সলিমুল্লাহ খানের জন্ম ১৯৫৮ সালে কক্সবাজার জেলায়। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চে। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম চিন্তাবিদ। সময়কে তিনি দেখেন নিজের গভীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ, শেরিফ আল সায়ার।
বাংলা ট্রিবিউন: ৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটা পটপরিবর্তন হলো। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তারা কাজ করছে দুই মাস হয়ে গেলো। এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি।
সলিমুল্লাহ খান: দুই মাস অতি অল্প সময়। কোনও কাজ তারা সত্যি করতে পেরেছেন কিনা সেটা বিচার করার জন্য দু’মাস পর্যাপ্ত নয়। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন সেটা তাঁরা ঘোষণা করেছেন—তাঁরা কিছু সংস্কার শুরু করবেন, কিছু সংস্কার সমাপ্ত করবেন। এখন সংস্কারগুলো কী?
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো কেন? যে দুঃখে তাদের পতন সেই দুঃখটা সারাতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক দোষের মধ্যে একটি বড় দোষ— তারা নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করেছেন। কাজেই নির্বাচন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা দরকার। নির্বাচন ব্যবস্থা মানে মানুষ নিজের ভোট দিয়ে নিজের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে যে পদ্ধতিতে, সেই পদ্ধতিটিকে তারা ধ্বংস করেছেন।
আমাদের যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা তাকে বলে প্রজাতন্ত্র। যাতে বলা হচ্ছে— সরকার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের বিশ্বাসের নাম। জনগণের প্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনা করবেন, জনগণের আস্থা পূরণ করবেন। কিন্তু সরকার যদি জনগণের প্রতিনিধিত্ব না করে বিশেষ বিশেষ স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জনগণের সাথে তার সম্পর্কের যে শেষ সুতা— সেটাও কেটে দেয়, নির্বাচন ব্যবস্থা ভণ্ডুল করে, তবে সে সরকার সমস্ত আইনগত ও নৈতিক বৈধতা হারিয়ে ফেলে।
হাসিনা সরকারের পতনের জন্য মানুষ মনে মনে শত চেষ্টা করলেও অনেক দিন ভয়ে সফল হয়নি। সেই ভয় করে একটি চূড়ান্ত অবস্থায় যাঁরা চেষ্টা করতে পেরেছেন, স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের হাতে নেতৃত্ব গিয়ে পড়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে এই সরকারের আইনগত ভিত্তি নিয়ে কোনো প্রশ্ন কি উঠতে পারে?
সলিমুল্লাহ খান: স্বীকার করতে হবে, সরকার গঠনের বৈধতা শুধু নির্বাচন দিয়ে হয় না। জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও সরকার গঠিত হয়। এই ইচ্ছার প্রকাশ নির্বাচনের মাধ্যমে যদি না ঘটে— তাহলে জনগণ সরাসরি নিজের ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে পারে। এখানে জনগণ বলতে বোঝায় তাঁদেরকেই যাঁরা নিজের জীবন বিপন্ন করে এই আন্দোলন-সংগ্রামে জয়ী হন।
এই যে নিজের জীবনকে বিপন্ন করা—এটিই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব রক্ষার শেষ উপায়। আমাদের দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বলা হয় ‘popular sovereignty’। এর অর্থ জনগণই রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক। কিন্তু সমস্যা একটাই— এই জনগণ কী বস্তু?
