প্রবন্ধ

বাঙালি মুসলমানের মন অথবা অলৌকিকতার ভূত

Spread the love

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও আরবী হরফে বাংলা পুঁথিপত্র যে লেখা হয়েছে সেটাকে ক’জন অবসরভোগী পুঁথিলেখকের নিছক খেয়াল মনে করলে ভুল করা হবে। আসলে তা ছিলো বেহেশতের ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
—আহমদ ছফা

আহমদ ছফা প্রণীত বাঙালী মুসলমানের মন নামক রচনাটি প্রকাশিত হইয়াছিল আজ হইতে কিছু কম পঞ্চাশ বছর আগে—বাংলা ১৩৮২ সনের ফাল্গুন (ইংরেজি ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি) মাসে। প্রায় দুই দশক পর—ইংরেজি ১৯৯৩ সালে—‘প্রসঙ্গ: বাঙালী মুসলমান’ নামক আরেকটি রচনায় তিনি আদ্যের লেখাটা কেন লিখিলেন তাহার একদফা কৈফিয়ত পেশ করিয়াছিলেন। কথাটা লেখকের জবানেই পেশ করিতেছি:

আমি দীর্ঘকাল ধরে ভেবে আসছি, বাঙালী মুসলমান সমাজ পিছিয়ে আছে কেন? অনেকভাবেই সেটা অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেছি, সম্পূর্ণ সদুত্তর পেয়ে গেছি এমন কথা আমি বলব না, তবু আমার কাছে মনে হয়েছে ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালী মুসলমান জনগোষ্ঠী একটি নির্যাতিত, নিষ্পেষিত সমাজ। এইটাই তাদের পিছিয়ে থাকার মুখ্য কারণ। অন্য অনেক কারণ আছে, সেগুলো গৌণ (ছফা ২০০৮খ: ২৫০)।

প্রবন্ধকার অনুযোগ করিয়াছিলেন, বাংলাদেশে এমন কিছু জ্ঞানীগুণী মানুষ আছেন যাঁহারা—নিজেরা বাঙালী মুসলমান সমাজের অন্তর্গত হইয়াও—এই পিছিয়ে থাকা সমাজটিকে লইয়া শুদ্ধ ঠাট্টাবিদ্রুপ করেন আর এমন সব কথাবার্তা বলিয়া থাকেন যাহা শুনিয়া ব্যথিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তিনি লিখিয়াছিলেন, “আমি ব্যথিত হই এ কারণে নয় যে এঁরা যেসব কথাবার্তা বলছেন সেগুলো অসত্য। তাঁদের মনের ভালবাসাটির অভাবই আমাকে ব্যথিত করে সবচাইতে বেশি” (ছফা ২০০৮খ: ২৪৯)।

বিশেষ কাহারও নামোল্লেখ না করিয়া আহমদ ছফা লিখিয়াছিলেন, “বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন যাঁরা বাঙালী মুসলমান সম্পর্কে আবোল-তাবোল অনেক কথা বলেন, কিন্তু এই অধঃপতিত পিছিয়ে পড়া সমাজের প্রতি তাঁদের একটি কর্তব্যবোধ আছে সেটা তাঁরা অনুভব করেন এমন কদাচিৎ মনে হয়ে থাকে। সমাজ রসাতলে যাক—তাতে এই ভদ্রলোকদের বা ভদ্রমহিলাদের কিছু যায় আসে না। তাঁরা বড় লেখক, বড় চিন্তাবিদ, বিপ্লবী দুঃসাহসী লেখক-লেখিকা নামে ডাকলেই কৃতার্থ বোধ করেন” (ছফা ২০০৮ খ: ২৪৯)।

এই ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাদের কেহ কেহ মনে করেন, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন বলিয়াই বুঝিবা বাঙালি মুসলমানেরা পিছিয়ে আছেন। আহমদ ছফা কিন্তু তাঁহাদের সহিত একমত নহেন। তিনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করার কারণে বাঙালি মুসলমান সমাজ পিছিয়ে আছে মনে করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, বাঙালি মুসলমান সমাজ চিরকালই পিছিয়ে থাকিবে না (ছফা ২০০৮ খ: ২৫০)। এই বিশ্বাসের পেছনে যুক্তিও একটা আছে:

ইহুদীরা ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলমানদের চাইতে অনেক বেশী গোঁড়া, তবুও পৃথিবীর জ্ঞানীগুণী এবং বিজ্ঞানীদের একটি বিরাট অংশ এই ইহুদী সমাজ থেকে এসেছেন। মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতো মানুষও ইহুদী সমাজের প্রতি আনুগত্য ছিন্ন করেননি। সুতরাং ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের অবস্থা এরকম অধঃপতিত, সেটা সত্য নয়। তার কারণ অন্যত্র সন্ধান করতে হবে (ছফা ২০০৮খ: ২৫০)।

আহমদ ছফা বাঙালী মুসলমান সমাজের—বিশেষ বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের—দুরবস্থার সমালোচনায় অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তিনি ক্লেশ স্বীকার করিয়াছিলেন এই অবস্থার নিরাকরণের উদ্দেশ্যে—এই সমাজটি তাঁহার আপন সমাজ বলিয়া, বহিরাগত গবেষক সমাজের বাহবা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাধি অর্জনের প্রয়োজনে নয়। ‘প্রসঙ্গ: বাঙালী মুসলমান’ নামক নিবন্ধে তিনি অধিক জানাইতেছিলেন: ‘বাঙালী মুসলমান সমাজের অনেক সমস্যা, অনেক সংকট। অনেক সময় মনে হয় এগুলোর সংশোধন অসম্ভব। এ সমাজের কুসংস্কার, মূঢ়তা, সামাজিক জাড্য, পশ্চাৎপদতা দেখলে রাগে-দুঃখে, অপমানে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। এ সব সত্য, কিন্তু আমি অস্বীকার করি কি করে আমি এদেরই একজন” (ছফা ২০০৮খ: ২৪৮)?

আহমদ ছফা © ছবি: নাসির আলী মামুন / ফটোজিয়াম

আহমদ ছফার আদ্য রচনা—বাঙালী মুসলমানের মন—প্রকাশিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই এবনে গোলাম সামাদ দাবি করিয়াছিলেন, “বাঙালী মুসলমান কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে চায়নি। আর চায়নি বলেই সম্ভব হয়েছে আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যারা উইলিয়াম হান্টার লিখিত বিখ্যাত বই ‘দি ইণ্ডিয়ান মুসলমান্স’ পড়েছেন তারা জানেন, কি রকম দুর্জয় সাহস নিয়ে বাংলাদেশ থেকে বাঙালী মুসলমান ওয়াহাবী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে যেত দূর পাঞ্জাবে ও সীমান্ত প্রদেশের মতো অঞ্চলে যুদ্ধ করতে। কিন্তু ছফা সাহেবের লেখায় বাঙালী মুসলমানের ইতিহাসের এসব দিকের কোন পরিচয় নেই” (সামাদ ১৩৮৩; সামাদ ২০১৪: ১৮)।

অনেকদিন পর দেখিলাম—বলিতে হইবে, খানিকটা দুঃখের আর খানিকটা শোকের সহিত—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম একই দাবি পেশ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন: “সুখের বিষয়, আহমদ ছফা যেরকম স্থবিরতার চিত্র এ প্রবন্ধে এঁকেছেন বাঙালি-মুসলমানের ইতিহাস মোটেই সেরকম কিছু নয়। বরং তুলনামূলক গতিশীলতা ও প্রগতির ছবিই আমরা দেখি।” প্রস্তাবের পক্ষে তিনি সমকালীন—অর্থাৎ আহমদ ছফার রচনা প্রকাশিত হইবার পর আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন এমন—প্রাচ্য-বিশারদ পণ্ডিতদের গবেষণা আহরণ করিয়াছেন। বলিয়া রাখি, অসীম রায়ের গবেষণা অবশ্য আহমদ ছফার আগেই সম্পন্ন হইয়াছিল। সামান্য পরে সাধারণ্যে প্রচারিত সেই গবেষণাভর অধ্যাপক আজম দাবি করিয়াছেন, “বলে রাখা ভালো, ছফা ধর্মান্তরিত মুসলমান-জনগোষ্ঠীর সাথে বিদেশাগত মুসলমান-জনগোষ্ঠীর যেরকম জল-অচল দূরত্ব কল্পনা করেছেন, প্রকৃত বাস্তবতা সেরকম নয়’ (আজম ২০২১: ২০৫)।

‘মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের একটা বড় অংশ’ যে বিদেশাগত মুসলমান-জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত, সে সত্যে আজমের সন্দেহ নাই। তিনি অভিযোগ করিয়াছেন, আহমদ ছফা ইঁহাদের উপেক্ষা করিয়াছেন। তিনি—অসীম রায় ভরসা—লিখিয়াছেন, “দোভাষী পুথির আগের বাঙালি-মুসলমান সাহিত্যিকদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারী, যাঁদের অধিকাংশই পরিবারসূত্রে অন্যভাষী, এবং বহুভাষী পণ্ডিত; আর বাংলাভাষী খেটে-খাওয়া জনগোষ্ঠীর সাথে ইসলামি বিধি ও সংস্কৃতির পরিচয়-নির্মাণ তাঁদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অবদান” (আজম ২০২১: ১৯৩)।

এক্ষণে মনে পড়িতেছে, ১৯৭৬ সালে এবনে গোলাম সামাদের সহিত এক জায়গায় আহমদ ছফাও ঐকমত্য পোষণ করিয়াছিলেন: “ঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলমান সমাজের জাগরণের গুরুত্ব অস্বীকার করে আজকের সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা ভাবাই যায় না”। তবে সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রশ্নও করিয়াছিলেন তিনি: ঊনবিংশ শতাব্দীর যে সকল আন্দোলনকে হালফিল ‘মুসলমান সমাজের জাগরণ’ বলিয়া বাড়াইয়া আনা হইতেছে সেইগুলি কি সত্য সত্য বাঙালি মুসলমানদের কল্যাণ আর মঙ্গলের জন্য সংগঠিত হইয়াছিল? আহমদ ছফার মতে, তাহা হয় নাই কিন্তু। যদি হইত তবে—তাঁহার বিচারে—“বাঙালী মুসলমানের ইতিহাস আজ অন্যরকম” হইত। ছফা খালিচোখেই দেখিয়াছেন, মুসলমান সমাজে আছে মনীষীর অভাব, চিন্তার জড়িমা, আর সম্মোহনে আচ্ছন্নতা। তাঁহার মতে, বাঙালী মুসলমানদের বর্তমান দুর্ভোগের নিগূঢ় কারণ এই পরিস্থিতির মধ্যেই নিহিত (ছফা ১৩৮৩; ছফা ২০১৪: ২০)।

আহমদ ছফা সেদিন বেদনার সহিত খেয়াল করিয়াছিলেন, বাঙালী মুসলমান সমাজের মধ্যে ‘অদ্যাবধি কোন প্রণিধানযোগ্য মনীষী’র জন্ম হয় নাই। কেন হয় নাই তাহার ‘একগুচ্ছ সামাজিক কারণ’ও তিনি দেখাইয়াছিলেন। একটা উদাহরণের মধ্যে সেই গুচ্ছ হাজির করিয়াছিলেন তিনি। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামক সদ্য বর্তমান রাষ্ট্রের ইতিহাস টানিয়া আহমদ ছফা একটি অপ্রিয় সত্যও জাহির করিয়াছিলেন। এই জাতীয় সত্য হজম করা সকলের পক্ষে সহজ কার্য নয়। এই ঘটনা বাংলাদেশের উদীয়মান—আবু হেনা মোস্তফা কামাল যাহাদের বলিতেন ‘উদ্ভিদ্যমান’—মধ্যশ্রেণীর ইতিহাসে পরনির্ভরতা—এক জাতীয় পরাধীনতার অবসান হইতে না হইতেই আর জাতীয় পরাধীনতার স্বাদগ্রহণের বাধ্যবাধকতা—কেন হাজির হয় তাহার কারণটা ধরাইয়া দেয় (কামাল ২০০১: ৩৪১)।

এবনে গোলাম সামাদ সকাশে আহমদ ছফার সর্বশেষ প্রশ্নটি ছিল এই: “সামাদ সাহেবও আশা করি স্বীকার করবেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্য একটি দেশের সাহায্য আমাদের গ্রহণ করতে হয়েছে এবং তার ফলশ্রুতিস্বরূপ অনেকদিন পর্যন্ত অনেকটা আশ্রিত রাজ্যের মর্যাদা ভোগ করতে হয়েছে। এটা কেন হলো, তিনি বলতে পারেন কি।” (ছফা ১৩৮৩; ছফা ২০১৪: ২০)

