সমাজ ভাষ্যকার লেখক-অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, ভোটাধিকারসহ প্রধান প্রধান নাগরিক অধিকার থেকে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কারণে সৃষ্ট প্রচণ্ড ক্ষোভের কারণেই ছাত্র-তরুণদের চাকরির আন্দোলন দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার পতনের একদফার আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। তিনি আরও বলছেন, ছাত্ররা একা নয় সেনাবাহিনীর একাংশও এক দফার আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। তবে, তিনি মনে করেন, এখন যারা নতুন বৈষম্যবিরোধী— তারা, নবযুগের তরুণেরা অনেকেই কি চাইছেন জানেন না। সলিমুল্লাহ খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন।
সকাল সন্ধ্যা: আমরা দেখলাম, সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন দমনে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগে ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠল এবং শেষে তা সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে পরিণত হলো। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশব্যাপী মারাত্মক সহিংসতা হলো, অগুনতি স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো, ছাত্র-তরুণসহ কয়েক শত মানুষ নিহত হলো। শেষে এক দফার আন্দোলনে পরাস্ত হয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলো। ছাত্র-তরুণদের চাকরির আন্দোলন দ্রুততম সময়ের মধ্যে কেন এতটা বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারল বলে আপনার মনে হয়? এছাড়া এখন কেউ একে বলছেন ‘ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান’, কেউ বলছেন ‘বিপ্লব’, কেউ বলছেন ‘গণ-অভ্যুত্থান’ হয়েছে— ‘বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি’। আপনি একে কীভাবে দেখছেন?
সলিমুল্লাহ খান: বিষয়টা আমি ভিন্নভাবে দেখি। আমার মনে হয় জুলাই-আগস্টের এই ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত একদফার আন্দোলনে পরিণত হওয়ার পেছনে একটা দীর্ঘ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ছিল। বাংলাদেশে পর পর তিনটি নির্বাচন সঠিকভাবে হয়নি। যদি বলা হয় এগুলো ‘Rigged election’— জালিয়াতির নির্বাচন— বা প্রতারণা— যথেষ্ট বলা হয় না। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪— এইসব নির্বাচন নিয়ে শুধু ছাত্রসমাজে নয়— দেশের নাগরিক সমাজে— যারা ভোট দিতে পারেননি— বিক্ষোভ ছিল। তবে এই বিক্ষোভকে তারা কোন ভাষায় প্রকাশ করবেন সেটা তারা বুঝে উঠতে পারেননি।
লক্ষ্য করবেন, ২০০৮ সনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে প্রথমেই বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা (সংবিধান সংশোধন করে) বাতিল করলেন। বাতিল করার গূঢ় উদ্দ্যেশ্যটা স্পষ্ট, তারা নির্বাচন নিজেদের দলের অধীনেই করবেন। অর্থাৎ গদিনশিন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। আমাদের দেশে দেখা যায়, নির্বাচনে সরকার অবৈধ ও অঘোষিত প্রভাব বিস্তার করে। নির্বাচন কমিশন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। এ কথা সকলেই জানেন।
এইজন্যই জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ছিল, জনগণের প্রধান প্রধান মৌলিক অধিকার, ইংরেজিতে যেটাকে বলে ‘সিভিল রাইটস’ বা নাগরিক অধিকার, তা থেকে জনগণ বঞ্চিত হয়েছে।
এরপর ধরুন অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ থেকে খারাপ হয়েছে। সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি দুই ধরনের নির্দেশকের মধ্যে। একটা হলো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। তারপর দেখা যাচ্ছে দেশে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মাপে দ্রব্যমূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে সরকার জাতীয় বাজেটের সম্পূরক অংশ পূরণ করছে। তিন নম্বরে, দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ পুঁজি দেশ থেকে পাচার করেছে । এসব যদি একসঙ্গে ধরি, বলা যায় বিদেশনির্ভর আমাদের অর্থনীতি। সকলেই জানেন, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে যাকে বলে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ তা নির্ভর এই অর্থনীতি। তার মতের বাইরে রাষ্ট্র চালানো কঠিন। আমাদের সেনাবাহিনীর বেশ একটা অংশ জাতিসংঘে শান্তিরক্ষীর কাজ করেন। তাদের ওপরও চাপ আছে।