একসঙ্গে সম্মিলিত ২০ কোটি মানুষ তো আন্দোলন করে না। জনগণের মনের যে অভিপ্রায় সেটা যারা জানতে পারেন তারা জিজ্ঞেস করেন, এটাই জনমনের মনের অভিপ্রায় কিনা। সে প্রশ্নের উত্তরে মানুষ যদি হ্যাঁ বলে, তাহলে সেটাই জনগণের অভিপ্রায়। শেখ হাসিনার শেষদিকে মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে নানা ইস্যুতে আন্দোলন করছিল। তিনি সবগুলো দমন করতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন সেগুলো বিক্ষিপ্ত বলেই। যখন তারা সম্মিলিত হয়েছে তখন তিনি পরাস্ত হয়েছেন।
এখন নতুন যাঁরা ক্ষমতায় বসেছেন তাঁদের বৈধতা এই— তাঁরা জনগণের অভিপ্রায় ধারণ করতে পেরেছেন। তবে জনগণের অভিপ্রায় কাউকে চিরস্থায়ী করে না। এজন্য ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর’ বলে যে পঙক্তি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন সেই পঙক্তি এখানে স্মরণ করা যায়। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা ক্ষমতাকে বৈধতা দিতে হলেও নির্বাচন দিতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: নির্বাচনের একটা লক্ষ্য সামনে আছে। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
সলিমুল্লাহ খান: আজ বাংলাদেশের দু’মাস ধরে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁরা যদি নির্বাচনের ব্যবস্থাটাকে বৈধতা দিতে চান, তাঁদের আগে বলতে হবে নির্বাচনের ব্যবস্থাটা কী হবে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। আমাদের নির্বাচনের যে বর্তমান পদ্ধতি তা শেষ বিচারে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা। এখানে ছোট ছোট দল থাকলেও তাদের পক্ষে নির্বাচিত হয়ে আসা— এবং নির্বাচিত হওয়ার পরে সরকার গঠন করা— একরকম প্রায় অসম্ভব। এই যুক্তির পক্ষে প্রমাণ গত ৫৩ বছরের ইতিহাস।
এখানে সামরিক শাসন কায়েম হয়েছে— পর্যায়ক্রমে দ্বিদলীয় ব্যবস্থাও কায়েম হয়েছে। বহুবার আওয়ামী লীগ এবং বহুবার বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং, ক্ষুদ্র দল- বিশেষ করে যারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা (যাদের বলা হয় সংখ্যালঘু) তারা—ক্ষমতার ভাগ পাননি। সংখ্যালঘু শুধু ধর্মীয় অর্থে নয়, প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেও সংখ্যালঘু রয়েছেন, যেমন- হিন্দু ধর্মের মধ্যে আছেন উচ্চবর্ণ বা নিম্নবর্ণ এবং মুসলমানের মধ্যেও নানা রকমের ভেদাভেদ আছে। নারীদের ক্ষমতার কথা বলি। সেক্ষেত্রেও দেখা যায় বৈষম্য। বর্তমান ব্যবস্থাকে যদিও বলা হচ্ছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ও জনমতের ভিত্তিতে সরকার গঠন-ব্যবস্থা; প্রকৃতপক্ষে এটা যারা সংখ্যাগুরু তাদের সরকার গঠন-ব্যবস্থা।
সরকারি চাকরিতে, সংসদীয় প্রতিনিধিত্বে, এমনকি স্কুল-কলেজে, শিক্ষা-ব্যবস্থায় (যেগুলো ক্ষমতার উৎস সবগুলোতে) এই সংখ্যাগুরুর আধিপত্যই চলে। অথচ আমরা এটাকেই বলেছি গণতন্ত্র।
কয়েকটি কথা মনে রাখতে হবে, যেহেতু দেশটি ছোট তাই আমাদের প্রথমে দাঁড়াতে হবে বিশ্বশান্তির পক্ষে। বিশ্বশান্তির পক্ষে মানে নিরপেক্ষতার নীতি। আমাদের দাঁড়াতে হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমরা আত্মরক্ষা ছাড়া অন্য কোনও যুদ্ধে জড়াবো না। আমাদের থাকতে হবে নিরপেক্ষ। আমরা মার্কিন জোট, চীনা জোট, ভারতীয় জোট ও রাশিয়ান জোটে না গিয়ে কী করে বেঁচে থাকতে পারি— তা খুঁজে বের করতে হবে।
