত্র অধিকার রাষ্ট্রের হাতে যতদিন থাকিবে না ততদিন রাষ্ট্রও নাই।

কাজেই ফিলিস্তিনি পামররা রাজনীতি না বুঝিয়া বোমাব্রত ধারণ করিয়াছে—ইহাকে শুদ্ধ ফিলিস্তিনি জাতির অপমান বলিলেই হইবে না। বলিতে হইবে ইহা ‘অনন্ত স্বাধীন’ বা লিবারেল চিন্তার ধাতুদৌর্বল্যও বটে।

কোন ব্যক্তিমানুষ কোন পথে নিজের জীবন শেষ করিতে চাহে তাহার কোন সরল ব্যবস্থাপত্র আর যিনিই লিখিয়াই থাকুন, মহাত্মা ফ্রয়েড লিখিয়া রাখেন নাই। এতিয়েন বলিতেছে আত্মঘাতী বোমারু দুশমনের মধ্যে নিজের ছায়া দেখিতে পাইয়াছে। তাই তাঁহাকে হত্যা করিয়া সে আসলে আপনাকেই শেষ করিল, ‘মরণ কামড়’ চরিতার্থ করিল। আপন পরের এই অভেদ যদি সত্য সত্য সত্যই হইত তবে আত্মহত্যা না করিয়া আর আর মানুষ সমর ঘোষণা করিতেছে কেন? যুদ্ধকে আত্মহত্যা বলা যায় রূপক অর্থে। তাই আন্তর্জাতিক আইনে যখন বলা হয় কোন কোন রাষ্ট্রের পরমাণুবোমা ব্যবহার করার অধিকার আছে তখন তাহাকে আত্মহত্যার অধিকার বলিয়াও গ্রহণ করা যায়।

আত্মহত্যার ইচ্ছা যদি অজ্ঞান হইতে আসিয়া থাকে তবুও সজ্ঞান মনের মধ্য দিয়াই তাহাকে পথ চলিতে হয়। যুদ্ধ ঘোষণার বেলায়ও ইহা সত্য। যুদ্ধ ঘোষণা ব্যক্তির ইচ্ছা ছাড়াইয়া জাতি বা রাষ্ট্রের বা নিদেনপক্ষে শ্রেণীর ইচ্ছা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়া আসে। ইহাও আগ্রাসন বা ধ্বংসাভিলাষ বটে। কিন্তু লিবারেল দার্শনিকরা বলিতেছেন মানুষ যত সভ্য হইতেছে ততই যুদ্ধ কমিয়া আসিতেছে। মানুষের ইতিহাস এই বক্তব্য কিন্তু সমর্থন করিতেছে না। তালাল আসাদ বলিয়াছেন তথাকথিত অসভ্য জাতিগণের সাক্ষাৎ সভ্য জাতির যুদ্ধ করিবার ইচ্ছা অনেক বেশি। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস তাহার যুদ্ধাভিলাষ দমনের ইতিহাস বলিয়া মনে হয় না। ‘প্রগতি’ শব্দের আর যে অর্থই থাকুক—এই অর্থ করা যাইতেছে না।

ফ্রয়েড বলিয়াছেন মানুষের মনে অপরাধবোধ জাগিলে পরহত্যাভিলাষ কিছু কমিয়া আসে। সভ্যতার প্রগতি বলিতে ফ্রয়েড এই অপরাধবোধের প্রগতিই বুঝিয়াছেন। কিন্তু তাহা আত্মহত্যার ঝোঁক বাড়ায় এমন কথা ফ্রয়েড বলিয়াছেন বলিয়া আমাদের জ্ঞানে নাই। তালাল আসাদ এক জায়গায় বলিয়াছেন যুদ্ধের সময় আত্মহত্যার সংখ্যা কমিয়া আসে—এই কথা সত্য হইলেও আমরা নিশ্চিত নহি এই কথা পৃথিবীর ইতিহাস হিসাবে সত্য। ফ্রয়েডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার জাক লাকাঁ কহিয়াছেন মানবজাতির ইতিহাসে প্রবর্তিত ‘প্রগতি’ কথাটি ভুয়া।