সব মিলিয়ে একটা চরম অস্থির অবস্থা। কিন্তু এই অস্থির অবস্থা কোন জায়গায় কোন সময়ে বিস্ফোরিত হবে কেউ জানত না। কোটা আন্দোলন সেই বিস্ফোরণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যোগ করেছে। একটা দেশলাইয়ের কাঠি মাও জেদঙের ভাষায় ‘প্রেইরি ফায়ার’— একটা অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে। আমরা দেখেছি, ২০১৮ সালেও এই কোটা আন্দোলন হয়েছিল। তখন সরকার প্রধান বলেছিলেন, আমি বাতিল করে দেব। দিলেনও। কিন্তু পাঁচ বছর পর তারা যেভাবেই হোক— উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমেই হোক সেটার পুনরুজ্জীবন ঘটালেন। সরকার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটা গোলটেবিল বৈঠক ডাকতে পারতেন। তাদের কথা শুনতে পারতেন। তা না করে তারা বলপ্রয়োগের পথে হাঁটলেন। সম্ভবত তাদের অন্য হতাশা সেটা থেকে। চীন থেকে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রীর হতাশা— চীনের দাবি মেটাতে না পারার হতাশা। ভারতে গিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে দেশের জনমতের সবটা খুইয়ে ফেলেন তিনি। তাঁর নৃশংসতা আরো ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
একটি প্রমাণ এই যে, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসারেরা যেখানে থাকেন যেমন মিরপুরের ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি, সেখানেও তাদের পুত্র-কন্যা-স্ত্রী সমভিব্যাহারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মিছিল করেছেন। এটা সাধারণ ঘটনা নয়। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা মহাখালীর ‘রাওয়া’ ক্লাবে সভা ডাকলেন, সংবাদ সম্মেলন করলেন। ইকবাল করিম ভূঁইয়াসহ অনান্য সেনা কর্মকর্তা— জেনারেল নুরুদ্দিনও হাজির ছিলেন, বললেন আমরা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি না।
এসব মিলিয়ে বলতে হয়, রাজনৈতিক বঞ্চনা— নির্বাচন না করে বাহাদুরি করাই সংকটের প্রধান কারণ। সহযোগী কারণ অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং তৃতীয় কারণ সাংস্কৃতিক বঞ্চনা ও প্রতারণা। সাংস্কৃতিক বঞ্চনা কি? দেশের মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রকে সংকীর্ণ আর অবরুদ্ধ করে ফেলা। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এমন সংকীর্ণ করে ফেলা যে নিজদলীয় লোকজন ছাড়া আর কাউকে কথা বলতে না দেওয়া। জাতীয় সংস্থা— বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর সব জায়গাতেই পক্ষপাতিত্বের চরম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে— প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অবধি দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থার অবাধ গতিতে প্রসার ঘটেছে— এগুলোই মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে।
সরকারী কর্মকর্তা বা সরকার প্রধানকে নিয়ে ব্যঙ্গ করার কারণেও— কার্টুন আঁকার জন্য— বহু মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কবির নিক্ষেপ করা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে পারে না যে সরকার সে সরকার তার শাসন করার অধিকার হারায়। এই ধরনের আইন যেখানে হতে পারে— সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, আইসিটি অ্যাক্ট ইত্যাদি নামে যে ধরনের নিবর্তন করা হয়েছে, তা সরকারের দুর্বলতারই প্রকাশ।