আমাদের কোনও সরকার যদি দেশকে পাশের কোনও দেশের সেবাদাসে পরিণত করে, অধীনতামূলক মিত্রতায় ডুবে যায়, সেটাও জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বা বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। শেখ হাসিনার সরকার সেটিও করেছে। দেশটাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছিল। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়বে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা শেষ করা।
তৃতীয় একটা কথা। আমাদের সংবিধানের মৌলিক অঙ্গীকার— নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করা। এটি আমাদের সংবিধানে লিখিত হয়েছে ‘মানবিক মর্যাদা’ আকারে। প্রত্যেক মানবসন্তান যিনি এই জাতির নাগরিক তার মর্যাদা রক্ষা করা সংবিধানের ওয়াদা। তার ভোটের অধিকার এবং তার কাজের অধিকার দুটোই তাকে দিতে হবে। কাউকে বিনা কারণে গ্রেফতার করা যাবে না, বিনা বিচারে আটক রাখা যাবে না, কাউকে অপমান করা যাবে না, কারো ওপরে পাশবিক নির্যাতন চালানো যাবে না।
‘ইক্যুয়াল প্রটেকশন অব ল’ বলে একটি কথা আছে। এজন্য বাকস্বাধীনতা সবার সমান হতে হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তাকে বিশেষ আইনে বিচার করা হবে— এটি সংবিধানের দেওয়া গ্যারান্টি ‘ইক্যুয়াল ও প্রটেকশন অব ল’র বিরুদ্ধে যায়। এটা রাজতন্ত্রের নীতিকেই মাত্র সুসংহত করে।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট— এগুলো হচ্ছে ‘লেজে মাজেস্তে’। এটি একটি ফরাশি শব্দ, যার অর্থ রাজার বিরুদ্ধে অপরাধ। শেখ হাসিনা এই কাজটিই করেই মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন। আধুনিক জাতিসংঘ বা এনজিও আদির ভাষায় ‘হিউম্যান রাইটস’ নষ্ট করেছেন।
বর্তমান সরকারের কর্তব্য জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করা, দুই নম্বরে বিশ্বশান্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়া, মানে সাম্রাজ্যবাদী জোটে যোগ না দেওয়া। মনে রাখতে হবে তা জনগণ সহ্য করবে না।
আমাদের স্বাধীনতার আদি অঙ্গীকার ছিল পৃথিবীর সর্বত্র স্বাধীনতার সংগ্রামে, জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে যাঁরা লিপ্ত রয়েছেন, তাঁদের সংগ্রামে সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা। যেমন, ফিলিস্তিনের মুক্তি-সংগ্রাম অথবা কাশ্মীরের মুক্তি-সংগ্রাম। বাংলাদেশে কাশ্মীরের মুক্তি-সংগ্রাম বিষয়ে শেখ হাসিনার আমলে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। হাসিনা ধরে নিয়েছিলেন যে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মাত্র। এর নাম সুবিধাবাদ। রাজনীতিতে একটা না একটা নীতি তো থাকতে হবে। বাংলাদেশে তা হবে প্রজাতান্ত্রিক নীতি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে বলে আপনি ন্যায়ের পক্ষ নিলেন না। কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, যা ১৯৪৭ সাল থেকে অসমাপ্ত রয়েছে— তার পক্ষে টুঁ শব্দটিও করলেন না।
মনে রাখা কর্তব্য, কাশ্মীরের সমস্যার একটি কাশ্মীরি সমাধানও আছে। যেমন, বাংলাদেশের সমস্যার একটা বাংলাদেশি সমাধান ছিল। সেদিন পাকিস্তান সরকার বারবার বলছিলেন, বাংলাদেশের সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু আমরা বলছিলাম এটি অভ্যন্তরের ব্যাপার নয়, বিশেষ করে ২৫ মার্চের পর এটি আন্তর্জাতিক ব্যাপার হয়ে গেছে। এভাবে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে—ভারতের সমর্থনসহ আমরা সেদিন স্বাধীন হয়েছি। তো কাশ্মীরিদের সে অধিকার থাকবে না কেন?