এবনে গোলাম সামাদের পুরানা যুক্তিটি নতুন মোড়কে হাজির করিয়াছেন মোহাম্মদ আজম। পার্থক্যের মধ্যে, তিনি একটা খবর জানাইতেছেন: “সাম্প্রতিক বহু নির্ভরযোগ্য গবেষণায় এ নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে”। ‘সাম্প্রতিক গবেষণা’ বলিতে তিনি যে সকল সংবাদ পরিবেশন করিয়াছেন তাহার প্রণেতাদের মধ্যে আছেন অস্ট্রেলিয়ার অসীম রায় আর মার্কিন মুল্লুকের রিচার্ড ইটন। রায় মহাশয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে আজম যাহা বলিয়াছেন তাহাও আমরা দেখিয়াছি: “ছফা ধর্মান্তরিত মুসলমান-জনগোষ্ঠীর সাথে বিদেশাগত মুসলমান-জনগোষ্ঠীর যেরকম জল-অচল দূরত্ব কল্পনা করেছেন, প্রকৃত বাস্তবতা সেরকম নয়। সেরকম হওয়ার কোনো কারণও নাই।” তাঁহার কথায়: “আমরা আগেই বলেছি, বাঙালি-মুসলমানের ইতিহাসে যাঁদেরকে [সাংস্কৃতিক] ‘মধ্যস্থতাকারী’ বলা হয়েছে, তাঁরা প্রায় সকলে আদিতে ভিনভাষী, পরে বাংলাভাষী অর্থে বাঙালি। মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের একটা বড় অংশ যে এ ধারার, তাতে সন্দেহ নাই। এরা সংখ্যায় কম, কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে প্রভাবশালী ছিল। ইংরেজ-আমলের গোড়ায় এ শ্রেণিটাই বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছিল। ছফাও সে কথা বলেছেন” (আজম ২০২১: ২০৫)।

‘ছফাও সে কথা বলেছেন’—কথাটিতে এখানে সত্যের অপলাপ হইতেছে। কেননা অসীম রায় কথিত ‘সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারী’ শ্রেণী আর আহমদ ছফা বর্ণিত ‘শাসক নেতৃশ্রেণী’ হুবহু এক পদার্থ নহে । ছফার কথা খানিক উদ্ধার করিলে হয়তো স্পষ্ট হইবে প্রকৃত ঘটনা কি। মোগল শাসনের অবসান ঘটিবার পর মুসলমান অভিজাত শ্রেণী সম্পূর্ণ ধ্বংস হইয়া গেল। আহমদ ছফার বয়ান অনুসারে:

সত্য বটে, মুসলিম শাসনের অবসানের পর শাসক নেতৃশ্রেণীটির দুর্দশার অন্ত ছিল না। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে সাধারণ বাঙালী মুসলমান জনগণের একমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোন যোগসূত্র ছিল কি? আর মুসলমান জনগণের অবস্থা ইংরেজ শাসনের পূর্বে অধিকতর ভাল ছিল কি? নবাবী আমলেও যে সকল এদেশীয় ফারসী জানা কর্মচারী নিয়োগ করা হতো তাঁদের মধ্যে স্থানীয় হিন্দু কতজন ছিলেন এবং কতজন ছিলেন স্থানীয় মুসলমান, এ সকল বিষয় বিচার করে দেখেন না বলেই অতি সহজে অপবাদের বোঝাটি ইংরেজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাঁরা দায়িত্বমুক্ত মনে করেন (ছফা ১৯৮১: ১৯)।

অসীম রায়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে যদি কিছু কিছু বিদেশাগত মুসলমান এদেশে ‘সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারী’র ভূমিকায় অভিনয় করিয়া—কিংবা অভিবাসন বরণ, উপনিবেশ পত্তন, মায় জন্মগ্রহণও করিয়া—থাকেন, শেষ পর্যন্ত সমাজ-সংগঠনের নবরূপায়ণ কিন্তু করিতে পারেন নাই তাঁহারা। কারণ—আহমদ ছফার মতে—“মুসলিম শাসকেরাও স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে যে নেতৃশ্রেণী সংগ্রহ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাঙালী মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, রুচি এবং আচারগত দূরত্বের দরুন শাসক শ্রেণীর অভ্যাস, মনন রপ্ত করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাঙালী মুসলমান” (ছফা ১৯৮১: ২২)।

সত্য বলিতে, বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সহিত বিদেশাগত শাসকগোষ্ঠীর দূরত্ব শেষ পর্যন্ত জল-অচলই থাকিয়া গিয়াছিল—ইসলাম ধর্মের বহুলকথিত সমতার দোহাই সত্ত্বেও বাস্তব অবস্থা তাহা হইতে বিশেষ ভিন্ন হইতে পারে নাই। মোহাম্মদ আজমের ‘সাম্প্রতিক বহু নির্ভরযোগ্য গবেষণা’র তালিকায় রফিউদ্দিন আহমেদ প্রণীত ‘দি বেঙ্গল মুসলিমস্: ১৮৭১-১৯০৬’ পুস্তকটিও আশা করি থাকিবে। এই জল-অচল কুঠুরি ঊনবিংশ শতাব্দী নাগাদ কি ধরনের পরিবর্তিত রূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহার খানিকটা বিবরণ—প্রসিদ্ধ আশরাফ্-আতরাফ্ বিভাজন আকারে—রফিউদ্দিন সাহেবের গবেষণায় পাওয়া যাইবে (আহমেদ ১৯৮১)। অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদারও এই সম্পর্কের গোড়ার কথা কিছু কিছু বলিয়াছিলেন:

বহিরাগত মুসলমানগণ যখন বাংলার রাজশক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তখন সবচেয়ে উপরের স্তরে ছিলেন তুর্কী, হাবশী, আরব, ইরানি, পারসি, আফগান, [আর] মোগল রাজা-বাদশা ও প্রশাসকগণ। আর সমাজের নিম্নস্তরে ছিলেন নিম্নশ্রেণীর শুদ্র ও অন্ত্যজ হিন্দুদের মধ্য থেকে ধর্মান্তরিত কিছু দেশজ মুসলমান। কৃষক, জেলে, রংরেজ, সানাকর বা তাঁত প্রস্তুতকারক, কলু, নট, বাজনদার, বেদে প্রভৃতি বৃত্তিজীবীদের নিয়ে দেশী মুসলমানদের এই স্তরটি গড়ে উঠেছিল। উচ্চবিত্তের বিদেশী মুসলমানদের সঙ্গে এই বাঙালি মুসলমানদের কোনো সামাজিক যোগসূত্র ছিল বলে মনে করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। খুব সম্ভব এই শ্রেণীবৈষম্যই মোগল আমলে আশরাফ—আতরাফ স্তরবিন্যাসে তীক্ষ্ণভাবে চিহ্নিত হয়েছিল। প্রায় সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত আশরাফ-আতরাফের শ্রেণী-বিন্যাস বাঙালি—মুসলমানদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিদ্যমান ছিল (তরফদার ১৯৯৪: ৩৮)।

অধ্যাপক আজম দাবি করিয়াছেন, “পূর্ববঙ্গের আতরাফ মুসলমান সমাজ তখন [মানে—‘ইংরেজ-আমলের গোড়ায়’] মোটেই স্থবির হয়ে পড়ে নাই, বরং সংখ্যায় ও আর্থিক সামর্থ্যে বর্ধিষ্ণু ছিল। রাজপৃষ্ঠপোষকতায় নয়, একেবারেই কৃষির উৎপাদনশীলতার কারণে।” মার্কিন প্রাচ্যবিশারদ রিচার্ড ইটনের সিদ্ধান্ত অঙ্গীকার করিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ লিখিলেন: ‘উনিশ শতকের এ মুসলমান-জনগোষ্ঠী আদতে বড়জোর দু-তিনশ বছর বয়সী কৃষকসমাজ। এদের কৃষিজীবী হয়ে ওঠা, কৌম সমাজের বাইরে বিশ্বদৃষ্টির ভাগিদার হওয়া, এবং কেতাবহীন পূর্বদশা ছেড়ে কেতাবি সংস্কৃতিতে প্রবেশ করা—প্রত্যেকটিই আসলে বড় বড় পরিবর্তন ও প্রগতি” (আজম ২০২১: ২০৫)।

তাঁহার নিজের যোগ করা একফোটা শিশিরে কুয়াশা কাটিল না; নতুন কুজ্ঝটিকার সৃষ্টি হইল মাত্র: “দোভাষী পুথির প্রবল বিকাশ এবং নজিরবিহীন জনপ্রিয়তা এই বিকাশমান জনগোষ্ঠীর [বর্ধিষ্ণুতার?] অভ্রান্ত প্রমাণ। কাজেই এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থবিরতা আবিষ্কার করা আসলে কলকাতার বিকাশরেখা বরাবর একে মাপতে চাওয়ার জ্ঞানতাত্ত্বিক ত্রুটির পরিণতি মাত্র” (আজম ২০২১: ২০৫)।

এবনে গোলাম সামাদের কথা মনে পড়িতেছে। আহমদ ছফার রচনাটি যখন ‘সমকাল’ পত্রিকায় ছাপা হইল, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আপত্তি করিয়াছিলেন। ছফা লিখিয়াছিলেন:

যেহেতু নবদীক্ষিত মুসলমানদের বেশীর ভাগই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু, তাই আর্য সংস্কৃতিরও যে একটা বিশ্বদৃষ্টি এবং জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে একটা প্রসারিত বোধ ছিলো, বর্ণাশ্রম ধর্মের কড়াকড়ির দরুন ইসলাম কিংবা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বে সে সম্বন্ধেও তাঁদের মনে কোন ধারণা জন্মাতে পারেনি। পাশাপাশি ইসলামও যে একটা উন্নততর দীপ্তধারার সভ্যতা এবং মহীয়ান সংস্কৃতির বাহন হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে একটা সামাজিক বিপ্লব সংসাধন করেছিলো, বাঙালী মুসলমানের মনে তার কোন গভীরাশ্রয়ী প্রভাবও পড়েনি বললেই চলে (ছফা ১৯৮১: ১২)।

এবনে গোলাম সামাদ মন্তব্য করিয়াছিলেন: “ছফা সাহেবের বক্তব্যের সঙ্গে মিল আছে বঙ্কিমচন্দ্রের। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বাঙালীর উৎপত্তি’ নামক প্রবন্ধে বলেছিলেন বাঙালী সমাজের নিম্নস্তরেই বাঙালী অনার্য বা মিশ্রিত আর্য ও বাঙালী মুসলমান” (সামাদ ১৯৮২; সামাদ ২০১৪: ১৬)। জবাবে আহমদ ছফা নিবেদন করিয়াছিলেন: “আমি বাঙালী মুসলমানদের অধিকাংশকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বংশধর বলেছি। এটাকে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের মত বলে অভিহিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র সাম্প্রদায়িক কিন্তু তাঁর বক্তব্য ইতিহাসসম্মত হয়ে থাকলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে নিতে বাধাটা কোথায়!” (ছফা ১৩৮৩; ছফা ২০১৪: ১৯)!

‘জ্ঞানতাত্ত্বিক ত্রুটি’টা প্রকৃত প্রস্তাবে কাহার সে বিচার এখনও হয় নাই। অধ্যাপক রিচার্ড ইটন অনেক চমকপ্রদ কথা হাজির করিয়াছেন বটে, তবে মোগল যুগের শেষ নাগাদ কি ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে শান্তি এবং সমৃদ্ধির যে গোলাপী চিত্রটা তিনি আঁকিয়াছেন তাহা খানিকটা মেকি। তাহাতে কোন সংঘাত নাই। কেবল কাঠুরিয়া আর কৈবর্তের দল সানন্দে বনভূমি আর জলাজঙ্গল ছাড়িয়া ধান্যচাষী বনিতেছে। এই ছবির সহিত অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরীর অঙ্কিত ছবিটাও যদি মিলাইয়া দেখেন তো গোলাপি রঙটা অনেকখানি ঘোলাটে দেখাইবে (রায়চৌধুরী ১৯৬৯: ৮২-৮৭; শিরিন মুসবি ২০১৮: ১৯৮)।

অধ্যাপক ইরফান হাবিব বহু আগেই দেখাইয়াছিলেন, আকবর আর জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলাদেশের কৃষকদের উপর মোগল জায়গীরদারীর অত্যাচার কম চলে নাই। তাহাতে কৃষির উন্নতি কি সমৃদ্ধিও ঢের ব্যাহত হইয়াছিল। মোগল আমলে যে জায়গীরদারদের ইক্তা বা খাজনা এলাকা ভাগ করিয়া দেওয়া হইত তাঁহাদের অন্যত্র বদলি হওয়াটাই ছিল প্রশাসনিক রেওয়াজ। তাঁহারাও পদোন্নতি অথবা বদলির হুকুম পাইয়া অন্য প্রদেশে চলিয়া যাইতেন। রায়চৌধুরী মহাশয় দেখাইয়াছেন, এই কারণে মোগল জায়গীরদারগণ বাংলা ভাষা কিংবা সাহিত্যে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। তাঁহার মন্তব্য যদি অভ্রান্ত নাও হয় তবুও কবুল করিতে হইবে, হোসেন শাহের আমলের তুলনায় বলিতে মোগল আমলে বাংলা সাহিত্য হীনবীর্যবান আর উদ্যমহীন হইয়া পড়ে (হাবিব ১৯৯৯: ৩৬৪-৭৩; রায়চৌধুরী ১৯৬৯: ৮৭)।