প্রধানমন্ত্রী ১৪ জুলাই তারিখের বক্তৃতায় ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিদের জন্য চাকরির কোটা না রেখে কি রাজাকারদের নাতিপুতিদের জন্য রাখব? ছাত্ররা যখন ব্যঙ্গ করে বলল— ‘‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’’ শেষ দুই লাইন বাদ দিয়ে সরকারি প্রচারযন্ত্র বলল, ‘‘এরা নিজেরাই নিজেদের রাজাকার বলেছে।’’ দেখলাম আওয়ামী লীগের ভাষাজ্ঞান পুরো নষ্ট আর বিলুপ্ত।
সকাল সন্ধ্যা: এই আন্দোলনের সমর্থনে সারাদেশে যেভাবে, যে সংখ্যায় মানুষজন রাস্তায় নেমে এসেছে এমনটা আমরা বিগত কয়েক দশকে আর কখনও দেখিনি। উনিশ শ নব্বই সালে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতন ও গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মানুষ বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠছে যে ছাত্র-তরুণরা তো কোটা সংস্কারের আন্দোলন করছিল— রেজিম চেঞ্জের আন্দোলন নয়। আর ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ তো কোনও ইশতেহার ঘোষণা করেনি যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র কীভাবে চলবে— বা তারা কী চায়? এরা তো কোনও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম না, তাদের ঘোষিত কোনও লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই। যেমন বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, বা হেফাজতের মতো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কথা আমরা জানি কিন্তু এই ছাত্রআন্দোলনের নীতি কি সেটা আমরা জানি না। এই অবস্থায় ছাত্রদের দুই সমন্বয়ক প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে একটি র্অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সলিমুল্লাহ খান: একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকান। ১৯৪৭ সনের পর এই দেশে অনেক গণআন্দোলন হয়েছে। ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলন ঢাকা শহরকেন্দ্রিক ছিল, পরে জেলা শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসলেন ১৯৫৮ সনে। ১৯৬২ সনে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে কেন্দ্র করে একটা ছাত্র আন্দোলন হলো। ’৬৬ সালের ছয় দফার আন্দোলনটা আওয়ামী লীগের আন্দোলন। ব্যাপক জনগণ তখন তাতে ভিড় করেনি। ’৬৯-এর আন্দোলন শুরু হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে— লান্ডিকোটালে— ছাত্রদের উদ্যোগে। তাতে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ সর্বাত্মক সমর্থন দেয়। পাকিস্তানের ছাত্রনেতরাদের মধ্যে কেউ কেউ— যেমন তারিক আলী— তখন পূর্ব বাংলায় তশরিফ এনেছিলেন। ১৯৬৯ সনের ২০ জানুয়ারি যখন ছাত্রনেতা আসাদ নিহত হলেন— যিনি পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ), আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। এখনও আসাদ গেইট তার নামে আছে। তখন আরও মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গ্রামে গ্রামে তখন অনেক গরুচোর ধরা হয়েছে।
আইয়ুব খানের পতন হলো। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানে সামরিক শাসন আসল। সামরিক শাসন প্রথমেই ঘোষণা দিল— নির্বাচন দেব। তারা কতদিন থাকবেন বলেন নাই। ’৭০ সালের শেষনাগাদ তারা নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন। এর পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।
স্বাধীনতার পরেও অনেক আন্দোলন হয়েছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সন পর্যন্ত দেশে দারুণ সংগ্রাম চলেছে। তবে গণআন্দোলন হযনি। রাজনৈতিক সংগ্রাম চলেছে। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি, আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যাওয়া জাসদ এবং মাওলানা ভাসানী— সব মিলিয়ে প্রবল অথচ নিস্ফল সরকারবিরোধী আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করা আন্দোলন। তখন ‘কমিটি ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস’ গঠন করা হয়। সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়।