এ সমস্ত কথা যদি আমরা একসঙ্গে আলোচনা করতে না পারি, বাংলাদেশের বিপ্লব ব্যর্থ হবে। বিপ্লবের উদ্দেশ্য শেখ হাসিনা যা যা করেছিলেন তার ঠিক উল্টোটি করা। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করেছিলেন। শেখ হাসিনা ছিলেন কার্যত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি। মজার ব্যাপার তাঁর বাবাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। সত্য কথা: তিনি ২৫ মার্চ পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করে যুদ্ধের ময়দান থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন। এই বিষয়ে কখনো বাংলাদেশে প্রাণখোলা অকপট আলোচনা হয়নি। স্থির করতে হবে এটি একটি দেশদ্রোহ বা ‘treasonable offense’-এর পর্যায়ে পড়ে কিনা।
আমরা জাতির পিতা কে হবেন বিতর্ক করেছি বটে, কিন্তু শেখ সাহেবের ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখের আত্মসমর্পণ করাটা জাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল কিনা— সেই প্রশ্নও কেউ তোলেনি। অথচ এটার চেয়ে তোলার মতো প্রশ্ন দ্বিতীয়টি আর ছিল না। ইতিহাসের প্রশ্নগুলোর মীমাংসা না করে বর্তমান সংবিধানে আওয়ামী লীগ অনেকগুলো সংশোধনী যোগ করেছে (একটি স্বাধীনতার ঘোষণার পরিচয়ে শেখ সাহেবের নামে একটি ভুয়া স্টেটমেন্ট ঢুকিয়ে দেওয়া)।
প্রশ্ন করা উচিত এত বছর বিদ্রোহটা হয়নি কেন? এই বিদ্রোহ জনগণ করতে পেরেছেন, নেতৃত্ব যাঁরা দিয়েছেন তাঁদের ক্ষমতায় থাকার অধিকারও আছে। এখন তাঁরা যদি এই দেশ পরিচালিত করতে না পারেন, তাহলে তাঁদের পরিণতিও হয়তো একই রকম হতে বেশি দিন লাগবে না।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি অনেক প্রসঙ্গ এনেছেন। প্রথমত ইতিহাসের প্রসঙ্গ আনলেন যে ১৯৭১-এর অনেক অমীমাংসিত ইতিহাসও আমাদের সামনে আছে। এই যে ৫৩ বছর আমরা পার করলাম, এখনও নির্মোহভাবে ইতিহাস ব্যাখ্যা করার মতো স্পেস আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। এটি কেন হয়নি বলে মনে করেন?
সলিমুল্লাহ খান: কারণ একাত্তরের পর কখনোই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া মানে জনগণ কর্তৃক নিজের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারা। ফলে নিজেদের যারা ক্ষমতায় কায়েম রেখেছেন তারা নিজেদের বৈধতা দেওয়ার জন্যে এক একটা মিথ তৈরি করেছেন। ১৯৭১ সালের সেরা মিথ শেখ মুজিব। ইতালির ফ্যাসিস্টরা যে স্লোগান দিয়েছিলেন—‘এক নেতা এক দেশ’— এটা বাংলাদেশে কিভাবে গ্রহণ করা হলো? এ নিয়ে কি কেউ কখনো প্রশ্ন করেছেন?