রবার্ট পেপে [Robert Pape] নামক একজন মার্কিন রাষ্ট-বৈজ্ঞানিক দাবি করিতেছেন—আত্মহত্যার বোমা আসলে যুদ্ধের কার্যকর কৌশল। প্রমাণ সকলেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করে, শুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা নহে। তিনি শ্রীলংকার দৃষ্টান্ত দিয়াছেন। ১৯৮০ হইতে ২০০১ সালের মধ্যে পৃথিবীতে একুনে ১৮৮টি আত্মঘাতী বোমা হামলার নিকাশ করিয়া তিনি দেখাইয়াছেন ইহাদের মধ্যে ৭৫টি ঘটনা একলা শ্রীলংকার তামিল মুক্তিযোদ্ধারাই ঘটাইয়াছেন।

pape_robert_print.jpg
রবার্ট পেপে

পেপের গবেষণা দুই জায়গায় খতরনাক সিদ্ধান্ত টানিতেছে। আত্মঘাতী বোমা হামলা আসলেই কি তেমন কার্যকর পদ্ধতি? ফিলিস্তিনি সংগ্রামের ইতিহাস কি তাহা প্রমাণ করিতেছে? আত্মঘাতী বোমার প্রকোপবৃদ্ধির পর এসরায়েলের পক্ষে পশ্চিমা সাম্রাজ্যের জনমত আরও সবল হইতেছে বলিয়াই মনে হয়। ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রাম ১৯৬০ সালের দশক হইতে কত কৌশলেরই না আশ্রয় লইয়াছে! তাহা হইলে ফিলিস্তিনি সংগ্রামের আত্মঘাতী কৌশল ও তাহার পায়ের তলার এসলামি সভ্যতা লইয়া পশ্চিমা জ্ঞানজগতে এত শোরগোল পড়িয়াছে কেন? ইহার উত্তর কিছু পরিমাণে তালাল আসাদও লিখিয়াছেন তাঁহার তৃতীয় প্রস্তাবে। আমরাও যথাস্থানে—আদমবোমা: ৩ প্রবন্ধে—তাহা লিখিব।

এক্ষণে শুদ্ধ বলিব আত্মঘাতী বোমাকে বিশেষ ব্রতের ফসল হিসাবে দেখিবারই কুফল এই এসলামবধ কাব্য। ধর্মের (বিশেষ এসলামের) ব্রত হইতে আত্মঘাতের উদ্ভব বলিতে পারিলে অনেক লাভ আছে। ফলে একদিকে মনস্ততত্ত্ব, অন্যদিকে সভ্যতা এই দুই কুলই রাখা যাইতেছে। ‘মনস্তত্ব’ মানে অপরাধ নির্ণয়ের পরিচিত ফৌজদারি আদালতসম্মত পদ্ধতি—অপরাধীর মনে কী আছে তাহা জানা হইল। আর ‘সভ্যতা’ মানে আমরা ও তাহারা—সভ্য ও অসভ্যজাতি—যে এক নই তাহা স্পষ্ট হইল। সভ্যতা জীবনতৃষ্ণা নিবারণ করিতেছে আর ‘বর্বরতা’ (গতকল্য যাহা ‘বন্য’ ছিল) ‘মরণ কামড়’ খাইতেছে। আহা কী আনন্দ বিচার ও বিশ্লেষণে, কী অপূর্বমিলন মণি ও কাঞ্চনে!

তালাল আসাদের বিচার্য শেষ বিশেষজ্ঞের নাম রোক্সান এয়ুবেন (Roxanne Euben)। ইনিও দার্শনিক রাষ্ট্র-বৈজ্ঞানিক হানা আরেন্ট হইতে শুরু করিয়াছেন কিন্তু শেষ করিয়াছেন অন্য জায়গায়। মে জায়ুসির মতো ইনিও বলিবেন আত্মঘাতী বোমা ফিলিস্তিনের সংগ্রাম বা তাহার মুক্তিযুদ্ধের কৌশল ইহাতে সন্দেহ নাই। তবে এই কৌশলের গোড়া নিছক এসলাম ধর্মের বিশ্বাসে পোতা বলিয়া ইনি জাহির করেন নাই। ইহা কম কৃতিত্বের কথা নহে।

এয়ুবেন দাবি করিয়াছেন এসলামি পরিভাষায় যাহাকে ‘জেহাদ’ বলা হইয়াছে তাহার তাৎপর্য শুদ্ধ পরকালের দরজা খোলার চাবিতে খুঁজিলে চলিবে না। একই সঙ্গে ইহাকে দুনিয়াবি ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে অন্ধ রক্তলোলুপ হত্যার উৎসব হিসাবে দেখাও ঠিক হইবে না। তাহা হইলে ‘জেহাদ’ ঠিক কী বস্তু?