এরপর জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-গণআন্দোলন ৯ বছর পরে সফল হলো। এরপর এবারের মতো ব্যাপক আন্দোলন আর হয়নি। এর কারণ দুইভাবে দেখতে পারি। গত ১৫ বছর ধরে যে নাগরিক অধিকারহীনতা তার বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ। কোটা সংস্কারের দায় সেই প্রদীপের শিখা মাত্র। তলায় ঘটনার অনেক তেল, এইজন্যই আগুন এত তেজে জ্বলে উঠেছে। পদার্থ যখন দাহ্য থাকে ছোট্ট একটা ছোট্ট শলাকাও আগুন লাগাবে। গত দুই-তিন বছরে বিএনপি অনেকগুলো সমাবেশ করার চেষ্টা করেছে। কোনওটায় তারা সফল হতে পারেনি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের দ্রুত জেলে নেওয়া হয়েছে। এই সময় বিএনপি সাফল্য অর্জন করতে পারে নাই, জামায়াতের সহায়তা নিয়েও পারে নাই। ছাত্ররা পারল কেন? সাধারণ ছাত্রদের ব্যাপক সমর্থন নতুন নেতারা অর্জন করেছেন। তাঁদের ঘোষিত বড় সংগঠন ছিল না। এখন শোনা যায় ছাত্রদের একটা আধাগোপন সংগঠন ছিল। ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামে। বলা হয় ওঁদের কোনও মেনিফেস্টো ছিল না। তবে সকলেই জানত কিছু একটা ছিল।
আমাদের সবার ভোটাধিকার ছিল না, আমরা ভোটাধিকার ফেরত চাই। ছাত্ররা এটাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছে। এটা তাদের মুখ্য কর্মসূচি ছিল না। দুই নম্বর— অনেক মানুষ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। এমনকি সামরিক বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মেজর সিনহা ) কক্সবাজারে খুন হয়েছেন। গুলি করেছেন পুলিশের কর্তা আর সহযোগীরা। এর ন্যায়বিচার হয়নি। এই মামলা এখনও ঝুলে আছে।
এইগুলো মানুষের মনে একটা অবিচারের বোধ তৈরি করেছে। বিশেষ করে জাতীয় পুলিশ বাহিনীকে— রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীকে, যার সদস্য সংখ্যা দুই লাখ বা আড়াই লাখেরও বেশি, সেটাকে সরকার ব্যক্তিগত বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। এইগুলো মানুষের মনে বিক্ষোভ তৈরি করেছে। এই কারণে থানায় থানায় আক্রমণ হলো। থানায় আক্রমণ হওয়াটা উৎসাহিত করছি না, তবে সত্যের খাতিরে এর ব্যাখ্যা করতে হবে।
এইজন্য বলছি, ব্যাপক অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটা— লিখিত না হলেও— একটা মেনিফেস্টো বটে। মানুষ কি চায়? গত ৩১শে জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটা প্রতিবাদী সমাবেশে আমিও বলেছিলাম যে, সরকারের পদত্যাগ ছাড়া আমরা নতুন কোনও কিছু শুরু করতে পারব না। পদত্যাগ নতুন কিছু শুরু করার পূর্বশর্ত। নতুনটা কি? এতদিন দখলদার সরকার যা যা করেছিল তার বিপরীতটা করতে হবে। কোনও ক্রসফায়ার হবে না। কোনও গানফাইট হবে না। কোনও কাউন্টার ইনসার্জেন্সি হবে না। আমেরিকানরা দীর্ঘদিন ধরে প্রেসক্রাইব করে আসছে সারা পৃথিবীতে— জঙ্গি বলে হত্যা কর। এটার নাম কাউন্টার ইনসার্জেন্সি— বিদ্রোহদমনের ব্যবস্থা। সারা পৃথিবীতে তারা করেছে। এসব বন্ধ করতে হবে।
এই দাবিগুলো যদি মেনিফেস্টোতে নাও থাকে নতুন সরকারের দায়িত্ব এগুলো বন্ধ করা। ছাত্রদের এই আন্দোলনের ফলেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। ছাত্ররা একা নয়— সৈনিকেরাও এ আন্দোলনকে সমর্থন করেছে। শেষ মুহূর্তে সৈনিকেরা যখন বন্দুক তাদের নিয়োগকর্তাদের দিকে ঘুরিয়ে দেয় অথবা আদেশ অমান্য করতে শুরু করে তখন বিদ্রোহের মুহূর্ত হাজির।
সকাল সন্ধ্যা: আপনার কথায় বারবার সৈনিকদের কথা আসছে— পুলিশ বাহিনীর কথা আসছে। আমরা দেখলাম যে, হাসিনা সরকার শুরুর দিকে আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে দমন-পীড়ন থেকে শুরু করে পুলিশ বাহিনী দিয়ে দমনের চেষ্টা করল। অন্যদিকে, আন্দোলন যখন একেবারে তুঙ্গে তখন ভয়াবহভাবে থানা আক্রমণ হয়েছে, বিটিভি ভবনে আগুন দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন সরকারী স্থাপনায়, মেট্রোরেল থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় আগুন দেওয়া হয়েছে। আবার চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা দেখলাম, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের কথা