১৯৭২ সালের পর ফ্যাসিস্টরা স্লোগান দিয়েছে ‘এক নেতা এক দেশ—বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’। তার মানে তারা শুরু থেকেই বাংলাদেশকে ফ্যাসিস্ট পথে পরিচালনা করেছেন। জনগণের যে ভূমিকা দেশকে স্বাধীন করার জন্য তার কোনও স্বীকৃতি কোথাও মেলে নাই। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধের সময় দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শেখ সাহেব তখন পাকিস্তানের হাতে স্বেচ্ছাবন্দি। গত ৫৩ বছর তাজউদ্দীনের নাম কয়দিন শুনেছেন আপনি? কোন জায়গায় আছে সে নাম? তাহলে বোঝা যাচ্ছে মিথ তৈরি করা হয়েছে। ইতিহাস ও মিথ দুটো প্রায় সমান হয়ে গিয়েছে।
প্রাচীনকালে বিভিন্ন ধর্মে আর লোককাহিনিতে মিথের যে ভূমিকা বর্তমানকালে ইতিহাসকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেমন, অনেকে বলেন পাঁচ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালি, হাজার বছরের বাঙালি ইত্যাদি। এইগুলো তো মিথ, বাঙালি তো পাঁচ হাজার বছর আগে ছিল না, এমনকি ‘বাঙালি’ নামটাও ছিল না। এমনকি যে ভূখণ্ড এখন বাংলাদেশের তলায় তাও পাঁচ হাজার বছর আগেও মাটির নিচে ছিল। এটি কত বছর আগে গঠিত হয়েছে—পাঁচ হাজার নাকি সাত হাজার? নাকি তিন হাজার? এটিও তর্কসাপেক্ষ বিষয়। ‘পাঁচ হাজার বছরের বাঙলা ও বাঙালি’ নামে বই লিখেছেন এক ভদ্রলোক। আরেক ভদ্রলোক লিখেছেন ‘হাজার বছরের বাঙালি’। অনেকে বলছেন ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। এই জাতীয় কথা মোক্ষম ফ্যাসিজম। যেখানে হাজার বছরে বাঙালির অস্তিত্বই ছিল না—বাংলা ভাষারও অস্তিত্ব যার পরে— সেখানে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আবিষ্কার করা সম্পূর্ণভাবে ইতিহাসের যুক্তিলঙ্ঘন।
তারপর সামরিক শাসন এবং জিয়াউর রহমান। তারপর তার বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান। আবার সেনা ষড়যন্ত্র। এরশাদ সাহেব। এরপর ১৯৯০। তারপর থেকে যত সরকার হয়েছে সেগুলোর কোনোটাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলেনি— কার্যকর হয়নি। পরিণতি ২০০৭ সালের ১/১১।
শেখ হাসিনা যা করলেন তা তো আমরা চোখের সামনে দেখলাম। বাংলাদেশে কখনোই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই কারণে ওই ইতিহাসও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মনে রাখবেন ইতিহাস কখনোই অতীত নয়, ইতিহাস বর্তমানের কাহিনি। বিশেষ করে বর্তমান থেকে দাঁড়িয়ে অতীতকে যেভাবে স্মরণ করা হয়— তাকেই ইতিহাস বলে।
বাংলা ট্রিবিউন: কেন জনগণের সরকার হিসেবে কার্যকর কিছু করতে পারলো না?
সলিমুল্লাহ খান: কারণ তারা পড়ে গেছেন জনগণের বিরুদ্ধবাদী কিছু কিছু সুবিধাভোগী গ্রুপ—বাংলাদেশের মাপে যাদেরকে ক্রনি ক্যাপিটালিস্ট বলা যায়— তাদের খপ্পরে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁরা পুঁজিপতি বা ক্যাপিটালিস্ট হয়েছেন সেই লোকেদের কর্তৃত্বে বারবার চলে গিয়েছে সরকার। এটি এরশাদ আর বিএনপির আমলে নতুন করে চলার প্রবণতা শুরু করেছিল। বিএনপি পরাজিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের আমলে এর আরও নতুন নতুন সূত্রপাত হয়। গণতন্ত্র যদি এ দেশে কাজ করতো, ইলেকশন সিস্টেমটা যদি কাজ করতো, তো শেখ হাসিনাকে এমন লজ্জাজনকভাবে পালাতে হতো না।
বাংলা ট্রিবিউন: তাহলে এই যে সংস্কারের প্রসঙ্গ এলো, সেটি কি আমরা টেকসইভাবে দেখতে পারবো?
