প্রবন্ধ

পৃথিবী কমলালেবুর মতো নীল অথবা “গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কবিতা”

Spread the love

বিগত ১৬ অক্টোবর (২০২৪)  ‍‍`গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কবিতা‍‍` নামে একটা বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম পুনর্জীবিত জাতীয় কবিতা পরিষদে। ঐদিন সকালেই আমাকে সেই বক্তৃতার একটা সারমর্মও লিখে দিতে হয়েছিল। এখানে সেই সারমর্ম । সঙ্গে কিছু অসার কথাও যোগ করলাম ।

 

১।। কবিতার গড়ন

ফরাশিদেশের কবি পল এলুয়ার একবার লিখেছিলেন: “পৃথিবী কমলালেবুর মতো নীল”। এই এক পংক্তি পড়লেই বোঝা যায় মানুষ কেন কবিতা লেখে অর্থাৎ কবিতা কি কাজ করতে পারে ।

কবিতার কাজ ভাষার প্রকাশ-ক্ষমতা বাড়ানো । কবিতা ভাষার সীমান্ত ঠেলতে পারে । এই বাড়তি ক্ষমতার  বলেই কবিতা সঙ্গে সঙ্গে না হোক দুদিন আগে বা পরে সর্বসাধারণের বিষয় বা সম্পদ হয়ে ওঠে ।

বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ কোথাও বলেছিলেন “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি” । এই বলনটা যুগপদ সত্য ও অসত্য । সত্য সংকীর্ণ  অর্থে আর অসত্য ব্যাপক অর্থে । মানুষ মাত্রেই কবি কারণ ভাষা মাত্রেই কবিতা । রূপক ও লক্ষণা (মেটাফোর ও মেটোনিমি) নামক দুই অলঙ্কার ছাড়া কোন স্বাভাবিক (ন্যাচারাল) ভাষাই কাজ করে না । কবিতার মূল অলঙ্কারও এই দুইটাই । তাই বলা চলে ভাষা মাত্রেই কবিতা । যা কবিতা নয় তা স্বাভাবিক ভাষা নয় । কবিতা বা কবি শব্দের ব্যুৎপত্তি বিচার করলেও “কওয়া” পর্যন্ত যেতে হবে । কথা ও কবিতা মোটেও অসবর্ণ নয় ।

এ তো গেল ব্যুৎপত্তির কথা। নিয়তির বিচারেও ভাষা ও কবিতা মনে হয় সহোদর বোন । কবিতা হয়তো এই দুনিয়া বদলে দেবে না কিন্তু কবিতা ছাড়া এই দুনিয়ার আর কোন  বিহিত, গন্তব্য বা নিয়তি নাই ।

তাই এই বক্তৃতায় স্থির করলাম কবিতার সঙ্গে, কিংবা যদি বলেন কবিতা প্রসঙ্গে, দুইটি কথা বলবো । একটা কবিতার যাত্রাবিন্দু নিয়ে, আরটা তার বিহিত, গন্তব্য বা নিয়তি নিয়ে ।

যাত্রাবিন্দুর কথা দিয়ে শুরু করতে পারি । অর্থের অর্থাৎ ভাবের বিচারে  কবিতা আর গণতন্ত্র সমার্থক । যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না তা ভাষা নয়। নীরব কবিত্ব বলে কিছু যেমন নাই তেমনি অপ্রকাশ্য কবিতা বলেও কোন কবিতা নাই । কবিতার সঙ্গে ভাষার যোগ নাড়ির যোগ বটে । আর মানব সমাজে ভাষার চেয়ে অধিক গণতান্ত্রিক কোন সম্পদ নাই । এই শর্তানুসারে কবিতা মাত্রেই গণতান্ত্রিক ।

 

২।। কবিতার চলন

কবিতা আরেক অর্থেও গণতান্ত্রিক । এই অর্থ ইতিহাসের অর্থাৎ কালের বিচারে নিষ্পন্ন । কালের গর্ভে ভাষার  পরিবর্তন নিষিক্ত হয় । এই নিষিক্ত হওয়া অঘটন নয়, ঘটনা । কারণ তা নিয়মিত ঘটে ।

এই ধরণের সকল বিপ্লবের নিয়তিকে কবিতার সঙ্গে তুলনা করা যায় । পৃথিবীতে যত ঘটনা ঘটে তার সব কটাকেই বিপ্লব বলা চলে না। মাত্র  কোন কোনটাই বিপ্লব ।

কোন ঘটনা বিপ্লব পদবাচ্য হল কিনা তার একটা মাপকাঠি আছে: ঘটনাটি কয়টা কবিতা পদবাচ্য কবিতার (অর্থাৎ সামান্য অর্থে সৃষ্টির) জন্ম দিতে পেরেছে ।