জানিয়ে সেনাপ্রধান ভাষণ দিলেন জাতির উদ্দেশ্যে। সেনাপ্রধান আশ্বস্ত করেছিলেন, আমরা দায়িত্ব নিচ্ছি— আর কোনও সহিংসতা হবে না। কিন্তু তখন আমরা দেখলাম একদিকে সেনাপ্রধান ভাষন দিচ্ছেন আরেকদিকে গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংসদ ভবন সবখানে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ল এবং নজিরবিহীন লুটপাট হলো। এগুলো সবই রাষ্ট্রীয় সম্পদ— জনগণের সম্পদ— এগুলোর ভেতরে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল থাকার কথা। কিন্তু এগুলো যেভাবে বিনাবাধায় লুন্ঠিত হলো এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সলিমুল্লাহ খান: এটা আমার দেখা না দেখার ওপর নির্ভর করে না। পৃথিবীর যেখানেই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে— যতটুকু আমাদের ঐতিহাসিক স্মৃতি আছে, সেটা কি পরাধীন ভারতে, কি স্বাধীন ইউরোপে সব জায়গায় এমনটাই হয়েছে। ফরাসি বিপ্লব থেকেই ধরুন। বিপ্লবের সূচনার দিন যদি ধরা হয়— (গ্রামাঞ্চলে আগে দুই বছর ধরে বিক্ষোভ হচ্ছিল, সেটা বাদ দিলে) ১৭৮৯ সনের ১৪ জুলাই, প্যারিসের কুখ্যাত বন্দিশালা ‘বাস্তি দুর্গ’ আক্রমণ করা হলো (সেখানে তখন বেশি বন্দি ছিল না), কিন্তু এটার কুখ্যাতি ছিল। দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক বন্দিদের সেখানে রাখা হতো— সাধারণ বন্দিদেরও রাখা হতো। ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের বয়স দীর্ঘ ছিল, ১০০০ বা ৮০০ বছরের মতো। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিক্ষোভটা— কত মানুষকে যে তারা হত্যা করেছে বিনা বিচারে তার ইয়ত্তা নাই— ওই দুর্গের ওপর গিয়ে পড়ল। মানুষ সেই দুর্গটা ভেঙে ফেলল। তারপর মানুষ গেল ভার্সাই রাজপ্রাসাদে। যেটা প্যারিস থেকে ১০-২০ মাইল দূরে। সেখানে গিয়েও আক্রমণ করল। বিপ্লবের লক্ষণই হচ্ছে, ভাঙচুর করে, জ্বালাও পোড়াও করে।
ভারতবর্ষীয় ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পরে যখন কৃষকেরা অভ্যুত্থানে যোগ দিলেন তখন তারা যত কালেক্টরেট, যত তহশিল অফিস— ধ্বংস করেন, নথিপত্র পুড়িয়ে দেন। তাদের ধারণা, এই নথিপত্রই ছিল শোষণ করার হাতিয়ার। অত্যাচারের হাতিয়ার। কৃষককে তো আপনি বক্তৃতা দিয়ে শেখাবেন না, তারা জিনিসটা কীভাবে দেখে সেটাই আমি বলছি। আমি সঠিক না বেঠিক কিছুই বলছি না— ঘটনার বিবরণ দিচ্ছি। এইখানেও এই ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে। এখানে যে সামরিক বাহিনী তারা তখনও দ্বিধাগ্রস্ত। একাংশ একদিকে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করাচ্ছেন, একটা অংশ পদত্যাগের পক্ষে ছিল না— ছিল সামরিক আইন জারি করার পক্ষে। মানে তারা প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করার দলে। এসব কথা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে।
মিউজিয়াম বা পাঠাগার আক্রমণ করা ঠিক নয়। ইরাক যুদ্ধে বিদেশিরা জেতার পর আমরা কি দেখেছি? মিউজিয়ামে থাকা কয়েক হাজার বছরের আর্টিফ্যাক্ট পশ্চিমে পাচার হয়ে গিয়েছে— ইউরোপে চলে গিয়েছে। আমরা দুঃখ করেছি তখন।
বাংলাদেশে কি কি হয়েছে আমরা এখনও পুরা জানি না। বিশেষত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে যে লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম ছিল এটা মানুষ পুড়িয়ে দিয়েছে। তাতে অনেক অমূল্য সম্পদ পোড়া গেছে। এগুলো অমূল্য সম্পদ। এ কথা আমি ওইদিন ৫ আগস্টই বলেছিলাম ডয়েচে ভেলের খালেদ মহিউদ্দিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। ঘটনাটা দুঃখজনক। এটা রোধ করার দরকার ছিল। শুনলাম বড় বড় ধনকুবেরের বাড়ি থেকে লোকে ছবিটবি নিয়ে গেছে। নাকি বড়লোকেরাই সরিয়ে ফেলেছেন?
জনগণের রোষের ফলে এমনটা হয়। সেনাবাহিনী কেন এসব রক্ষা করার ব্যবস্থা নিলেন না? তারা নিজেরাও কি সামর্থ্যের অভাবে ভুগছিলেন? এসবের ফলে আমরা জাতিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
যারা নতুন বৈষম্যবিরোধী— নবযুগের তরুণেরা, তাঁদের স্বপ্ন কি!