আহমদ ছফার বক্তব্য আরো একটু গোড়ায় গিয়াছে: “বাঙালী মুসলমানেরা শুরু থেকেই আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দুর্দশার হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে ক্রমাগত ধর্ম পরিবর্তন করে আসছিল কিন্তু ধর্ম পরিবর্তনের কারণে একটা সামাজিক প্রভুত্ব অর্জনের [বাসনার] উন্মেষ হলেও তাদের জাগতিক দুর্দশার অবসান ঘটেনি”। অধিক কি: “বারবার ধর্ম পরিবর্তন করার পরেও বাইরের দিক ছাড়া তাঁদের বিশ্বাস এবং মানসিকতার মৌলবস্তুর মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। দিনের পর দিন গিয়েছে, নতুন ভাবাদর্শ এদেশে তরঙ্গ তুলেছে, নতুন রাজশক্তি এদেশে নতুন শাসন পদ্ধতি চালু করেছে কিন্তু তাঁরা মনের দিক দিয়ে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতোই বারবার বিচ্ছিন্ন থেকে গিয়েছে” (ছফা ১৯৮১: ২১-২২)।

দোভাষী পুথির জনপ্রিয়তা অর্জনের মধ্যে অধ্যাপক আজম বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর বর্ধিষ্ণুতার প্রমাণ খুঁজিয়া পাইয়াছেন। এই প্রমাণ যতখানি দেহে ততখানি ধনেপ্রাণে নহে। আহমদ ছফাও হয়তো কিছুদূর পর্যন্ত তাঁহার সহিত দ্বিমত পোষণ করিবেন না। কেননা তিনি মনে করেন, “মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই ছিল বাঙালী মুসলমান এবং মুসলমান রাজত্বের সময়ে তাদের মানসে যে একটি বলবন্ত সামাজিক আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিলো তাদের রচিত পুঁথি সাহিত্যসমূহের মধ্যে তার প্রমাণ মেলে” (ছফা ১৯৮১: ২২)।

অবশ্য একটু পরেই আহমদ ছফার পথ আলাদা হইবে। তিনি গুরুত্ব দিবেন ফলাফলে। লিখিবেন: “পুঁথি সাহিত্যের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই, বাঙালী আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের মনটি রাজশক্তির আনুকূল্য অনুভব করে হুংকার দিয়ে ফণা মেলে জেগে উঠেছে কিন্তু ঐ জেগে ওঠাই সার। সে মন কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারেনি। প্রতিবন্ধকতাসমূহ সামাজিক সংগঠনের মধ্যেই বিরাজমান ছিল। সমাজ সংগঠন ভেঙ্গে ফেলে নবরূপায়ণ তারা ঘটাতে পারেননি” (ছফা ১৯৮১: ২২)।

মীর মশাররফ হোসেনের ভাস্কর্য

একান্ত আদ্যকাল হইতে এই দেশে যে সমাজ-সংগঠন বিদ্যমান ছিল (এবং আজও অনেকাংশে রহিয়া গিয়াছে) সে সংগঠনের মধ্যেই আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান সমাজের বর্তমান দুরবস্থার উৎস অনুসন্ধান করিয়াছেন। এই অনুসন্ধানের মধ্যেই—আকলমন্দের জন্য ইশারাই যথেষ্ট মনে করিয়া—এই অবস্থার বাহিরে আসিবার একটা সম্ভাবনাও নির্দেশ করিয়াছেন তিনি। বিচারকগণ এই প্রস্তাবের সারবত্তা লইয়া সম্যক আলোচনা করিতেন তো আমাদের উপকারই হইত। দুর্ভাগ্যের মধ্যে—এবনে গোলাম সামাদ হইতে মোহাম্মদ আজম—কেহই সে কাজে প্রবৃত্ত হইলেন না। তাঁহারা যেখানে সুঁই হারাইয়াছে সেখানে নহে, খুঁজিতেছেন সদর রাস্তায়, উজ্জ্বল আলোকে। প্রমাণ করিতেছেন, তাঁহারাও বাঙালি মুসলমানের যথার্থ উত্তরপুরুষ। আহমদ ছফার সিদ্ধান্ত অনুসারে:

বাঙালী মুসলমানের মন যে এখনো আদিম অবস্থায়, তা বাঙালী হওয়ার জন্য নয়, এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী [বিদ্যমান] একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুণ তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে। দু বছরে কিংবা চার বছরে হয় তো এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙালী মুসলমানের মনের ধরন-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো পাওয়াও যেতে পারে (ছফা ১৯৮১: ২৭)।

ঠিক কথাই বলিয়াছিলেন তিনি। যে অচলাবস্থার সূত্রপতন একদিনে হয় নাই, দুই চারি বছরে তাহার অবসান ঘটিবে কি উপায়ে? ইতিহাসে অনিবার্য বলিয়া কিছুই নাই। ইতিহাস পরিবর্তিত হন কেবল বর্তমান পরিবর্তিত হন বলিয়াই। এই জায়গাতেই ‘ঐতিহাসিক পদ্ধতি’ কি পদার্থ জানিবার সার্থকতা। প্রশ্ন জাগিবে ‘ঐতিহাসিক পদ্ধতি’ বলিতে ছফা কি বুঝাইতেন। জবাব তাঁহার জবানে পেশ করি:

মূলতঃ বাঙালী মুসলমানেরা ইতিহাসের আদি থেকেই নির্যাতিত একটি মানবগোষ্ঠী। এই অঞ্চলে আর্যপ্রভাব বিস্তৃত হওয়ার পরে সেই যে বর্ণাশ্রম প্রথা প্রবর্তিত হলো, এদের হতে হয়েছিলো তার অসহায় শিকার। যদিও তারা ছিলেন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তথাপি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রশ্নে তাদের কোন মতামত বা বক্তব্য ছিলো না। একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলার মৃত্তিকার সাক্ষাৎ সন্তানদের এই সামাজিক অনুশাসন মেনে নিতে হয়েছিলো (ছফা ১৯৮১: ২০)।

এই ঐতিহাসিক পদ্ধতির নাম—এতদিনে কাহারও আর অজানা নাই—‘হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথা’। আহমদ ছফা লিখিয়াছেন, “হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস”। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি অনুসিদ্ধান্তের কথাও চলিয়া আসিয়াছে তাঁহার বাক্যে। তিনি লিখিয়াছেন: “কেউ কেউ অবশ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সাম্প্রদায়িকতার জনয়িতা মনে করেন। তাঁরা ভারতীয় ইতিহাসের অতীতকে শুধুমাত্র বৃটিশ শাসনের দুশো বছরের মধ্যে সীমিত রাখেন বলেই এই ভুলটা করে থাকেন” (ছফা ১৯৮১: ২১)।

এই কেউকেটার দলে মোহাম্মদ আজমও আছেন। বাঙালি মুসলমান সমাজের ইতিহাস—তাঁহার বিচারে—একাধারে ‘প্রায় আটশ বছরের’। আবার সঙ্গে—ঘোরের বশে—তিনি দাবিই করিলেন বাঙালি মুসলমান কৃষকসমাজ “বড়জোর দু-তিনশ বছর বয়সী” মাত্র—যেনবা কৃষক সমাজ বাদ দিয়া আলাদা একটা বাঙালি মুসলমান সমাজ কখনও বিরাজ করিত (আজম ২০২১: ২০৪-০৫)।

একটা কথা পরিষ্কার। বাঙালি মুসলমান সমাজের ইতিহাস শুদ্ধ দুই তিন শত বছরে কেন, আটশত বছরের মধ্যেও সীমিত রাখিতে চাহেন না আহমদ ছফা। বাঙালি মুসলমানেরা তাঁহার চোখে “বাংলার মৃত্তিকার সাক্ষাৎ সন্তান”। তাহারা এদেশের মাটি কামড়াইয়া হাজার বছরের অধিককাল পড়িয়া আছেন। ইসলাম ধর্মাবলম্বন তাহাদের ইতিহাসের পর্ববিশেষ। এ সত্যে সন্দেহ বলিয়াই কি মোহাম্মদ আজম রায় দিয়াছেন: “‘বাঙালী মুসলমানের মন’ বাংলাদেশের হিন্দু-সম্প্রদায়ের দিক থেকে সাম্প্রদায়িক এবং মুসলমানের দিক থেকে বর্ণবাদী রচনা” (আজম ২০২১: ২০৫)?

আজমের সিদ্ধান্ত সত্য কি মিথ্যা প্রমাণের উপায় নাই। শুদ্ধ প্রশ্ন তোলা যাইতে পারে, বাঙালি মুসলমানের সমস্যা আলাদা আলোচনা করা কি অন্যায়? তাহাতে বাংলাদেশ শুদ্ধমাত্র ‘বাঙালি-মুসলমানের রাষ্ট্র’ হইবে কেন? এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই, বাংলাদেশে অনেক মানুষ বসবাস করেন যাহারা কয়েক পুরুষ আগে কিংবা পরে পশ্চিম হইতে আগত ইসলামে ধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন। তাহাদের সমস্যা—যেমন ইতিহাসের দিক হইতে তেমনই সমাজের দিক বিচারে—আলাদা করিয়া আলোচনার অন্যায়টা কোথায়? দেশটা তো তাহাদেরও। দেশটা মাত্র তাহাদেরই বলা ঘোর অন্যায়। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নটা গোড়াতেই আমল করিয়াছিলেন আহমদ ছফা। ১৯৯৩ সালে তিনি লিখিয়াছিলেন:

সবদিক ভেবে আমি স্থির করেছি আমি যে সমাজ থেকে এসেছি সে বাঙালী মুসলমান সমাজটিকে যদি ন্যায়নীতির দিকে, মানবতার দিকে, অসাম্প্রদায়িকতার দিকে এবং বিজ্ঞানদৃষ্টির দিকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করি, তাহলে আমার কর্তব্য অধিকতর ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারবো। বাঙালী মুসলমান সমাজের বাইরে আরো একটি বৃহত্তর বাঙালী সমাজ রয়েছে, তার প্রতিও আমার একটা দায়িত্ব এবং অঙ্গীকারবোধ [রয়েছে], যেটি আমার পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমি ভেবে পাইনে আমার আপন সমাজের কল্যাণের কথা চিন্তা না করলে বৃহত্তর বাঙালী সমাজ কিংবা অধিকতর ব্যাপক অর্থে বিশ্ব সমাজের কল্যাণ কি করে আমি সম্পন্ন করতে পারি। আমি আমার সমাজের কল্যাণ এবং উন্নতি কামনা করি, কিন্তু সেটা অন্য সমাজের কিংবা অন্য সম্প্রদায়ের কল্যাণের বদলে নয় (ছফা ২০০৮খ: ২৪৯)।

আপন লক্ষ্যে স্থির থাকিয়া—অর্থাৎ বাঙালি মুসলমান সমাজকে ‘বাংলার মাটির সাক্ষাৎ সন্তান’ জ্ঞান করিয়া—এই সমাজের সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে চাহিয়াছিলেন আহমদ ছফা। আপনকার উদ্দেশ্যটা সিদ্ধ করিবার মতলবে—অন্যান্যের মধ্যে—‘ভারতের ধর্ম’ গ্রন্থের প্রণেতা ম্যাক্স বেহ্বারের দোহাই দিয়া তিনি লিখিয়াছিলেন:

আর্য অথবা ব্রাহ্মণ্যশক্তি যে সকল জনগোষ্ঠীকে পদদলিত করে এদেশে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁদেরকে একেবারে চিরতরে জন্ম-জন্মান্তরের দাস বলে চিহ্নিত করেছেন। আর যে সকল শক্তি ওই আর্যশক্তিকে পরাস্ত করে ভারতে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, তাঁদের সকলকেই মর্যাদার আসন দিতে কোন প্রকারের দ্বিধা বা কুণ্ঠাবোধ করেননি। শক, হুন, মোগল, পাঠান, ইংরেজ যাঁরাই এসেছেন এদেশে তাঁদের সকলকেই একেকটি মর্যাদার আসন প্রদান করেছেন। রাজ্যবিস্তারে, প্রশাসনে তাঁদের সহায়তা করতে পেছপা হননি। কিন্তু নিজেরা বাহুবলে যাঁদের পরাজিত করেছিলেন তাঁরাও যে মানুষ একথা স্বীকার করার প্রয়োজনীয়তা খুব অল্পই অনুভব করেছেন (ছফা ১৯৮১: ২০)।