যাত্রাবিন্দুর মাপে কিংবা ভাবের বিচারে গণতন্ত্র কথাটার আদি অর্থ ছিল দশের বা সর্বসাধারণের  কর্তৃত্ব”। আগেই স্বীকার করেছি কবিতা জন্মগ্রহণ করার দুদিন আগে আর পরে  জনগণের অর্জিত সম্পদ হয়ে পড়ে । এখানেই ধরা পড়ে কবিতার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্কটা কতকটা আঁতের সম্পর্ক ।

যাহা জনগণের বা সংক্ষেপে গণের, যাহা সকলের (অর্থাৎ দশজনের), জাতীয় সমাজে তাহার উপরে আর কোন ধন নাই–এই ধারণাই  একদা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বলে গণ্য হতো । তাহা ভালো না মন্দ এ নিয়ে কোন ঐকমত্য ছিল না । গ্রিসদেশের মনীষী আরস্ত মনে করতেন গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিকৃষ্টতম শাসন ব্যবস্থা ।

কালের গতিকে আরস্তুর ব্যবস্থাপত্র ধোপে টেকেনি । আরস্তুর মতো মনীষীরও মতিভ্রম হয়েছিল । যাহা দেশের জনসাধারণের সম্পদ তাহা মাত্র হাতেগোনা ক‍‍`জন ভূস্বামী বা ধনকুবের আর কয়েক গণ্ডা সামন্ততন্ত্র  বা ধনতন্ত্র-সেবকের হাতে বন্দী থাকবে এমন তো হতে পারে না। অন্তত চিরদিন হতে পারে না । দশজনের ধন ভাষার মতো রাষ্ট্রও চলবে দশজনের ইচ্ছা অনুসারে-এই অঙ্গীকারই ছিল গণতন্ত্রের প্রথম প্রতিশ্রুতি বা আদিকল্প।

কবিতা এই আদি ও আসল ঐতিহাসিক অর্থে ছিল গণতান্ত্রিক । কবিতা যে ভাষায় লেখা হয় সে ভাষার মালিকানা ঐ ভাষায় যারা যারা কথা কহেন বা লেখেন তাদের সকলের । প্রকৃত প্রস্তাবে কবির বাসনা বা কামনাও তা ছাড়া আর কিছু নয় । পৃথিবীর বাতাস আর আকাশের আলো, মহাসাগরের পানি আর নক্ষত্রমণ্ডলীর শোভা যেমন সকলের, জীবনের অপরিহার্য আর সকল বিষয়-সম্পদও তেমনি সকলের । সারাৎসারস্বরূপ এই বিবেচনা ছাড়া কবির বাসনা আর কিছু হয় না !

কবিতা মাত্রেই তাই গণতান্ত্রিক । এই সত্যের একনম্বর কারণ কবির কারবার । আর এই কারবারটা ভাষা  নিয়ে চলে । এক ব্যক্তির ভাষা বলে কিছু নাই।  এই জগতের কোথাও কোন পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাও পাওয়া যায় নাই যাহাকে এক ব্যক্তির ভাষা নাম দেওয়া যায় ।

মানুষ যে মানুষ (তার মধ্যে মনের ঊষ) হয়েছে তা মাত্র এই ভাষা বা বাকশক্তির কারণে । ভাষা আর মন মানুষের ক্ষেত্রে সমান অর্থপাত করে ।

তারপরও স্বীকার করতে সকলেই এই প্রস্তাবের অনুগমণ করবেন না ।  ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এমন ভাব প্রকাশের দুঃসাহস যাঁরা করেন সঙ্কীর্ণ অর্থে তাঁরাই যখন কবি তখন জীবনানন্দ দাশের কথাই সত্য: সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি ।
এখানেই দেখা যায় অনেক কবি আছেন যারা গণতান্ত্রিক বললে অপমানিত বোধ করেন । গণতন্ত্র এঁদের ভাষায় “জনতার জঘন্য মিতালি” ।

৩।। ইতিহাস বা নবযুগপুরাণ

পরিশেষে কবিতার নিয়তি বা গন্তব্যের কথা বলি। নিয়তির একটা মানে যাহার রতি আছে কিন্তু যতি (সংস্কৃতে “য়তি”) নাই । এই অর্থে কবিতার কোন উপসংহার নাই ।

দুঃখের মধ্যে মানুষের অভিজ্ঞতার নিরিখে, কালের বিচারে,  ইতিহাস পুরাণ অনুসারে কবিতার সঙ্গে গণতন্ত্রের একটি সম্পর্ক আছে । এই সম্পর্ককে পৌরাণিকও বলা যায় । তবে আধুনিক কালে ইতিহাস যখন প্রাচীন পুরাকথা বা মিথের স্থান দখল করেছে, তাই ইতিহাস সম্পর্কে একটু সাবধানতার দরকার আছে। ইতিহাস এখন পুরাণের অভাব পূরণ করছে ।