সকাল সন্ধ্যা: এক্ষেত্রে আমরা আরও দেখলাম যে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আরেক ধরনের নাশকতা হলো। সারা দেশে লুট ও ভাংচুরের পাশাপাশি যেখানে যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ছিল সেই ভাস্কর্যগুলোকে ভাংচুর করা হয়েছে। এমনকি আমরা দেখেছি, আনসার বাহিনীর সদস্যরাও ভাস্কর্য ভাঙছে। শুধু যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে তাই নয়— মুক্তিযুদ্ধের অনেক ভাস্কর্য— ভাষা আন্দোলনের ভাস্কর্য, মেহেরপুরে একাত্তরের মুজিবনগর সরকারের যে স্মৃতি কমপ্লেক্স আছে সেখানে প্রায় সাড়ে তিনশ’র মতো ভাস্কর্য ছিল— সেগুলোও সব ভাঙা হয়েছে। ফুলার রোডে অনেক ভাস্কর্য ছিল সেগুলোও ভাঙা হয়েছে। সোহরাওয়াদী উদ্যানে নির্মাণাধীন ভাস্কর্যগুলোও ভাংচুর করা হয়েছে। আবার ময়মনসিংহের শশী লজের ভেনাস মূর্তি ভাঙা হয়েছে। একইসময়ে কিছু মন্দির ও মাজারেও ভাঙচুর হয়েছে, আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব কারা করল? অবশ্য আমরা দেখেছি, ইসলামপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ভাস্কর্য নির্মাণের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছে, প্রকাশ্যে ভাস্কর্য ভেঙ্গেছে। ২০০৮ সালেও বিমানবন্দরের সামনের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভেঙ্গে তারা বলেছে, বাংলাদেশে কোনও ভাস্কর্য থাকবে না। আমরা আরও দেখলাম, একদিকে ভাস্কর্য ভাংচুর হচ্ছে আরেক দিকে অভ্যুত্থানের পর কিছু শিল্পীরা শহীদ মিনার এলাকাসহ নানা জায়গায় ক্যালিগ্রাফি করছেন— নানারকমের শ্লোগান লিখছেন। এরপর এখন বিতর্ক উঠছে ‘সেকুলার বাংলাদেশ’ বনাম ‘ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ’ নিয়ে। আমরা কি গণঅভ্যুত্থানের ভেতর থেকে জেগে ওঠা আরেকটা নতুন সাংস্কৃতিক লড়াই দেখতে পাচ্ছি? আপনার কী মনে হয়?
সলিমুল্লাহ খান: লড়াই চলতেই থাকবে। চিরস্থায়ী শান্তি বলে কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের যা কিছু অর্জন তা যদি রক্ষা করতে চান, আপনার মুক্তিযুদ্ধের আদ্য চেতনাটাই রক্ষা করা উচিত ছিল— আদ্য চেতনার নাম “সাম্য-মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার”। শেখ হাসিনা নিজে ও তার দল আওয়ামী লীগ ভয়াবহভাবে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা করেছেন । তাদের কথা— তারাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: ‘‘আমার বাবা দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন।’’ দেশ স্বাধীন হয়েছে একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। দেশের তরুণেরা, শ্রমিকেরা, কৃষকেরা, ছাত্রেরা, যুবকেরা লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছেন। যে কারণেই হোক। তিনি যুদ্ধ করেননি। বন্দী ছিলেন। সুতরাং দেশটা তিনি স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন— কথাটা অসত্য। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব জিনিসকে তিনি বিপদগ্রস্ত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক শাসনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
সাংস্কৃতিক লড়াই প্রসঙ্গে বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ (তখন চারুকলা ইনস্টিটিউট) এরশাদের পতন আন্দোলনের সময় পহেলা বৈশাখে এক ‘‘আনন্দ শোভাযাত্রা’’ (১৯৮৯) শুরু করেছিলেন। পরের বছর সেটার নাম ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ হলো (১৯৯০)। এরপর বিএনপি আমলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণ আন্দোলনের সময়ও তারা প্রতিবাদী চেতনা নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসল এবং এরপর থেকে তারা সেই রাজনৈতিক চেতনা বিকিয়ে দিলেন। বিগত দেড় দশক ধরেও দেখা যাচ্ছে বছরের পর বছর ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’র নামে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছেন। কিসের মঙ্গল? কার মঙ্গল চাইলেন তারা? তারা কি জনগণের সমর্থন বঞ্চিত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মঙ্গল চাইলেন? তারা কি জনগণের মঙ্গল চাইলেন?