ভারতবর্ষের আদি বর্ণাশ্রমধর্ম অথবা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কুলজী বিচারে বেহ্বার অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়াছেন—এ সত্য স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন আহমদ ছফা। অনেকেই দাবি করিয়া থাকেন, বর্ণাশ্রম প্রথার সূত্রপাত শ্রমবিভাগের প্রয়োজনে। বেহ্বার কথাটা মানিয়া লয়েন নাই। ‘ভারতের ধর্ম’ পুস্তকে তিনি লিখিয়াছিলেন: “শুদ্ধমাত্র বৃত্তিগত স্তরবিন্যাস আপনা-আপনি এই রকম কাটকাট অস্পৃশ্যতার জন্ম দিতে পারে না—সে কথা পরিষ্কার।”

যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যেই সংঘ প্রভৃতির সংগঠন তৈরি করা হইয়াছিল—এমন দাবির সপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করার উপায়ও নাই; আর তেমন কিছুর সম্ভাবনাও ছিল না। তাহার উপর, আদ্যকাল হইতেই বিরাজমান জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক বর্ণ বা জাতপাতের বিপুল সংখ্যাই তো নির্দেশ করে, বৃত্তিগত স্তরবিন্যাসের ভূমিকা যত বড়ই হোক, শুদ্ধমাত্র সেই কারণেই বর্ণাশ্রম প্রথা সংস্থাপিত হইয়াছিল এমন ব্যাখ্যা যথেষ্ট নহে। বর্ণাশ্রমধর্ম প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে সামাজিক অবস্থান আর আর্থিক বিষয়াদি ছাড়াও জাতিগোষ্ঠীগত স্বার্থের প্রশ্নটাও যে সত্য সত্য দায়ী ছিল, সে সত্যে সন্দেহ করা চলে না (বেহ্বার ১৯৫৮: ১২৩)।

বেহ্বার আরও উল্লেখ করিয়াছেন, “বংশানুক্রমিক হিন্দু রাজ্যসমূহ আদিতে নিজেদের বৈধতা প্রমাণের খাতিরে ব্রাহ্মণদের সেবা গ্রহণ করিত। একসময় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিজয় লাভের ফলে ক্ষত্রিয়বর্ণের রাষ্ট্র ও সামরিক শক্তি ধ্বংস হইয়া গেলে হিন্দু রাজ্যগুলি ব্রাহ্মণদের নিযুক্ত করিল সমাজব্যবস্থা রক্ষার কাজে” (বেহ্বার ১৯৫৮: ১২৫)।

যে যুগে মানুষ প্রকৃতিপূজা আর প্রাণীপূজায় নিবেদিত সে যুগে মন্ত্রবলে বলীয়ান লোকেরাই ক্ষমতাবান হইতেন। এক্ষণে ক্ষমতা বলিতে ধর্মজাতীয় ক্ষমতা ও পার্থিব ক্ষমতা দুইটাই বুঝাইতেছে। বেহ্বার আরেকটা সত্যও টুকিয়া রাখিয়াছেন। নানান বৃত্তিধারী কারিগরদের বৃত্তি বা ব্যবসায় কেমন করিয়া প্রথম প্রথম ফুঁকমন্ত্রভিত্তিক—আর পরিশেষে মৌরসী—গোত্রে-গোষ্ঠীতে ভাগ ভাগ হইল? এ ঘটনা দুনিয়ার আর আর অঞ্চলেও অল্পাধিক দেখা গিয়াছে একথা মিথ্যা নহে, কিন্তু বিভাজনটা ভারতবর্ষের মতন এহেন জল-অচল রূপ আর কোথাও ধারণ করে নাই। নানান বৃত্তি আর ব্যবসায়ের গোড়াপত্তন এই পথেই হইল। ভারতবর্ষীয় আদি বর্ণাশ্রমধর্মের কল্যাণে ব্যক্তিগত দাসাদি রাখার প্রয়োজন ফুরাইল। স্থাপিত হইল সমষ্টিগত দাসপ্রথা বা শুদ্র-অচ্ছুৎ প্রভৃতি জনসাধারণকে গোষ্ঠীগত দাসরূপে ব্যবহার করার ব্যবস্থা। বেহ্বার লিখিয়াছেন:

অন্য কয়েকটা বাহ্যিক ঘটনার সঙ্গে মিলিয়া এই পথেই সত্যকার বর্ণপ্রথার জন্ম হয়। ফুঁকমন্ত্রভিত্তিক জ্ঞাতিগোষ্ঠী আর জাতিবর্গ মিলিয়া বিজিতদের দেশগ্রাম দখল করে, নতুন নতুন গ্রামপত্তন করে, পরাজিত জনগোষ্ঠীর লোকজনকে প্রজা কিংবা গ্রামীণ কারিগরে, কৃষি কিংবা কারখানার মজদুরে পরিণত করে, আর নির্বাসিত করে গ্রামের বহিঃসীমায় এবং সংরক্ষিত এলাকায়—কিংবা বিশেষ বিশেষ অস্পৃশ্যের ঘেরাটোপে আর আলাদা আলাদা কারিগর পাড়ায়। গ্রাম-সমাজে বসবাসরত বিজয়ী আর বিজিত জাতির পাড়াগ্রাম সদলবলে একে অপরের মুখোমুখি দণ্ডায়মান অবস্থায় দিব্য বিদ্যমান ছিল। ব্যক্তিগত দাসত্বের দরকার পড়িল না, শুদ্র মাত্রেই ব্রাহ্মণের দাস বলিয়া পরিগণিত হইল (বেহ্বার ১৯৫৮: ১২৬)।

আহমদ ছফা © শিল্পকর্ম: রাজীব শীল

একে তো বাঙালি মুসলমান সমাজের অধঃপতন ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার বহু আগেই শুরু হইয়াছিল; দুই নম্বরে—তুর্কি, আফগান, আর মোগল শাসনামলে—ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও—তাহাদের জাগতিক দুর্দশার অবসান ঘটে নাই। এই দুই প্রতিজ্ঞা হইতেই আহমদ ছফা বর্তমান যুগে বাঙালি মুসলমান সমাজের দুর্দশা বিশ্লেষণে ব্রতী হইয়াছিলেন। জাগতিক পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোন আয়-পরিবর্তন হয় নাই বলিয়াই নিত্যনতুন ধর্মে দীক্ষিত হইবার পরও বাঙালি মুসলমান সমাজে বিশ্বাস ও মানসিকতার গোড়ায় কোন গঠনগত পরিবর্তন ঘটে নাই। পরিবর্তনের মধ্যে, তাহাদের মনে নতুন ধরনের সামাজিক প্রভুত্ব অর্জন-বাসনার আমদানি হইয়াছিল কিন্তু সেই বাসনার সহকার তরু জন্মাইতে পারে নাই।

সঙ্গত কারণেই দেখা গেল, ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পর যখন দেশে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়িয়া উঠিতে শুরু করিল তাহাতে বাঙালি মুসলমানের উপস্থিতি নাই। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে—বিশেষ উত্তর প্রদেশে—মুসলমান সমাজ যে পদ্ধতিতে পরাধীন যুগের ভাগ্যবিড়ম্বনার সহিত লড়াই করিয়াছিল, বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ—যাহাদের বেশির ভাগই বাঙালি মুসলমান—সেই পদ্ধতিতে লড়াই করিতে পারে নাই। ফল লাভও করে নাই। তাহারা ইংরেজ রাজশক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করিবে না একেলা চলিবে? ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমান সমাজের সংকট এই ভাবদ্বৈধের সংকট। ছফা ঘটনাটা এইভাবে বিধৃত করিয়াছেন:

স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে যে অধিকারচেতনা অপেক্ষাকৃত পরে জাগ্রত হয় আসলে তা ছিলো ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের আন্দোলন আর অগ্রগতির সম্প্রসারণ মাত্র। তা করতে গিয়ে তাদের দুই ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। লেখাপড়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থস্বার্থের দিকে অনেকদূর অগ্রসর হিন্দু সমাজের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো এবং অন্যদিকে উঁচুতলার মুসলমানদের মূল্যচেতনা এবং জীবনদৃষ্টিকে স্বীকার করে নেয়া ছাড়াও তাঁদের গত্যন্তর ছিলো না। এই দু’মুখী প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করতে হলে যে শক্ত সামাজিক ভিত্তিভূমির প্রয়োজন ছিলো, তাদের পেছনে [তা] ছিলো না (ছফা ১৯৮১: ২৩)।

এই পরিস্থিতির কোন বুনিয়াদী ব্যয়-পরিবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীর অস্তাচলে—কি বিংশ শতাব্দীর অরুণাচল পর্যন্ত—দেখা যায় নাই। কলিকাতাবি সংস্কৃতির হিন্দু প্রতিক্রিয়া বাঙালি মুসলমান সমাজে যে ভাবদ্বৈধের সৃষ্টি করিয়াছিল মুনীর চৌধুরী তাহার একটা ভালো ছবি আঁকিয়াছিলেন। লিখিয়াছিলেন: “অপর দিকে অস্তমান ঊনবিংশ শতাব্দীর কলিকাতা কালচারের উদ্দণ্ড হিন্দুমূর্তি যে অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে তারও দুটো রূপ ছিল”।

একটা একটু পণ্ডিতী ধরনের। অনেক অংশ নাগরিকতামণ্ডিত ও যুক্তিমার্গীয়। ইসলামী ধর্মতত্ত্বের পুনর্গঠনে এঁদের প্রয়াস মূলতঃ বুদ্ধিবৃত্তিমূলক। শিক্ষিত মুসলমানের চিন্তাজগৎকে প্রভাবিত করাই ছিল এঁদের লক্ষ্য। ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানসঞ্চয়ের জন্য এঁরা আরবী ফারসী সংস্কৃত ইংরেজী ভাল করে আয়ত্ত করেছিলেন। মৌলভী মেয়ারাজউদ্দীন, পণ্ডিত রেয়াজউদ্দীন মাশহাদী, শেখ আব্দুর রহীম এই গোত্রভুক্ত। দ্বিতীয় ধারাটি তুলনায় বেশী ভাবপ্রবণ, সরল এবং গ্রামীণ। লেখায় এঁরা পুঁথি সাহিত্যের আদর্শকে অনুকরণীয় বলে মনে করেছেন, বলায় ওয়াজ বহেসীয় যুক্তিতর্কের তরীকাকে। জন জমিরুদ্দিন, মুনসী মেহেরুল্লাহ্, নইমুদ্দিন এই পথের পথিক (চৌধুরী ১৯৮৪: ১৯)।

চৌধুরী সাহেব যোগ করিয়াছিলেন, “বলা বাহুল্য যে কোনো চিন্তাধারার শ্রেণীকরণের মতো আমাদের এ ভাগাভাগিও কিছুটা কৃত্রিম, বক্তব্য প্রকাশের সুবিধার্থে সত্যবস্তু থেকে নির্মিত” (চৌধুরী ১৯৮৪: ১৯)।

আহমদ ছফার বিবৃতি আরও কাটছাঁট: “ধর্মীয় বদ্ধমত এবং সংস্কারকে আঘাত করে এমন কোন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন মুসলমান সমাজের ভেতর থেকে জেগে উঠতে পারেনি। মুসলমানদের দ্বারা সংগঠিত প্রায় সমস্ত সামাজিক কর্মকাণ্ড তাই ধর্মীয় পুনর্জাগরণভিত্তিক” (ছফা ১৯৮১: ২৪)।

কেন এমন হয়? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের জন্যই আহমদ ছফা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পঞ্চম বৎসরের কোন ‘একরাতে একটুও না থেমে’ বাঙালী মুসলমানের মন রচনায় মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। ছফার উপকথা  মোতাবেক বলিতেছি—১৯৭৫ সালের শেষ কি ১৯৭৬ সালের শুরু ঠিক নাই—এক সকালবেলা ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিখ্যাত লেখক আবুল ফজল টুপি মাথায় সিরাত মাহফিলে যোগ দিতে যাইতেছেন জানিয়া আহমদ ছফা যারপরনাই বিস্মিত হইয়াছিলেন। ঘটনার অন্যূন বিশ বছর পর কোন উপলক্ষে একটা কৈফিয়তও দিলেন তিনি: “অনেক নাস্তিক শেষ পর্যন্ত আস্তিকে পরিণত হয়েছে এরকম ভুরি ভুরি লোকের নাম আমি জানি। কিন্তু আবুল ফজল সাহেবের মতো লোক যিনি সারাজীবন নাস্তিকতার পুরোহিতের ভূমিকা পালন করে গেছেন তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে না আসতেই কোনরকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না দিয়েই একটি ভিন্ন পরিচয়ে নিজেকে চিহ্নিত করতে তৎপর হয়ে উঠলেন। সেটাই আমাকে সবচাইতে [বেশী] বিস্মিত করেছে” (ছফা ২০০৮ক: ৮১-৮২)।