সলিমুল্লাহ খান: এই উত্তরের জন্যে আপনাকে আরও মর্মে, আরও বিশ্লেষণে যেতে হবে। দেখতে হবে কোন কোন শক্তি এর পেছনে কাজ করেছে। শেখ হাসিনাকে তাড়াবার জন্যে যে শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য কী? তাঁরা যদি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চান তো তা করতে পারবেন। কিন্তু তাঁদের যদি এর বাইরে অন্য মতলব থাকে তো পারবেন না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার কথাটা বলবো না আমি। যেহেতু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিতই হয় নাই তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র গণতান্ত্রিক জনযুদ্ধ। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সেই প্রতীককে প্রথমে পরাজিত করেছে আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। অনেকেই বলেন, শেখ মুজিব আর শেখ হাসিনা এক পদার্থ নন। এটা ঠিক নয়। আমি মনে করি দুজনই এক ক্ষুরে মাথা কামানো।
শেখ মুজিবের আমলেই গণতন্ত্র প্রথম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়। বাকশাল তার চূড়ান্ত পর্যায় মাত্র। ১৯৭২ সাল থেকে তারা কোন কাজটি করেননি, যেটাকে আপনি ফ্যাসিবাদী বলবেন না? যেমন, রক্ষীবাহিনী গঠন। এখনকার র্যাব বাহিনীর থেকেও খারাপ ছিল সেটি। আহা! মানুষ এত দ্রুত ভুলে যায়! শেখ সাহেবের আমলেই গণতন্ত্র নিহত হয়েছে। লাশটা এতদিন দাফন করা হয়নি। হাসিনার পরাজয়ের মাধ্যমে যদি তার দাফন সম্পন্ন হয়ে থাকে, তো জাতির একটা বড় উপকার হলো।
উপকারের প্রথম কথা, সংবিধান সকলকে সমানভাবে রক্ষা করবে। যদি আপনি ডিজিটাল সিকিউরিটি অথবা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রভৃতি দেখেন— দেখবেন সেখানে সকলকে সমানভাবে রক্ষা করা হয় নাই। আপনি রাজপরিবারের সমালোচনা করতে পারবেন না। যে আইনে রাজপরিবারের সদস্যদের বিশেষ সুরক্ষা বা প্রটেকশন দেওয়া হয়, সেই আইন সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সকল সদস্যের জন্য ‘বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ হতে পারে না। যিনি ক্ষমতায় আছেন— প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী—তিনি প্রতিরক্ষা তো পান। এটা প্রটোকল অনুযায়ী প্রাপ্য। কিন্তু তাঁর বোন পাবে কেন? পরিবারের সদস্য হিসেবেই তো পাচ্ছেন। তিনি কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন নন। এমপিও নন, মন্ত্রীও নন অথবা তিনি সরকারি কর্মচারী নন, সচিব নন, উপদেষ্টাও নন। তাহলে তিনি এই প্রতিরক্ষা পাবেন কী করে?
১৯৯০ সালের পরের নির্বাচন তো গণতন্ত্রের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সে অভিপ্রায় বাস্তবায়িত হয় নাই। যা হয়েছে তা বাংলাদেশে নতুন যে ধনতন্ত্র— যে ধনতন্ত্র কোনও শিল্প-কারখানা স্থাপন না করে শুধু ব্যবসা এবং বিদেশি ব্যবসার এজেন্সি করে টাকা পয়সা করাতেই সীমিত— সে ধনতন্ত্রের বাস্তবায়ন। বিদেশে আয় করে দেশে সঞ্চয় না করে উল্টো দেশের আয় বিদেশে সঞ্চয় করার যে পদ্ধতি, তার কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বর্তমান সরকারের জন্যেও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি।
বাংলা ট্রিবিউন: এবার আন্দোলনের প্রসঙ্গে আসি। আন্দোলনকে তো আমরা গণঅভ্যুত্থান বলছি। অনেকে বিপ্লব বলছেন। নতুন একটি ন্যারিটিভও এসেছে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এটা আসলে তাত্ত্বিকভাবে আন্দোলনকে আমরা কি বলতে পারি?