গত দুই শত বছরের কথাই যদি ধরি কি দেখি?  দেখি দুনিয়ার শত শত বড় কবি গণতন্ত্রের সংগ্রামে শরিক ছিলেন । জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন বা প্রগতিই ছিল এই মহান কবিকুলের সাধনা । এই সাধনা কোথাও সার্থক হয়েছে, কোথাও বা হয়েছে নিরর্থক ।

সুখের মধ্যে এই ভাগ্যোন্নয়নসন্ধানী কবিতা ভাষার ঢের নতুন সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছে । যে বেদনা আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না, মূক হয়ে থাকি, মূষড়ে পড়ি কবিতার মধ্যে  কবিতার কালোয়াতগণ সেই বেদনাকে ভাষা দিয়ে থাকেন । তাই জনসাধারণ কবিতার এত আদর করেন । কবিতার গন্তব্য বা নিয়তি তাই জনসাধারণ ।

কোন সে জনসাধারণ ? যে জনসাধারণ শেষবিচারে দুনিয়ার মজদুর আর দুনিয়ার মজলুম তারা ছাড়া আর কে নিজেকে জনসাধারণ বলতে রাজি হয়েছে! বিশেষ কি আর সাধারণ হয়!

ইতিহাসের বর্তমান পুলাণ বলে, যাদের নিজ নিজ গতর আর স্ব স্ব রতিশক্তি  ছাড়া আর কোন (বেচে খাওয়ার  মতো সামগ্রী বা বাঁচবার মতো উপায়-উপকরণ নাই) তারাই জনসাধারণ ।

এই জনসাধারণের যুগ যেদিন শুরু হয়েছে সেই যুগকেই মাত্র গণতন্ত্রের যুগ বলা যায় । এই যুগের জন্ম কখন  হয়েছিল সেটা বড় কথা নয় । আসল কথা, আমরা সে যুগের গর্ভেই জন্ম নিয়েছি । জার্মানির কবি বের্টোল্ট ব্রেশ্ট এই যুগের বেদনা সারাজীবন প্রকাশ করা যায় না এমন ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন ।  এক্ষণে তাঁহার অসামান্য কথার সামান্য ব্যয়ভার বহন করছি।

“এখন যে সমাজ-ব্যবস্থা চলছে
তা উৎখাত করার ডাক আপনার চোখে ভয়ঙ্কর ঠেকতেই পারে,
তবে যা চলেছে তা তো মোটেই  সমাজ-ব্যবস্থা নয় ।

সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া
হয়তো মনে হবে অশুভ ।
কিন্তু দিনের পর দিন যা ঘটে চলেছে
তা তো সশস্ত্র সংগ্রামই !
এতে অবাক হবার কিছু নেই।”

ইউরোপখণ্ডে হজরত ঈসার ১৫০০ বছরের আগেপিছে এক যুগ শুরু হয়েছে । সে যুগের দুই চরিত্র । এক চরিত্র স্বখণ্ডে হোক না হোক  সমাজ ব্যবস্থা। আর পরখণ্ডে (আমেরিকা, আসিয়া আর আফ্রিকায়) সশস্ত্র সংগ্রাম । তাই কবিতার ইতিহাসেও  এই দ্বিচারিতা গোপন থাকেনি ।

১৯৪৮ সালে ফরাশি দেশের রাজধানী পারি শহর থেকে প্রকাশিত একটি কবিতা সংকলন গ্রন্থের ভূমিকাযোগে জাঁ-পল সার্ত্র লিখেছিলেন: “এক কথায়, আমি এখন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকদের বলেকয়ে তাদের যা বোঝাতে চাইছি  তা তো কৃষ্ণাঙ্গরা আগেই জেনে ফেলেছেন : বর্তমান দশায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী কি কারণে কেবল কবিতাজাত অভিজ্ঞতা বলেই নিজেদের চিনতে পারছেন আর কথাটা উল্টিয়ে বললে এই দাঁড়ায়: কোন কারণে ফরাশি ভাষায় লেখা কৃষ্ণাঙ্গ কবিতাই আমাদের যুগের একমাত্র মহীয়ান বিপ্লবী কবিতার  (la seule grande poésie révolutionnaire)”  মর্যাদা লাভ করেছে ।

 

কবিতা সংকলনটির নাম: Anthologie de la nouvelle poésie nègre et malgache de langue française ( ফরাশি ভাষায় লিখিত নতুন কৃষ্ণাঙ্গ ও মালগাশ কবিতার সংকলন);
সম্পাদকের নাম: Léopold Sédar Senghor ( লিওপোল সেদার সঁগর)।

 

ঢাকা
অক্টোবর ১৯, ২০২৪ ।।

 

প্রকাশ: সংবাদ প্রকাশ, ২০ অক্টোবর ২০২৪