জনগণের মঙ্গল চাইলে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার— সেটা একদিনও করেননি তারা, তাহলে মানুষের রোষ কি তাদের ওপর পড়বে না? আমি তো মনে করি, যে ভাঙাভাঙি হয়েছে সেটা পরিমাণে অনেক কম হয়েছে। আরও বেশি হতো বলে আমরা আশঙ্কা করেছিলাম। এসব আক্রমণের জন্য শেখ হাসিনার লীগ সরকার দায়ী। তারা মুক্তিযুদ্ধের অপমান করেছেন। সর্বজনীনকে করেছেন সদলীয়। কাজেই মানুষ তাদের দলকে আক্রমণ করতে গেলে মনে হবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আক্রমণ হয়েছে।
একটি কথা বলি, ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের যে মূর্তিগুলো বাংলা একাডেমিতে নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো কি তাদের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? একজন শিল্পী হিসেবে আপনিই বলেন? কি পদার্থ দিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়েছে? এগুলো কি শিল্পমানসম্মত? এগুলো বড়জোর ডেকোরেশন পিস। অ্যাডভার্টাইজমেন্টের মতো। কোনও কোনও ভাঙনকে তাই বলতে হবে ন্যায়বিচার বিশেষ।
শহীদ মিনারও তো ভেঙে দিয়েছিল পাকিস্তান আর্মি। তারা জানত, এই শহীদ মিনার বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলনের সূতিকাগার। তাই তারা ভেঙেছিল। কিন্তু আমরা আবার নির্মাণ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে একটা বট গাছ ছিল সেটা তারা কেটে ফেলেছিল। স্বাধীনতার পরে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এসে সেই গাছ আবার রোপণ করেছেন। সেটা আবার বড় হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য যারা ধারণ করতে চান তারা আবার মূর্তি বানাতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে যেসব ভাস্কর্য ছিল— সবিনয়ে নিবেদন করছি— সেগুলো কি কোনও ভাস্কয পদবার্চ্য? শিল্পী শামীম শিকদারের করা ভাস্কর্যগুলো তো ভেঙে ফেলাই উচিত। শিল্পী হিসেবেই ভেঙে ফেলতে চাইতাম। এগুলোকে ব্যঙ্গচিত্রের মতো মনে হয়। ফ্যাসিস্ট ও অটোক্রেটিক রেজিমের পক্ষেই— স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই এই ধরনের ভাস্কর্য রাস্তার পাশে স্থাপন করা সম্ভব। এগুলোর শিল্পমান শূন্যেরও নিচে— হিমাঙ্কের নিচে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভাস্কর্য ও স্মারক ভাঙচুর দুঃখজনক। এর দায় লীগ সরকারের।
সকাল সন্ধ্যা: এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে সে সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি? এই সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?
সলিমুল্লাহ খান: প্রত্যাশা দুই প্রকারের। যে যে কারণে বিগত সরকার— শুধু বিগতটা না— আগের সরকারও জনরোষের সামনে পড়েছে সে কারণ দূর করা একনম্বর কাজ। র্যাব বাহিনী বিগত সরকার গঠন করেনি— গঠন করেছিল এর আগের সরকার অধিক কি! ১৯৭৪ সালের স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল, পরে আর কেউ বাতিল করেননি ওটা। এতে বিনা বিচারে ১২০ দিন বন্দি রাখার বিধান আছে। এই ক্ষমতাটা বার বার বাড়ানো যায়। এই ক্ষমতা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে। সর্বশেষ সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট পর্যন্ত যত অবৈধ বিধি সব বাতিল করা চাই। আরেকটা উদাহরণ বৈধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। অনেক শ্রমিকের এই অধিকার নাই। নাই গার্মেন্টস শ্রমিকদের। এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের পেশাগত ইউনিয়ন করার অধিকার কার্যত নাই। এই ধরনের সব অগণতান্ত্রিক আইন বাতিল বা সংশোধন করতে হবে। বর্তমান সরকার সেটা করতে পারে। এটা তাদের প্রথম কাজ।
এখানকার স্বৈরশাসক নিছক ‘থার্ড ওয়াল্ড ফ্যাসিজম’ নয়— এরা ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট, বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ-এর সমর্থনধন্য ফ্যাসিজম আমাদের দেশে চলেছে। আনুমানিক ১৯৮০ সালের পর থেকে এটাই চলেছে। এটার পিতা স্ট্রাকচারাল রিফর্ম। এগুলোর পরে যতগুলো সরকার গঠিত হয়েছে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফ-এর কাছে মাথা নত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশমতো— ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নির্দেশমতো করেছে।
বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে এখনও ঘোষণা দেয়নি। তারা কি ট্রেড ইউনিয়ন রাইট ফেরত দেবেন? তারা কি সকল শিক্ষককে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেবেন? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতি আছে— এটা তাদের ট্রেড ইউনিয়ন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নাই কেন? বর্তমান সরকার কি সে অধিকার দেবেন?
বর্তমান সরকারের কাছে জনসাধারণের সবচেয়ে বড় চাওয়া দেশে নির্বাচন দিয়ে জনগণের ইচ্ছামাফিক সরকার গঠনে অবাধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যত প্রতিবন্ধকতা, নির্বাচন কমিশন গঠনসহ যত চোরাগলি সব আপদ বিদায় করতে হবে। এক কথায় নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার— এটা এই সরকারের দুই নম্বর বড় দায়িত্ব।
তৃতীয় দায়িত্ব, তারা অন্যান্য যে সকল সংস্কার করতে চান— গোষ্ঠীগত, পক্ষপাতমূলক, দুর্নীতিমূলক নিয়োগের মাধ্যমে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলোর আশু সংস্কার। যেমন শিক্ষায় কারিকুলাম আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এসব একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে অসাধু সিদ্ধার্থ ও অসৎ ব্যবসায়ীদের প্রাধান্যের ফলে। আরো অনেক মৌলিক সংস্কার করা দরকার।
শেষ কথা, কেউ এখন নিশ্চিত না এই সরকারের মেয়াদ কত। সরকারের মেয়াদ তার কর্মসূচি ও জনগণের অব্যাহত অনুমোদন-নির্ভর। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে যে যে সংস্কার করা অপরিহার্য তার আগে নির্বাচন দেওয়া যাবে না। এইটুকু সময় তো তাদের দিতেই হবে। তবে তারা যদি মনে করেন, নির্বাচন না করেই আমরা পাঁচ-দশ বছর রাজত্ব করব জনগণের সম্মতি মিলবে না। বর্তমান আইন অনুসারে পূর্ণাঙ্গ সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। এটা কমিয়ে সরকারের মেয়াদ চার বছর করা সম্ভব। নাগরিক অধিকার অনুসারে নির্বাচন দিয়ে নতুন জাতীয় সংসদ গঠন করা সরকারের দায়— এ সংসদের কাজ সংস্কারগুলি অনুমোদন করা।
একটা উদাহরণ দিয়ে বিশদ করি। জিয়াউর রহমানের সময় কতক সামরিক অর্ডিন্যান্সের বলে অনেক কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল। পরে একটা গণভোট দিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন। তারপর সংসদ নির্বাচিত হলো— ওই সংসদে পুরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিও ছিল। ঐ সংসদে পঞ্চম সংশোধনী পাশ হয়। সকল অর্ডিন্যান্স বৈধ ঘোষিত হয়।
জনগণের ইচ্ছাই সকল প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি। জনগণের ইচ্ছা প্রকাশের দুটো মাধ্যম। এক গণ অভ্যুত্থান। অন্যটা অবাধ নির্বাচন। প্রশ্ন হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা কি বস্তু? একটা ব্যাখ্যা এভাবে করা যায়: যথাসম্ভব দ্রুত অবাধ নির্বাচন সম্পন্ন করে ক্ষমতা হস্তান্তর।
অবাধ কথাটারও বহু অর্থ। অর্থনৈতিক বৈষম্য যে সকল সমাজে আমাদের দেশে যেমন তেমন তীব্র সেখানে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল গোষ্ঠর কেউ নির্বাচিতই হতে পারে না। এ দেশে যারা সারাজীবন ‘বৈষম্য বিরোধী’ আন্দোলন করেছেন, যাঁদের আমরা বামপন্থী বলি— সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ যাঁদের স্বপ্ন করেছে— আজ তাঁদের কি একটা অবস্থা!
এখন যারা নতুন বৈষম্যবিরোধী— তারা, নবযুগের তরুণেরা, তাঁদের স্বপ্ন কি! দেখা যাচ্ছে তাঁদের অনেকে কি চাইছেন জানেন না। একটা উদাহরণ দেই। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের নাম বিগত সরকার দিয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়ে’। নামটা উঠিয়ে দিয়ে কে বা কারা যেন ওটার নাম রেখেছেন ‘জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এক্সপ্রেসওয়ে’। বোঝা যাচ্ছে এটা সংঘবদ্ধ কোনও গোষ্ঠীর কাজ। হযরত ইব্রাহিমের (আ.) নামে রাস্তার নাম দেওয়া যেতেই পারে। তবে তাঁকে জাতির পিতা বলতে হবে কেন? হযরত শাহজালালের নামে বিমানবন্দর তো আছেই। কেউ আপত্তি করেননি। হযরত ইব্রাহিম (আ.) কোন জাতির পিতা? এই ধরনের বাড়াবাড়ি কল্যাণকর হবে না।
সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সলিমুল্লাহ খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রকাশ: সকাল সন্ধ্যা, ১৯ আগস্ট ২০২৪