প্রবন্ধকার কবুল করিয়াছেন, “আবুল ফজল সাহেব উপলক্ষ মাত্র, কারণ নন”। এই যে হঠাৎ পরিচয় পরিবর্তন—আহমদ ছফার মতে—ইহাই বাঙালী মুসলমানের মন। ইহার পিছনে—তাঁহার কথায়—‘একগুচ্ছ সামাজিক কারণ’ বর্তমান। এই কারণের সন্ধানেই তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজে দীর্ঘদিন ধরিয়া জনপ্রিয় পুথি সাহিত্যের বিশ্লেষণে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। দেখিতে পাইয়াছিলেন, বাঙালি মুসলমান রচিত পুথি সাহিত্যে ‘উদ্ভট রসের অতি বেশি ছড়াছড়ি’। ঘটনার একটা কারণ সম্ভবত এই: “হিন্দু মহাকাব্য এবং পুরাণসমূহের বীর-বীরাঙ্গনাদের চরিত্রের অপভ্রংশ মুসলিম কবিদের সৃষ্ট বীরদের মধ্যে নতুন করে জীবনলাভ করেছে। তাই পুঁথি সাহিত্যে অগ্রসরমানতার চাইতে প্রতিক্রিয়ার জের অধিক। মনের হীনমন্যতাবোধ থেকেই এই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি” (ছফা ১৯৮১: ১১)।

কেন এই হীনমন্যতাবোধ? আহমদ ছফার উত্তর: “একসময়ে এই মুসলমানের পূর্বপুরুষেরা যে উঁচুবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন, এই অপমানজনক দূরস্মৃতি বাইবেলের ‘অরিজিন্যাল সীন’ বা আদি পাপের ধারণার মতো তাঁদের মনে নিরন্তর জাগরুক থেকেছে। মুসলমান রচিত পুঁথিসাহিত্যের প্রতিক্রিয়াশীলতা আসলে সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতারই সাহিত্যিক রূপায়ণ” (ছফা ১৯৮১: ১১)।

এই হীনমন্যতাবোধের ইতিহাস অতি প্রাচীন, ইসলাম ধর্ম বিস্তারের ঢের আগের, বাংলাদেশে আর্যপ্রভাব বিস্তারের সমসাময়িক। আহমদ ছফার মতে, প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম হীনমন্যতায় আর হীনমন্যতার জন্ম এই জনগোষ্ঠীর সমষ্টিগত দাসত্ববরণের অতীত ইতিহাসে পাওয়া যাইবে। মহাত্মা জিকমুন্ট ফ্রয়েড এই দাসত্ববরণ পর্বের নাম রাখিয়াছিলেন আদিপাপ নয়—আদিকাণ্ড, ইংরেজি ভাষ্যে ‘প্রাইমাল সিন’ (ফ্রয়েড ২০০৬ক)। এই কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ব্যক্তির সজ্ঞান মনের এখতিয়ারে থাকে না। ইহার পুনরাবৃত্তি হয় স্বয়ংক্রিয়তা বা জবরদস্তির মতন। এই ‘পুনরাবৃত্তির স্বয়ংক্রিয়তা’ কথাটি আরেক মহাত্মার কীর্তি। ইঁহার নাম জাক লাকাঁ (ফ্রয়েড ২০০৬খ: লাকাঁ ২০০৬)।

অপমানজনক দূরস্মৃতির স্বয়ংক্রিয় পুনরাবৃত্তি—আহমদ ছফার বিশ্লেষণ অনুযায়ী—বাংলাদেশে যে যে মূর্তি ধারণ করিয়াছিল তাহার কিছুটা নিদর্শন বাঙালি মুসলমান সমাজের কীর্তি পুথি সাহিত্যে মিলিবে।

মুসলিম শাসনের অবসানের পর এই সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরো গভীর এবং অন্তর্মুখী রূপ পরিগ্রহণ করে। এই প্রতিক্রিয়ার জের বাঙালী মুসলমান সমাজে এত সুদূরপ্রসারী হয়েছে যে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী গদ্য-লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সুবিখ্যাত ‘বিষাদ-সিন্ধু’ গ্রন্থটিতেও ‘শহীদে কারবালা’ পুঁথির ব্রাহ্মণ আজরকে একই চেহারায়, একই পোশাকে, একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সময়ের পালাবদলের ব্যাপারটি এই অত্যন্ত শক্তিধর লেখকের মনে সামান্যতম আঁচড়ও কাটতে পারেনি। পুঁথিলেখকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে তিনিও বরণ করে নিয়েছেন (ছফা ১৯৮১: ১১-১২)।

এখানে আমরা একটি সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে পারি। কারবালা-কাহিনী শুদ্ধ শিয়া মুসলমানের কেন—একেলা মুসলমানেরই বা বলি কেন—মনুষ্য মাত্রেরই হৃদয়ে করুণার উদ্রেক করে কেন? ফ্রয়েড সাহেব খেয়াল করিয়াছিলেন, এদিপাস কাহিনী সকল মনুষ্য-হৃদয়েই তোলাপাড়া করে (ফ্রয়েড ২০০৬গ: ২৭৬)। আমাদের সকলের হৃদয়ে যেমন একটুকরা এদিপাস, তেমনই আরেক টুকরার নাম দেওয়া যাইতে পারে ইমাম হোসেন। একটির গ্রিক নাম যদিবা ‘এরোস’ (রতিদেবী), আরটার পরিচয় ‘থানাটোস’ (বিরতিদেব) নামে রাখা যায়। দুই বাসনাই নিরন্তর অর্থাৎ বিরতিহীন।

আহমদ ছফার মীর-মানস বিচারে মোহাম্মদ আজমের দুই প্রস্ত আপত্তি। প্রথম ‘শহীদে কারবালা’ পুথির কালনির্ণয় লইয়া। দ্বিতীয় ‘বিষাদ-সিন্ধু’ কাহিনীর আজর চরিত্র বিষয়। অনেক যুক্তিতর্কের পর—একপ্রকার সৌজন্য দেখাইয়া—প্রথম আপত্তিটি প্রত্যাহার করিয়াছেন তিনি। স্বীকার করিয়াছেন, “বিষাদ-সিন্ধু যে অনেক পরের রচনা, তাতে সন্দেহ নাই”। তাঁহার দ্বিতীয় আপত্তিটি বড়ই শোকাবহ: “প্রশ্ন হল, এত পরের পরিবর্তিত সময়ে আজর কি সত্যি সত্যি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল? ‘বিষাদ-সিন্ধু’র পাঠকেরা অবাক হয়ে খেয়াল করবেন, এ বাবদ ছফা যা যা বলেছেন, তার সবই বানোয়াট। আশ্চর্য, মন্তব্য করার আগে বা পরে—কখনো তিনি সংশ্লিষ্ট অংশটা একবার পড়েও দেখেন নাই” (আজম ২০২১: ১৯৫)।

এহেন হিমালয়প্রমাণ দাবির পিঠাপিঠি অধ্যাপক আজম একটা প্রমাণ-আকারের মুষিক প্রসব করিলেন। লিখিলেন: “প্রথমেই দেখব, বিষাদ-সিন্ধুর আজর ব্রাহ্মণ নয়—‘নানাপ্রকার দেবদেবী’র উপাসক ‘পৌত্তলিক’। সে কিংবা তার পরিবার ধর্মান্তরিতও হয় নাই। এমন কি হোসেনের খণ্ডিত শির এখানে কোনোপ্রকার অলৌকিক কর্মকাণ্ডও করে নাই।” এই দুই বা তিন তথ্যের উপর দাঁড়াইয়া তিনি দাবি করিয়াছেন, “মীর মশাররফ হোসেনের আজর ছফার দাবি ও ভাষাকে নস্যাৎ করে দিয়ে পরিবর্তিত সময়ের বদলে-যাওয়া ভাব ও স্বভাব নিয়ে হাজির হয়েছে” (আজম ২০২১: ১৯৫)। অবশ্য—আমরা যোগ করিব—কাণ্ডজ্ঞানটা বাদ দিয়া।

আজমের যুক্তি শুদ্ধমাত্র সরল ও পুষ্টিহীন নহে, তাহাতে একটা বিচারবুদ্ধির দুর্ভিক্ষও দেখা যায়। আহমদ ছফা কখনও বলেন নাই যে ‘বিষাদ-সিন্ধু’র আজর ব্রাহ্মণ। ছফা হইতে যে তিনটি বাক্য তিনি উদ্ধার করিয়াছেন তাহাতেও বিলকুল পরিষ্কার, আজর শুদ্ধমাত্র ‘শহীদে কারবালা’ পুথির বয়ানেই ব্রাহ্মণ—‘বিষাদসিন্ধু’র উপাখ্যানে নহেন। ‘শহীদে কারবালা’ কিংবা অন্য কোন কাব্যে আজর ধর্মান্তর গ্রহণ করেছেন। আনিসুজ্জামান উল্লেখ করিয়াছেন, সাদ আলী ও আবদুল ওয়াহাবের ‘সহিদে কারবালা’ কাব্যে হোসেনের খণ্ডিত মস্তকের কাছ হইতে আয়াত শুনিয়া জনৈক ইহুদী ইসলাম গ্রহণ করেন (আনিসুজ্জামান ১৯৬৪: ১৫৭-৫৮)।

‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপাখ্যানে আজর ধর্মান্তরিত হইয়াছেন এমন কোন খবর নাই। আহমদ ছফাও সে দাবি করেন নাই। আমরা আগেই দেখিয়াছি, ছফা লিখিয়াছিলেন, “এই প্রতিক্রিয়ার জের বাঙালী মুসলমান সমাজে এত সুদূরপ্রসারী হয়েছে যে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী গদ্য-লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সুবিখ্যাত ‘বিষাদ-সিন্ধু’ গ্রন্থটিতেও শহীদে কারবালা পুঁথির ব্রাহ্মণ আজরকে একই চেহারায়, একই পোশাকে, একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় (ছফা ১৯৮১: ১১-১২; আজম ২০২১: ১৯৪; মোটা হরফ এখানে যোগ করা হইল)।

‘ব্রাহ্মণ আজর’ চরিত্রটি ‘শহীদে কারবালা’ আর সমগোত্রীয় অন্যান্য পুথির দান। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপাখ্যানে ইহার পুনরাবৃত্তি হইয়াছে—ইহাই আহমদ ছফার মূল প্রস্তাব। এক্ষণে বিচার্য, পুনরাবৃত্তির মধ্যে যেটুকু পরিবর্তন তাহাতে ছফার বক্তব্য—‘ব্রাহ্মণ আজরকে একই চেহারায়, একই পোশাকে, একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়’—‘বানোয়াট’ প্রমাণিত হয় কিনা। আমাদের মনে হয়, আদৌ হয় না। বাঙালি মুসলমানের চোখে যাহাই ব্রাহ্মণ তাহাই ‘পৌত্তলিক’—‘নানাপ্রকার দেবদেবীর’ উপাসক। অন্ধকার রাত্রে সকল গাভী কালো দেখায় বলিয়া নহে, অলঙ্কারশাস্ত্রে ‘রূপক’ আর ‘লক্ষণা’ নামে দুইটি প্রতিজ্ঞা আছে বলিয়াও। আশা করি, রাজা রামমোহন রায়ের ক্ষমা পাইব। বলিব ব্রাহ্মণ মাত্রই ‘পৌত্তলিক’, পৌত্তলিক মাত্রেই যদিও ব্রাহ্মণ নহেন। ইহাতে নৈয়ায়িক অনুপপত্তি ঘটিবে না, সত্যের হানি হইবে না। রূপকের বিধি যে কোন ভাষারই দুই মূলবিধির একটি। ব্রাহ্মণ মাত্রই ‘পৌত্তলিক’ বলিতে মহাভারত অশুচি হয় না।

স্মরণ করা যাইতে পারে, মীর মশাররফ হোসেন ‘মুসলমান’ শব্দটি প্রয়োগেও যথাসাধ্য বিরত ছিলেন। তিনি তদস্থলে মাত্র “হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার শিষ্য” বা নিরাভরণ “মোহাম্মদের শিষ্য” কথাগুলি ব্যবহার করিয়াছেন। তিনি ‘জাতীয়’—অর্থাৎ ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দরাজি যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিতেন। ব্রাহ্মণ কথাটি মীর সাহেব কি কারণে ব্যবহার করিতে কুণ্ঠিত হইয়াছিলেন তাহার একটুখানি ইঙ্গিত ‘বিষাদ-সিন্ধু’র মুখবন্ধেও পাওয়া যাইতেছে: “শাস্ত্রানুসারে পাপভয়ে ও সমাজের দৃঢ় বন্ধনে বাধ্য হইয়া ‘বিষাদ-সিন্ধু মধ্যে’ কতকগুলি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করিতে হইল। বিজ্ঞমণ্ডলী ইহাতে যদি কোন প্রকার দোষ বিবেচনা করেন, সদয়ভাবে মার্জ্জনা করিবেন” (মীর ১৯৮০: [পঞ্চান্ন])। একশত বৎসরেরও কম সময়ের মধ্যে কিভাবে ‘জাতীয়’ শব্দের অর্থ আমূল বদলাইয়া গেল, হইল ‘সাম্প্রদায়িক’—আপনি ভাবিয়া তাহার কুল পাইবেন না।

তদুপরি, ‘আশ্চর্য, মন্তব্য করার আগে বা পরে—কখনো তিনি সংশ্লিষ্ট অংশটা একবার পড়েও দেখেন নাই’—এই মন্তব্য এহেন ডাগর মনীষীর মানায় না। অলঙ্কারশাস্ত্রে একটা বড় অলঙ্কারের নাম ‘অতিশয়োক্তি’। ইংরেজি বচনে ‘হাইপারবোল’। এই সত্য কোন বড় লেখকের অজানা থাকার কথা নয়। দীপেশ চক্রবর্তী ইহার কোমল নাম রাখিয়াছেন ‘অতিকথন’। আজর কিংবা তাহার পরিবার ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপাখ্যানে ধর্মান্তরিত হন নাই, একথা মিথ্যা নহে। কিন্তু তাহারা যাহা করিয়াছেন তাহার কাছে ধর্মান্তর তো তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ ব্যাপার!