হানা আরেন্টের সন্ধ্যাভাষা (বা ডিসকোর্স) ব্যবহার করিয়া বেগম এয়ুবেন জাহির করিতেছেন জেহাদ এক জাতীয় রাজনীতি, যে রাজনীতির লক্ষ্য দুনিয়াবি জীবনের নশ্বরতা পার হইয়া অবিনশ্বর জীবনের স্বাদ পাওয়া। কিন্তু এই অবিনশ্বরতার পথ এই নশ্বর জীবনবেদের ভিতরেই প্রাপ্তব্য। সেই জীবনবেদ আর কী হইতে পারে? তাহার নাম এই দুনিয়ার ন্যায়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা [‘the founding or recreating a just community on earth’]। (আসাদ ২০০৬: ৫৬)

hanna_arendt.jpg
হানা আরেন্ট, ১৯০৬-১৯৭৫

হানা আরেন্ট ও অন্যান্য লিবারেল দার্শনিক মনে করেন রাষ্ট্র ও রক্ত যেনবা তেল ও জলের মতন, একে অপরের সহিত মিশিতে পারে না। রাষ্ট্র মানে রক্তপাতের অবসান—আর সতত-সম্মতির শুরু। কিন্তু আরেন্টের এই ধারণার সহিত এয়ুবেন একমত নহেন। তিনি সঙ্গত কারণেই প্রস্তাব করিতেছেন রক্তপাত ছাড়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হইলেও হইতে পারে কিন্তু রক্তপাতের সম্ভাবনা বাদ দিলে রাষ্ট্র রাষ্ট্রই হইত না। (আসাদ ২০০৬: ৫৮) রক্তপাত জিনিশটা খারাপ কিন্তু এই খুনখারাপি বাদ দিলে রাষ্ট্রের মঙ্গল প্রতিষ্ঠিতও হয় না, ধারণও করা যায় না ।

কথার শেষ কিন্তু এখানেই হয় নাই। রক্তপাত শুদ্ধ একদিন করিয়াই রাষ্ট্র ক্ষান্ত দিলেই তাহা হইত। কিন্তু নিরব রক্তপাতই রাষ্ট্রের নিত্যদিনের কর্মসূচি। রক্তপাতের অধিকার একদিনও যদি স্থগিত থাকে তো কোন ‘অনন্ত স্বাধীন’ রাষ্ট্রই অনন্ত থাকিত না, তাহার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া শুরু হইয়া যাইত। জাতীয় দণ্ডবিধি বা ‘পেনাল কোড’ অনুসারে দণ্ডদানক্ষমতা আর আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক যুদ্ধ ঘোষণার সার্বভৌম ক্ষমতাই এই নিত্য-রক্তপাত। কাজেই ‘অনন্ত স্বাধীন’ রাষ্ট্রের রক্তেই রক্তপাতের নেশা ঘুমাইয়া আছে বলিলে সত্যের উপকার ভিন্ন অপকার হইবে না।

ইহা যদি সত্য না হইত তবে দুনিয়ার সর্বাধিক শক্তিশালী রাষ্ট্র যে দুনিয়া দাবড়াইয়া দাবড়াইয়া জাতীয় নিরাপত্তা কায়েম করিতেছে তাহা কী করিয়া করিত? রক্তপাতের অধিকার স্বীকার না করিলে পশ্চিমা ধনতন্ত্র আজ যে বিশ্বসাম্রাজ্য কায়েম করিয়াছে তাহাও বিধিসম্মত হইত না। শুদ্ধ তাহাই নহে এই দুনিয়া ধ্বংস করিবার অর্থাৎ পরমাণু বোমা ফাটাইয়া চলিবার অধিকারও জাতিসংঘভুক্ত ‘আন্তর্জাতিক (ন্যায়) আদালত’ স্বীকার করিয়াছে। (আসাদ ২০০৬: ৬০)

পরমাণু বোমার অধিকারও যদি সত্যাগ্রহস্বরূপ হইয়া থাকে তবে আত্মঘাতী বোমা কেন আত্মহত্যার অপবাদ একলা একলা বহন করিবে? অনন্ত স্বাধীন রাষ্ট্র আজও তাহার উত্তর দিতে পারে নাই। আত্মহত্যার আগে পারিবে কিনা সন্দেহ করিবার কারণ আছে। ঢের আছে।

ঢাকা, ২৮/১২/২০০৭

দোহাই


১. Talal Asad, On Suicide Bombing (New York: Columbia University Press, 2006).
২. Cesare Beccaria, An Essay on Crimes and Punishments, tr. anonymous, 4th ed. 1775, reprint (Boston: Branden Publishing Co., 1992).
৩. সলিমুল্লাহ খান, ‘আদমবোমা: ১- পশ্চিমা সাম্রাজ্যের বর্ণপরিচয়’, http://arts.bdnews24.com/?p=256, ৮ নভেম্বর ২০০৭

২৯ ডিসেম্বর ২০০৭, বিডি নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *