এত এত প্রাণের বিনিময়, এই দীর্ঘকালীন গণবিক্ষোভ শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারকে টলিয়ে দিতে সফল হয়েছে। সোমবার গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাফল্য মিললেও এখনও যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে। ছাত্রদের প্রথমে দাবি ছিল, তথাকথিত সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ অর্থাৎ কোটা সংস্কার। ন’দফা দাবি যেভাবে ক্রমে এক দফা দাবিতে পরিণত হল, সেটা প্রাথমিক সাফল্য। গত পনেরো বছরের একনায়কীয় শাসনের ফলে দেশ জুড়ে যে সমস্ত সমস্যা, বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে, তারই একটা বড়সড় বহিঃপ্রকাশ এই আন্দোলন। সেই জায়গা থেকে দেশকে পুনর্গঠিত করার দিকে এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ সেটা যেমন ভালো দিক, তার একটা আশঙ্কার জায়গা রয়েছে। জনরোষে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা। বিভিন্ন জায়গায় বিরোধীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আগুন দেওয়া হচ্ছে থানা-সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কেন্দ্রে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ধর্ম-সম্প্রদায় ধরে দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করছে কেউ কেউ। আর এটাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কার্যত আন্দোলনের মূলচরিত্রের সঙ্গে এ একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।
তরুণ ছাত্রেরা বারবার বলছেন, আমাদের দেশে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু এই বোধ যেন না থাকে। সবাই সমান নিরাপত্তা পাবে। কোটা বিরোধী আন্দোলনের মূল নীতিই ছিল মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ। একমাত্র অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্যই কিছু কিছু কিছু সংরক্ষণ থাকতে পারে দাবি তুলেছিল তারা। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততি এমনকী তাঁদের নাতিপুতিদের জন্যেও ৩০ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছিল— সেই সমস্ত কিছুও কাজ করেছে এই বিক্ষোভের নেপথ্যে। একই সঙ্গে দেশের জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে কৌশলগত ভাবে নির্বাচনবিহীন সরকার গঠন করার যে ধারা চলছিল বাংলাদেশে, সেটাও একই রকম ভাবে মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। আসলে ভোটাধিকার বা নির্বাচন তো একভাবে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। যেখানে জনগণের মতামতে শাসক নির্বাচিত হয়, সেই জায়গাটাকে এতদিন ধরে অস্বীকার করা হয়েছে দেশে।
এখানে আসলে অনেকগুলি সমস্যা একসঙ্গে এসেছে। তরুণ ছাত্রছাত্রী, বিক্ষোভকারী যাঁদের সমন্বয়কের সংখ্যা এখন প্রায় শ-খানেকেরও বেশি। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন মতের লোক যে থাকবেনই, ,সেটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা, এই তরুণেরা চেষ্টা করেছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন— কী ভাবে এই জগদ্দল পাথর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আর সেটা প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। এর পরের পদক্ষেপ কী হবে, তা দেখার জন্য এখানে অনেক রকম গোষ্ঠীর মানুষজন রয়েছেন। আবার তাঁদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ রয়েছেন, যারা নিজেরা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীদের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবেন। এমনকী তাঁদের বিপথগামীও করতে পারেন। সেই জায়গাটা যাতে তৈরি না হয়, তা দেখতে হবে।
তবে দেশে এখন প্রাথমিক প্রয়োজন একটা প্রশাসন গড়া। এই মুহূর্তে দেশে কোনও দায়িত্বশীল প্রশাসন নেই। সামরিক বাহিনী আসলে কোনও রকমে কতগুলো স্থাপনা আগলে রেখেছে। বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় আগুন লাগানো হচ্ছে, আর এটা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চরিত্রের একেবারেই অনুরূপ নয়। এই আন্দোলন যেহেতু বহুদলীয়, বহুশ্রেণির এবং বহুগোষ্ঠীর, ফলে সেখানে নেতৃত্বের জন্য প্রতিযোগিতা থাকবেই। অসীম সাহস ও বীরত্ব দেখিয়ে যে সমস্ত ছাত্রনেতারা আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, যাঁদের বেশিরভাগেরই বয়স পঁচিশেরও কম। সেখানে নারী-পুরুষ উভয়েরই প্রাধান্য রয়েছে। রয়েছে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলের প্রতিনিধিত্বও। তার পরেও কোনও কোনও গোষ্ঠী সঙ্ঘবদ্ধ, এমনকী এই আন্দোলনের শেষে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিএনপি ও জামাত-ইসলামের মতো বেশ কিছু সংগঠিত রাজনৈতিক দলও। যে জামাতকে কিছুদিন আগেই হাসিনা সরকার আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ক্রোধ এবং তাঁদের নীতিগত পদ্ধতিগুলো যে তারা প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে। তবে আন্দোলন হাইজ্যাক হয়ে যাচ্ছে, এই কথাটা এখনই বলা বোধহয় বেশিই তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে। কিন্তু দেশে বিভিন্ন শক্তি আছে তা ভুললে চলবে না। এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করাই প্রথম পদক্ষেপ বাংলাদেশে। একই সঙ্গে এখনও সংসদ বিলুপ্ত করা হয়নি। ফলে বলাই যায়, এখনও অনেকগুলি বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে।
প্রত্যেক আন্দোলন নিজের বৈধতা নিজেই উৎপাদন করে। অনেকে পুরনো সংবিধানের দোহাই দেবেন। আমাদের সংবিধানের মূল ভিত্তি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। আরেকটু বাড়িয়ে বলব, এটা ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামের ঐতিহ্য থেকেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা সংগ্রহ করেছি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে প্রাদেশিক অবস্থান পাকিস্তানের ভিতরে, তা থেকেও আমরা অনেক অনুপ্রেরণা নিয়েছি। যেমন ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ— এগুলি অবলম্বন করে বলব, মানুষের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল সামাজিক সাম্য। শুধু হাসিনার পনেরো বছরে নয়, উন্নয়নের নামে গত ৫০ বছরে যা হয়েছে, সেটাকে বলা হয় অসাম্যের রাজনীতি। কার্যত মানবিক মর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করা হয়েছে। গোষ্ঠীগত ভাবে সমাজে উত্তরাধিকার প্রথা চালু করা যাবে না। এর নাম প্রজাতন্ত্র হলেও কার্যক্ষেত্রে রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। ফ্রান্সের বিপ্লবের সময় যেমন দুটো গোষ্ঠী ছিল, বুরবো ও অরলিন্স, বাংলাদেশেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে। একটা শেখ মুজিবর রহমানের বংশ, অন্যটা জিয়াউর রহমানের বংশ। এই দ্বিধাবিভক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিকে দুই পারিবারিক ঐতিহ্য়ের মধ্যে বিভক্ত করে রেখেছে। কিন্তু এটা তো রাজতন্ত্রের লক্ষণ। গণতন্ত্রের লক্ষণ হওয়া উচিত এমন, যেখানে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে। তিনি বা তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন, যাদের সেই জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগ রয়েছে। আশা করি সেই নতুন অধ্যায় আমরা খোলার চেষ্টা করতে পারব।
প্রথম প্রকাশ: inscript.me, ৫ আগস্ট ২০২৪