পরের জন্য—বিশেষ খণ্ডিত মস্তকের জন্য—আজর, হৃদয়ের হৃদয়, আত্মার আত্মা, প্রাণের প্রাণ জ্যেষ্ঠ পুত্রের গ্রীবালক্ষে খড়গ উত্তোলন করিলেন। পিতার হস্তে উত্তোলনের ইঙ্গিত দেখিয়া সায়াদ গ্রীবা নত করিলেন। আজরের স্ত্রী চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। কবির কল্পনা আঁখি ধাঁধা লাগিয়া বন্ধ হইল। সুতরাং কি ঘটিল, কি হইল, লেখনী তাহা প্রকাশ করিতে পারিল না (মীর ১৯৮০: ২৬৪)।

এক্ষণে আমরা ইচ্ছা হয় দেখিতে পারি, ‘শহীদে কারবালা’ পুথির ব্রাহ্মণ আজর কোন চেহারায়, কোন পোশাকে, কোন স্থানে দাঁড়াইয়া আছেন। আছেনই বা কোন কারণে! এই চেহারা, এই পোশাক আর এই স্থানেরই অপর নাম ‘কাণ্ডজ্ঞান’। ভাষার বিধি অনুসারে ইহাকেই বলে ‘রূপক’ বা ‘রূপান্তর’। ইংরেজি বুলিতে, ‘মেটাফর’। এই রূপান্তর আবার নির্ভরশীল অন্য একটা বিধির উপর যাহার ডাকনাম ‘নামান্তর’ বা ‘লক্ষণা’। ইংরেজিতে যাহাকে বলে ‘মেটোনিমি’। প্রথমে চেহারা, পোশাক বা স্থানের সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞান; পরে চেহারা, পোশাক ও স্থানের স্থলে কাণ্ডজ্ঞান।

‘বাঙালী মুসলমানের মন’ প্রবন্ধের উপক্রমণিকাযোগে আহমদ ছফা স্বগত বিবৃত করিয়াছিলেন: “‘শহীদে কারবালা’ পুঁথিতে কবি কারবালার যুদ্ধে শহীদ হজরতের দৌহিত্র হজরত হোসেনের মস্তকসহ ঘাতক সীমারের দামেস্ক যাত্রা অংশটি রচনা করতে যেয়ে কল্পনাশক্তির অবাধ ব্যবহার করেছেন”। কেমন অবাধ সে ব্যবহার? একটুখানি নমুনা:

কবি বিষয়টির বর্ণনা করেছেন এভাবে: কারবালা থেকে দামেস্ক যাচ্ছে সীমার। মনে অপার আনন্দ। এখন হজরত হোসেন বিগতজীবন, কাঁধের বর্শার অগ্রভাগে শোভা পাচ্ছে তাঁর কর্তিত মস্তক। লক্ষ টাকা পারিতোষিক লাভ করার পথে যাবতীয় প্রতিবন্ধক অন্তর্হিত। নিশ্চয়ই বাদশাহ্ নামদার এজিদ তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করবেন। যেতে যেতে সন্ধ্যে হলো পথে। সে রাতের জন্য সীমারকে এক গৃহস্থের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হলো। গৃহকর্তার নাম—পুঁথিলেখকের জবানীতে—আজর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী, তার উপর আবার ব্রাহ্মণ। সেই রাতে হজরত হোসেনের ছিন্নমস্তক এক অলৌকিক কাজ করে ফেললো। গৃহকর্তা আজর, তার ব্রাহ্মণী, সাত পুত্র এবং সাত পুত্রবধূ একসঙ্গে কাটা মস্তকের মুখে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলো (ছফা ১৯৮১: ১)।

ইহা তো গেল ‘শহীদে কারবালা’ কাব্যের ভাষ্য। আহমদ ছফার এই একটা দোষ কবুল করার বিকল্প নাই আমাদের। অধ্যাপক আজম বলিয়াছেন, একুনিয়া পাঁচজন কবির রচিত চারিটি  ‘শহীদে কারবালা’ কাব্য পাওয়া যায়। পাওয়া যায়—প্রকৃত প্রস্তাবে—চারিটির অধিক।  কোন ‘শহীদে কারবালা’টি তিনি এস্তেমাল করিয়াছেন সে কথা জানানো দরকার মনে করেন নাই আহমদ ছফা। তবে ইহা দিবালোকের মতন পরিষ্কার যে এই বয়ানটা তিনি কোন না কোন পুথি হইতে লইয়াছেন। একটা কথা কিন্তু সিদ্ধ: এই বয়ান ‘বিষাদ-সিন্ধু’র নহে। সমস্যার মধ্যে, নতুন জমানার গবেষকও ‘শহীদে কারবালা’ কিংবা ‘জঙ্গনামা’র মূল পুথি পরীক্ষা করিবার সময় পান নাই (আজম ২০২১: ১৯৪)।

এক্ষণে দেখা যাইতে পারে, ‘বিষাদ-সিন্ধু’র সংশ্লিষ্ট অংশটিতে কি সন্দেশ আছে। উদ্ধার পর্ব্বের দ্বিতীয় প্রবাহযোগে মশাররফ হোসেন লিখিয়াছেন, “সীমার এক গৃহীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া ঐ স্থানে নিশাযাপন করিবেন, জানাইলেন। বর্শা-বিদ্ধ খণ্ডিতশির অস্ত্রে সস্ত্রে সুসজ্জিত, বুঝি, রাজসংক্রান্ত কেহ বা হয় মনে করিয়া গৃহস্বামী আর কোন কথা বলিলেন না।” আজরের পরিচয় গ্রন্থকার দিয়াছেন এই ভাষায়: “গৃহস্বামী বাস্তবিক হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার শিষ্য ছিলেন না। নানা প্রকার দেবদেবীর আরাধনাতেই সর্বদা রত থাকিতেন। উপযুক্ত তিন পুত্র ও এক স্ত্রী। নাম আজর।” তদনন্তর পাদটীকাযোগে লেখা হইয়াছে: “হজরত এব্রাহিম খলিলোল্লার পিতার নামও আজর, বোত্পরস্ত ছিল; ইনি সে আজর নহেন” (মীর ১৯৮০: ২৫৮)।

আজরের গৃহে কি ঘটিল এখন তাহার খানিকটা। সীমার কিভাবে যেন জানিতে পারিলেন আজর ‘পৌত্তলিক’। কারণ তাহার গৃহে নানা দেবদেবীর প্রতিমূর্তি। পরে খোদ আজর ঘোষণা করিলেন, “আমি একেশ্বরবাদী নহি। নানা প্রকার দেবদেবীই আমার উপাস্য।” গৃহস্বামী নিজগৃহের অভ্যন্তরে: “সাদরে সীমারকে স্থান নির্দেশ করিয়া দিলেন, পথশ্রান্তি দূরীকরণের উপকরণাদি ও আহারীয় দ্রব্য-সামগ্রী আনিয়া ভক্তি সহকারে অতিথি সেবা করিলেন। ক্ষণকাল বিশ্রামের পর অতি বিনীতভাবে বলিলেন, “মহাশয়! যদি অনুমতি করেন, তবে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি।”

সীমার বলিলেন,—
“কি কথা?”
“কথা আর কিছু নহে, আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন? আর এই বর্শাবিদ্ধ শির কোন্ মহাপুরুষের?”
“ইহার অনেক কথা। তবে তোমাকে অতি সংক্ষেপে বলিতেছি। মদিনার রাজা হোসেন, যাহার পিতা আলী এবং মোহাম্মদের কন্যা ফাতেমা যাহার জননী, এ তাহারই শির। কারবালা-প্রান্তরে মহারাজ এজিদ প্রেরিত সৈন্য-সহিত সমরে পরাস্ত-হইয়া এই অবস্থা। দেহ হইতে মস্তক ভিন্ন করিয়া মহারাজ এজিদের নিকট লইয়া যাইতেছি, পুরস্কার পাইব। লক্ষ টাকা পুরস্কার। তুমি পৌত্তলিক তোমার গৃহে নানা দেবদেবীর প্রতিমূর্তি আছে দেখিয়াই আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছি। মোহাম্মদের শিষ্য হইলে কখনও তোমার গৃহে আসিতাম না। তোমার আদর অভ্যর্থনাতেও ভুলিতাম না। তোমার আহারও গ্রহণ করিতাম না” (মীর ১৯৮০: ২৫৭-৫৮)।

আজর সীমারের কাছে হজরত হোসেনের বর্শা-বিদ্ধ কর্তিত শিরখানি চাহিয়া লইলেন। যুক্তিবিস্তারও করিলেন এই বলিয়া: “কারণ যদি কোন শত্রু আপনার অনুসরণে আসিয়া থাকে, নিশিথ-সময়ে কৌশলে কি বল-প্রয়োগে এই মহামূল্যশির আপনার নিকট হইতে কাড়িয়া লয়, কি আপনার ক্লান্তি জনিত অবশ অলসে ঘোর নিদ্রায় অচেতন হইলে আপনার অজ্ঞাতে এই মহামূল্য শির,—আপাততঃ যাহার মূল্য লক্ষ টাকা—যদি কেহ লইয়া যায়, তবে মহাদুঃখের কারণ হইবে; আমাকে দিন। আমি সাবধানে রাখিব, আপনি প্রত্যুষে লইবেন। আমার তত্ত্বাবধানে রাখিলে আপনি নিশ্চিন্তভাবে নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে পারিবেন” (মীর ১৯৮০: ২৫৮)।

একসময় সীমার ঘুমাইয়া পড়িলেন। তখন “আজর স্ত্রীপুত্রসহ হোসেনের মস্তক ঘিরিয়া বসিলেন এবং আদ্যান্ত সমুদয় ঘটনা বলিলেন”। গ্রন্থকারের বয়ান অনুসারে, “যে ঘটনায় পশু-পক্ষীর চোখের জল ঝরিতেছে, প্রকৃতির অন্তর ফাটিয়া যাইতেছে, সেই দেহবিচ্ছিন্ন হোসেন-মস্তক দেখিয়া কাহার হৃদয়ে না আঘাত লাগে? দেবদেবীর উপাসক হউন, ইসলাম ধর্ম্মবিদ্বেষীই হউন, এ নিদারুণ দুঃখের কথা শুনিলে কে না ব্যথিত হন? পিতাপুত্র সকলে একত্র হইয়া হোসেন-শোকে কাঁদিতে লাগিলেন” (মীর ১৯৮০: ২৫৯)।

কাঁদিতে কাঁদিতে পিতাপুত্র, স্বামী-স্ত্রী—একে একে সকলেই—শেষ পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন দিলেন। আজর নিজ হস্তে নিজ তিন তিনটি পুত্রেরই মাথা কাটিলেন। হোসেনের কর্তিত-মস্তক রক্ষা করিবার জন্য একে একে তিন পুত্রের কাটা মাথা সীমার হস্তে সমর্পণ করিলেন। তবুও সন্তুষ্ট হইবেন না সীমার। মীর সাহেব জানাইতেছেন, “সীমার সজোরে আজরের বক্ষে বর্শাঘাত করিয়া ভূতলশায়ী করিল এবং বীরদর্পে আজরের শয়নগৃহের দ্বারে যাইয়া দেখিল, সুবর্ণ পাত্রোপরি হোসেন মস্তক স্থাপিত রহিয়াছে, আজরের স্ত্রী খড়গ হস্তে তাহা রক্ষা করিতেছে” (মীর ১৯৮০: ২৬৭)।

শেষ দৃশ্যে দেখা গেল: “বর্শাবিদ্ধ হোসেন মস্তক বিচ্যুত হইয়া মৃত্তিকায় পতিত হইবা-মাত্র আজরের স্ত্রী মস্তক ক্রোড়ে করিয়া বেগে পলাইতে লাগিলেন, কিন্তু সীমার বামহস্তে সাধ্বী সতীর বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া সজোরে ক্রোড় হইতে হোসেন শির কাড়িয়া লইল। আজরের স্ত্রী তখন একেবারে হতাশ হইয়া নিকটস্থ খড়গ দ্বারা আত্মবিসর্জ্জন করিলেন, সীমারের বর্শাঘাতে মরিতে হইল না। সীমার হোসেন শির পূর্ব্ববৎ বর্শায় বিদ্ধ করিয়া দামেস্কাভিমুখে চলিল” (মীর ১৯৮০: ২৬৮)।

আহমদ ছফা দাবি করিয়াছেন, “সময়ের পালাবদলের ব্যাপারটি এই অত্যন্ত শক্তিধর লেখকের মনে সামান্যতম আঁচড়ও কাটতে পারেনি। পুঁথিলেখকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে তিনিও বরণ করে নিয়েছেন।” তো এই দাবির কি হইবে? সময়ের পালাবদলের ফলে অনেক কিছুই হয়তো বদলাইয়া গিয়াছে। পুথিলেখকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা আদৌ কি বদলাইয়াছে? মশাররফ হোসেনের বয়ানে কি তাহা কাণ্ডজ্ঞানে রূপান্তরিত হইয়াছে? প্রশ্ন ইহাই। আজরের পুত্রসংখ্যা সাতের স্থলে তিন কিংবা তাহার পুত্রগণ সস্ত্রীকের জায়গায় নিরস্ত্রীক হইলে—এমন কি ধর্মান্তর গ্রহণ না করিয়া প্রাণ বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হইলেও—যে যে পরিবর্তন করা হয় তাহাকে আর যাহাই বলা যায়, ‘মনে সামান্যতম আঁচড় কাটা’ বলা যায় না। আসল কথা, “পুঁথিলেখকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে তিনি বরণ” করিয়া লইয়াছেন কিনা। কাজী আবদুল ওদুদ কিংবা মুনীর চৌধুরীর বিশ্লেষণ পড়িলে তো তাহাই মনে হয়।

দুই মনীষীর পুরানা বিচার হিসাবে লইলে মনে হইবে আহমদ ছফা নতুন কথা খুব একটা বলেন নাই। নতুনের মধ্যে, তিনি বিলকুল নিজের দায়িত্বে বলিয়াছেন, বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর মনে—“বাইবেলের ‘অরিজিন্যাল সীন’ বা আদি পাপের ধারণার মতো”—একটা অপমানজনক দূরস্মৃতি নিরন্তর জাগরুক আছে। কথাটা আনকোরা নিঃসন্দেহে। অনেক আগেই কাজী আবদুল ওদুদ লিখিয়াছিলেন, “অনেকের ধারণা, মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ জঙ্গনামা ও এই জাতীয় অন্যান্য পুঁথির সাধুভাষায় রূপান্তর মাত্র। লেখক নিজে বলেছেন: ‘পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া ‘বিষাদ-সিন্ধু’ বিরচিত হইল’। তা উপকরণ যেখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করুন, এই বইখানিতে তাঁর যে কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে তা অনন্যসাধারণ।” উদারচিত্ত, স্বাধীনতা ব্যবসায়ী, কাজী ওদুদ সাহেবের বিচারেও পুথি সাহিত্যের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কবল হইতে মীর মশাররফ হোসেন কখনো মুক্তিলাভ করেন নাই। আমাদের এই কাজীর বিচারে ন্যায়ের একটা পরাকাষ্ঠা নিশ্চিত হইয়াছে দেখা যায়:

পুঁথি-সাহিত্যের লেখকদের সঙ্গে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ লেখকের বড় মিল হয়ত এইখানে যে দৈব-বলের অদ্ভুতত্বে বিশ্বাস তাঁরও ভিতরে প্রবল দেখা যাচ্ছে। দৈববলে বিশ্বাস মাত্রই সাহিত্যে বা জীবনে দোষার্হ নয়; কিন্তু এই বিশ্বাসের সঙ্গে যখন যোগ ঘটে অজ্ঞানের ও ভয়বিহ্বলতার, তখন তা হয়ে ওঠে জীবনের জন্য অভিশাপ—সাহিত্যেও একান্ত অবাঞ্ছিত। এই বিশ্বাসের জন্য ‘বিষাদ-সিন্ধু’-কারের সাহিত্যিক ক্ষমতা যে অনেক জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে’ ধর্ম-বোধ সম্বন্ধে অতি-অকিঞ্চিৎকর ধারণার পরিচয় তিনি যে অনেক জায়গায় দিয়েছেন, সে-সব সবিস্তারে বলবার প্রয়োজন করে না (কাজী ১৯৮৮: ৩৮৬)।

আহমদ ছফা © শিল্পকর্ম: আবীর সোম

“প্রশ্ন হল, এত পরের পরিবর্তিত সময়ে আজর কি সত্য সত্য [একই চেহারায়, একই পোশাকে,] একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল?”—অধ্যাপক আজমের এই প্রশ্ন শুনিয়া আমার একটা উচিত শিক্ষা হইল। মনে পড়িল, মানুষের ভাষায় আক্ষরিক ও আলঙ্কারিক নামে অন্তত দুই ধরনের অর্থ আছে। কথাটা মাঝে মাঝে আমরা ভুলিয়া যাই। ‘রূপক’ আর ‘লক্ষণা’ দুইটি অলঙ্কার মাত্র নহে—ইহারা যে কোন ভাষার ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ। একই নদীতে দুইবার পা ডোবানো যায় না—এই পুরাতন বাক্যটি স্মরণ করিলাম। মনে পড়িল, যে চেহারায় হউক আর যে পোশাকই পরিধানে থাকুক, এক জায়গায় কেহই দুইবার দাঁড়াইতে পারেন না। একই চেহারায় আর একই পোশাকে কোন ছার! আহমদ ছফার কথার এই অলঙ্কার যদি কেহ বুঝিতে না পারেন, তাহা আমারও পরম লজ্জার কারণ। আজও যে এই জাতীয় বিচারে বসিতে হইতেছে, ইহা ইতিহাসের দায়।

এই নিবন্ধে আহমদ ছফার কথা অনেক উদ্ধার করিয়াছি। আর কত উদ্ধার করিব! তিনি বলিয়াছেন, “বাঙালী মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে [বেশী] ভয় করে। তার আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসাভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে, আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সঙ্কুচিত”। কথাটি আজ মনে হইতেছে অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আহমদ ছফা অধিক গিয়াছেন:

বাঙালী মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত। সবচেয়ে মজার কথা, এ কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃৎকৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং তার একাংশ সেই সুফলগুলো ভোগও করছে, তাঁর অবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এঁচড়ে পাকা শিশুর মতো। অনেক কিছুরই সংবাদ সে জানে কিন্তু কোন কিছুই চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপনার করতে জানে না। যখনই কোন ব্যবস্থার মধ্যে কোনরকম অসঙ্গতি দেখা দেয় গোঁজামিল দিয়েই সে সবচেয়ে বেশী আনন্দ পায় এবং এই গোঁজামিল দিতে পারাটাকে রীতিমত প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে (ছফা ১৯৮১: ২৬)।

দুঃখের মধ্যে, আক্ষরিক আর আলঙ্কারিকের প্রভেদ ধরিতে না পারার প্রতিভাটাও গোঁজামিলন-পছন্দ বাঙালি মুসলমানের একচেটিয়া সম্পদ নয়। দীপেশ চক্রবর্তী মহোদয়ও দেখিলাম সাম্প্রতিক এক রচনায় অভিন্ন প্রতিভার নিদর্শন দেখাইয়াছেন। কি আপদ! তিনিও লিখিয়াছেন:

আহমদ ছফা নিঃসন্দেহে একজন শ্রদ্ধেয় মননশীল মানুষ। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনার অন্তর্দৃষ্টি মুগ্ধকর। কিন্তু মনে হয় যে সময়ে সময়ে একটু অসাবধানে লিখতেন। যেমন বঙ্কিম প্রসঙ্গে তাঁর বইতে দীনেশচন্দ্র সেন কেন ‘বঙ্কিমের রাগ, উষ্মা, ও বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন’ বোঝাতে যে যুক্তি তিনি দিয়েছিলেন তা ইতিহাস চিন্তায় যে কালানুক্রমিকতার শর্ত থাকে তাকে লঙ্ঘন করে। বঙ্কিমের উষ্মার কারণ বোঝাতে [তিনি] লিখেছিলেন যে “দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর দুখণ্ডে সমাপ্ত ‘বৃহৎ বঙ্গ’ [গ্রন্থে] বঙ্কিমবাবুর ধর্মের আসল স্বরূপটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন।” এখন, বঙ্কিম মারা গেছেন ১৮৯৪ সালে, আর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ [গ্রন্থের] প্রকাশ ১৯৩৫ নাগাদ। বঙ্কিম ঐ বই পড়ে চটবার সুযোগ পাবেন কখন (চক্রবর্তী ২০২০: ২৪)?

দীপেশবাবু যোগ করিয়াছেন, “তাছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনেশ সেনের সাক্ষাতের যে বর্ণনা ছফা দিয়েছিলেন—যদি তা দীনেশ সেনের আত্মজীবনী গ্রন্থের ভিত্তিতে লেখা হয়—সেই বর্ণনা আক্ষরিক অর্থে মূলানুসারী নয়। যেমন সেই সাক্ষাতের বর্ণনায় দীনেশবাবু লিখেছিলেন: ‘কুমিল্লার জলবায়ু, ধান চালের অবস্থা, স্কুল কলেজের কথা প্রভৃতি সমস্ত বিষয়েই আলোচনা চলিল। যতবার সাহিত্য সম্বন্ধে আলাপ করিতে চেষ্টা করিলাম, ততবার সে কথা এড়াইয়া ধান্যাদি সম্বন্ধে প্রশ্নের অবতারণা করিতে লাগিলেন’ (সেন ১৯৬৯: ১৩৩)। কিন্তু ছফা লিখেছেন: ‘তিনি [বঙ্কিম] জানতে চেয়েছিলেন দীনেশবাবুদের ওখানে তাজা তরিতরকারি পাওয়া যায় কিনা। সোনামুগ কি বাজারে বিক্রয় হয়, কচি লাউ এবং পাঁঠার মাংস নিয়মিত আসে কিনা’। দীনেশ সেনের আত্মজীবনীতে এতো ডিটেল নেই। যদি ছফার তথ্যসূত্র অন্য কোন বই হয়ে থাকে, তিনি তার নির্দেশ দেননি” (ছফা, ১৯৯৭: ২৮-২৯; চক্রবর্তী ২০২০: ২৪; মোটা হরফ এখানে যোগ করা হইল)।

দীপেশবাবু দানেশমন্দ আদমি। আক্ষরিক অর্থ কথাটা যখন তিনি মানেন, তখন আলঙ্কারিক অর্থ কথাটাও তাঁহার অজানা থাকার কথা নয়। দীনেশচন্দ্র সেনের রচনায় উল্লেখ আছে “ধান্যাদি সম্বন্ধে প্রশ্নের অবতারণা করিতে লাগিলেন”। অলঙ্কারশাস্ত্রে হাতেখড়ি মাত্রেই জানিবেন এই অলঙ্কারের নাম ‘নামান্তর’ বা লক্ষণা। এই অলংকারের অনুবাদ ‘মেটোনিমি’ ইংরেজিতে বলিলে হয়তো বেহতর হইবে। “ধান্যাদি” শব্দে বোঝায়—‘ধান্য’ হইতে শুরু করিয়া”। “অবতারণা” শব্দের ইঙ্গিতও তাহাই। আহমদ ছফা নিছক (ভাব সম্প্রসারণ করিয়া) যোগ করিয়াছেন চারিটি পদার্থের নাম—তাজা তরিতরকারী, সোনামুগ, কচি লাউ এবং পাঁঠার মাংস। যদি পাঁঠার মাংসের জায়গায় তিনি গোমাংসের কথা উল্লেখ করিতেন তবেই অনৌচিত্যদোষ ঘটিত। দীনেশবাবু কি উপায়ে ‘বঙ্কিমের রাগ, উষ্মা, ও বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন’ বুঝিতে হইলেও দীপেশবাবুকে ভাষার প্রথম বিধি—যাহার নাম ‘রূপান্তর’ বা রূপক—বিষয়ে সবক লইতে হইবে। ইহার ইংরেজি ভাষ্য (পুনশ্চ বলিতেছি) ‘মেটাফর’।