সলিমুল্লাহ খান: তাত্ত্বিকভাবে কিছু বলার দরকার নেই। আপনি খালি চোখে দেখেন, চশমাটা সরিয়ে ফেলেন। তত্ত্ব মানে একটা চশমার ভেতর দিয়ে দেখা। চশমাটা বাদ দিয়ে দেখেন: কতগুলো ঘটনা খুব পরিষ্কার দেখা যাবে। এতক্ষণ আমরা যা আলোচনা করলাম তাতে বলা হচ্ছে— বাংলাদেশে এতদিন একটা অবৈধ, অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক সরকার কায়েম-মোকাম ছিল। শুধু ছিল না, তারা একটা মিথ্যা কথাও চালু করেছিলেন। বলছিলেন তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। কাজেই আমাদের একসঙ্গে দুটো কাজ করতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, আপনারা শুধু অবৈধ, অগণতান্ত্রিক এবং জনবিরোধী নন— আপনারা তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীও।
যদি বর্তমান গণঅভ্যুত্থানটা ব্যর্থও হয়ে যায়— যদি মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার কোনও সংস্কার করতে না পেরে বিদায়ও নেন— তবু এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা থাকবে। এত বেশি হত্যা, এত বেশি নৃশংসতা, এত বেশি অন্যায় আর কোনও সরকার করার সাহসই করেনি। সেনানায়ক এরশাদও অনেক হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছিলেন, কিন্তু শেখ হাসিনার দশ ভাগের একভাগ করার সুযোগও তিনি পাননি। মানে বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার চাইতে বড় কোনও কলঙ্ক কোনও সামরিক সরকারও অর্জন করতে পারেনি।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন যাঁরা সংগঠিত করেছেন, তাঁরা একটা অসাধারণ কাজই করেছেন। যেটা অনেক মানুষের—যেমন বিএনপির— চিন্তার মধ্যে আসে নাই। আন্দোলন যখন শুরু হলো তখন বিএনপির তরফ থেকে একটা বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল— এগুলো আওয়ামী লীগের দৃষ্টিবিভ্রম করার কৌশল। আহা! বিএনপি! তারা এই আন্দোলনটা বুঝতেই পারেননি। গতানুগতিক রাজনীতিকরা ঘটনা কী তা আদৌ বুঝতে পারেন নাই। অনেকেই ভেবেছিলেন এটা সম্ভবই ছিল না। নিশ্চয়ই এখানে কারও ষড়যন্ত্র আছে। লোকে খেয়াল করে না। চিলের পিছে ছোটে। যারা ষড়যন্ত্রের ভাষায় চিন্তা করেন তারা ষড়যন্ত্রই দেখেন। পৃথিবীতে ষড়যন্ত্র ছাড়াও কিছু কিছু ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়।
বাংলা ট্রিবিউন: গত ১৬ বা ১৪ বছর আওয়ামী লীগ বাইনারি তৈরি করেছে— মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং বিপক্ষের শক্তি। সমালোচনা করলেই রাজাকার, জামায়াত বা বিএনপি বানিয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষের লোকজনও এমন ঘটনার শিকার হয়েছে। বর্তমান পরিবর্তনের মধ্যে আবার একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে। কেউ সমালোচনা করলেই তাকে আওয়ামী লীগের দোসর বানিয়ে দিচ্ছে। এই চক্র থেকে আমরা কি বের হতে পারবো না?
সলিমুল্লাহ খান: চক্র থেকে যদি বের হয়ে আসতে চান তাহলে চক্রটার উৎপত্তি দেখতে হবে। যেখানে দোষটার শুরু সেখানেই খুঁজতে হবে। আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য মোটেও ধারণ করেনি। এটা যদি আপনি পরিষ্কার বোঝেন, তাহলে তারা কেন এই ছুতাটা তৈরি করেছিলেন তাও বুঝবেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি ২০১০-এর দশক পর্যন্ত। ১৯৯০-এর দশকেও বেগম জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। দাবি করেছিলেন বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। খুবই সঠিক জিনিস ছিল ওটা। যে সময় (১৯৯৬) শেখ হাসিনা প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন, সে সময় বিচারের উদ্যোগ নেন নাই। বিচারের উদ্যোগটা নিলেন যখন তাঁর প্রয়োজন দেখা দিলো। তা তাঁর মুক্তিযুদ্ধপ্রীতি প্রমাণ করে না। প্রমাণ করে স্বৈরতন্ত্র।
শেখ হাসিনার শাসনরীতি ছিল ফ্যাসিবাদ। কাজেই তাঁকে ফিরিয়ে আনার প্রচার যাঁরা করছেন, তাঁদের তো সঙ্গত কারণেই ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলবো।
বাংলা ট্রিবিউন, ২২ অক্টোবর ২০২৪