ভাষার বিধি বিষয়ে এই অনুপস্থিত প্রতিভা কাহারও—বা কোন গোষ্ঠীর—একচেটিয়া দৌলত নহে। এমন কি বাঙালি হিন্দু ধুরন্ধর বা বুদ্ধিজীবীরও নহে। নোম চমস্কি প্রভৃতি বিখ্যাত ইহুদি ভাষাতত্ত্ব ব্যবসায়ীও দেখিলাম একই গুণে গুণান্বিত। ইহাতেই প্রমাণ, রূপক ও লক্ষণার বিধি অনুধাবন না করিয়াও বিশ্বখ্যাত হওয়া যায়। পার্থক্যের মধ্যে, বাঙালি মুসলমান অধ্যাপকগণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয়ী। এই বাক্যটিতে তাহাদের বিশ্বাস কি প্রকট! “মীর মশাররফ হোসেনের আজর ছফার দাবি ও ভাষাকে নস্যাৎ করে দিয়ে পরিবর্তিত সময়ের বদলে-যাওয়া ভাব ও স্বভাব নিয়ে হাজির হয়েছে” (আজম ২০২১:১৯৫)।

আত্মবিশ্বাস এতই প্রবল যে ধরিয়া লইলাম তাহার কারণ আহমদ ছফার দাবি ও ভাষায় যতটুকু বোঝার জিনিশ সবটুকুই মনে হয় তিনি বুঝিয়া লইয়াছেন। ‘একই চেহারায়, একই পোশাকে, একই জায়গায়’—কথাগুলির অন্য কোন অর্থ সম্ভব? সে সন্দেহও করিলেন না। করিলে দেখিতেন, এই তিন ‘একই’ নির্দেশ করিতেছে যে একই ধর্মের—ধরুন কাণ্ডজ্ঞানহীনতার—আদেশে তাঁহার মনের আদৌ কোন পরিবর্তন হয় নাই। পরবর্তী বাক্য—“পুঁথিলেখকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে তিনিও বরণ করে নিয়েছেন”—তাহাই ইশারা করিতেছে। ও আল্লাহ! ভাষার বিধি সম্পর্কে কাণ্ডজ্ঞানের অভাব আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও মনীষার একশেষ করিল!

এক্ষণে মীর মশাররফ হোসেনের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীনতা’ কতখানি কাল হইয়াছে তাহার একটা কালতামামি করা যাইতে পারে। মুনীর চৌধুরী লিখিয়াছিলেন: “পাঠকের চিত্তে ভক্তিশ্রদ্ধার ভাব জাগরিত করবার জন্য মীরের পূর্বসূরীরা গ্রন্থারম্ভে যে পর্যায়ের ভণিতা-রচনার প্রথা চালু করেন, মশাররফ হোসেন তার অনুকরণ করেছেন মাত্র। পুঁথি-রচয়িতাদের আরবী-ফারসী জ্ঞান পরিমাপ করার সুযোগ আমাদের নেই, কিন্তু মীর-মানস যে প্রধানতঃ বাংলা পুঁথির দুনিয়াতেই লালিত ও বর্ধিত হয়েছে, তার অনেক প্রমাণ উল্লেখ করা যায়। স্বভাবতই পুঁথির বিশ্বস্ত সূত্রতায় প্রাপ্ত ‘বিষাদ-সিন্ধু’[র] অনেক ঘটনাই অলীক।”

এজিদের জন্মলাভের  কুৎসিত বৃত্তান্তটি পর্যন্ত মুহম্মদ খান, [হায়াত মামুদ], গরীবুল্লাহ্ ও সাদ আলী-আবদুল ওয়াহাবে লভ্য। যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনায় ডাহা আজগুবি অতিরঞ্জন, হোসেনের শির থেকে প্রবাহিত শোণিতবিন্দুর ধারায় এজিদের পরিণাম আরবী হরফে লিখিত এবং সেই খণ্ডিত শির উর্দ্ধাকাশ থেকে পতিত [হওয়া], স্বর্গীয় জ্যোতির আকর্ষণে আসমানে উঠে যাওয়া, পূর্বঘোষিত ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী কারবালা প্রান্তরের আকাশে বাতাসে বৃক্ষে মাটিতে আশু মরণ-সম্ভাবনার সহস্র ছায়াপাত ঘটা, ফোরাতে ভাসমান অবস্থায় প্রভুভক্তের পুত্রদ্বয়ের শূন্যশির যুগল দেহের কাছে পাত্রস্থ মস্তক ধরতেই সেগুলোর দেহ অনুযায়ী সঠিক যোগাযোগ হয়ে যাওয়া, সবই অবিকল পুঁথির নিয়মে ঘটেছে। এমন কি হানিফা-এজিদের লড়াই, সখিনা-কাসেমের বিবাদ, জয়নাবের রূপের খ্যাতি ও জায়েদের অসুস্থ ঈর্ষা, এগুলোও পুঁথির দান। এসব জিনিস আবিষ্কারের জন্য মীর মশাররফ হোসেনকে ইতিহাস অনুসন্ধানের কোন ক্লেশ স্বীকার করতে হয়নি। মৌলিক অলৌকিক কথা মীর মশাররফ হোসেন যে কিছুই বলেননি, তা নয়। তবে সেগুলো কোন গভীর চিন্তার ফল নয়, গ্রামীণ ঐতিহ্যানুশীলনের পরিণাম মাত্র” (চৌধুরী ১৯৮৪: ৪০)।

মীর মশাররফ হোসেনের কাণ্ডজ্ঞান সম্বন্ধে মুনীর চৌধুরী অধিক দূর গিয়াছেন: “মধ্যযুগের কবিরা যেখানে সত্য ঘটনার ওপর কারুকার্য করেছেন সেখানেই আজগুবি কথার অবতারণা না করে থাকতে পারেননি। কেবল ঘটনার মূল সূত্র নয়, তার ইহলৌকিক প্রকৃতি ও প্রাণধর্ম বিকৃত না করেও কল্পনাময় অতিরঞ্জন ও পুনর্সৃষ্টির আশ্রয় কেবল আধুনিক কালের শিল্পীরাই নিতে পেরেছেন। ইতিহাসের সত্যের সঙ্গে শিল্পের সত্যের পার্থক্য অনেক। কিন্তু মধ্যযুগের সত্যাসত্যবোধের সঙ্গে আধুনিক কবির বাস্তবানুভূতির পার্থক্য তার চেয়েও বেশী” (চৌধুরী ১৯৮৪: ৩৯)।

চৌধুরী সাহেবের এই বিশ্বাস হয়তো সর্বাংশে সঠিক নয়। ইহাতে ‘আধুনিক কালের শিল্পী’ আর ‘আধুনিক কবি’ সম্পর্কে যতটা তাঁহার উচ্চ ভাবাবেগ প্রকাশ পাইয়াছে ‘বাস্তবানুভূতি’ ততটা বিকাশের অবকাশ পায় নাই। ‘অতিরঞ্জন’ ও ‘পুনর্সৃষ্টি’ প্রভৃতি কথা খানিক বুঝি বুঝি মনে হয়। কিন্তু ‘বাস্তবানুভূতি’ প্রভৃতি অলীক কথা আধুনিক বিচারকের নিজস্ব সংস্কার বৈ নহে। চৌধুরী সাহেব বাল্টার বেনিয়ামিন প্রমুখের সবক নেওয়ার সুযোগ পান নাই। পাইলে হয়তো দেখিতেন, তথাকথিত ‘আধুনিক’ কালের শিল্পীরাও মহারূপক বা ‘অ্যালেগরি’ ব্যবসায়ী। সে কথা এখানে আর বাড়াইব না। চৌধুরী সাহেব ইহার পর কাজের কথা একটা বলিয়াছেন। তাহাই ধরিয়া রাখি:

মুহম্মদ খান, হায়াত মামুদ ও গরীবুল্লাহ্ অলীক কথার বাদশা। কথা যে কেবল বানিয়েছেন তাই নয়, বানিয়েছেন একেবারে মানবীয় সত্যাসত্যের সীমানা অতিক্রম করে। মীর সাহেব ‘বিষাদ-সিন্ধু’র প্রথমার্ধেও ইতিহাসকে উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু করলেও তিনি উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন, রূপকথা বা পুঁথি বানাননি। উদ্ধার পর্ব্বে শিল্পী মীর প্রকৃতই পতিত। এই অংশের অনেক স্থল যদি গদ্যের বদলে পদ্যে রচনা করতেন, তা হলে মীর অতি সহজেই মুহম্মদ খান—[হায়াত মামুদ]—গরীবুল্লাহ্‌র প্রাণের দোসর বলে বিবেচিত হতে পারতেন” (চৌধুরী ১৯৮৪: ৩৯)।

মুনীর চৌধুরীর উক্তি এখানেও বড় একদেশদর্শী হইয়াছে। তিনি যদি ধরিয়া লইয়া থাকেন ‘উপন্যাস’ কি ‘মহাকাব্য’ সৃষ্টি করা হইলেই ‘রূপকথা’ বা ‘পুথি’র দোষ মাপ হইয়া যায়, ভুল করিয়াছেন। চৌধুরী সাহেব বলিয়াছেন, শিল্পী মীর পতিত হইয়াছেন মাত্র উদ্ধার পর্ব্বে। তাঁহার আগে ও পরে অনেকেই বলিয়াছেন, মীরের একই পতন ঘটিয়াছে এজিদ-বধ পর্ব্বেও। সবিনয় নিবেদন করি, পতনের ছবি তো সতত সমগ্র ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাস কি মহাকাব্য জুড়িয়াই আছে। কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিমাণগত পার্থক্য নিরুপণের জন্য পুঁথিকারদের সহিত মীর মশাররফ হোসেনের তুলনা চলে, গুণগত পার্থক্যের জন্য নহে।

মুনীর চৌধুরী নিজেই এ সত্যে কদাচ সন্দেহ করেন নাই: “পুঁথির জীবনদৃষ্টি মধ্যযুগীয় অজ্ঞতা, ধর্মভীতি এবং অলৌকিকতামণ্ডিত। যেখানে এই পুঁথির প্রভাব পড়েছে সেখানেই এই অন্ধকার ছায়া ফেলেছে। এই আচ্ছন্নতা এতই সহজাত যে পুঁথির অনুসরণকারী বিদগ্ধ কবি-সাহিত্যিকরা পর্যন্ত একে এড়াতে পারেননি। এমন কি পুঁথি-সাহিত্যের সুশিক্ষিত আধুনিক সমালোচকরা পর্যন্ত এর প্রভাবাধীন হয়ে অপ্রমাণিত এবং অপরীক্ষিত সিদ্ধান্ত জাহির করতে আদৌ অস্বস্তি বোধ করেন না” (চৌধুরী ১৯৮৪: ৩৮)।

‘বিষাদ-সিন্ধু’র অলৌকিকতার ভূত জনৈক গবেষক—ইঁহার নাম ডক্টর মযহারুল ইসলাম—গরীবুল্লাহ্‌র কাঁধে চাপাইয়া হায়াত মামুদকে দায়মুক্তি দিতে চাহিয়াছিলেন। চৌধুরী সাহেব তাঁহাকে সরল ভর্ৎসনাই করিলেন:

ডক্টর মযহারুল ইসলাম [হায়াত] মামুদকে তুলনায় গরীবুল্লাহ্‌র চেয়ে অনেক বেশী মানবতাবোধসম্পন্ন এবং সত্যনিষ্ঠ মনে করেন। বোধ হয় সেই কারণে ‘বিষাদ-সিন্ধু’র অলৌকিকতার ভূত গরীবুল্লাহ্‌র কাঁধে চাপিয়ে আশ্বস্ত বোধ করেছেন। আমাদের মতে গরীবুল্লাহ্‌র ও হায়াত মামুদের কবিকৃতির পার্থক্য নিরূপণের জন্য উভয়ের মধ্যে অলৌকিকতার পরিমাণগত তারতম্য পরীক্ষা করা অনাবশ্যক ছিল (চৌধুরী ১৯৮৪: ৩৯)।

‘বিষাদ-সিন্ধু’, উদ্ধার পর্ব্ব, দ্বিতীয় প্রবাহ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আজম লিখিয়াছেন, “ভাষার দ্যুতি ও গতি, জীবনদৃষ্টির ঔদার্য এবং প্রবাদপ্রতিম বাক্যে তাকে রূপান্তরিত করার সাফল্য, নাটকীয়তা তৈরির স্বাভাবিকত্ব ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যে পরিচ্ছেদটি অতি উপভোগ্য”। হইতেই পারে, কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা করিতে হইবে, ‘জীবনদৃষ্টির ঔদার্য’ কি পদার্থ আর ‘নাটকীয়তা তৈরির স্বাভাবিকত্ব’ই বা কি চিজ। ‘ঔদার্য’ আর ‘স্বাভাবিকত্ব’ প্রভৃতি এ যুগের গালভরা বুলি রবিবাবুর হিং টিং ছট বিশেষ। আজম সাহেবের বিশ্লেষণ বিস্ময়কর:

মশাররফ কেবল অলৌকিকতা পরিহার করেই ক্ষান্ত হন নাই, ‘আধুনিক’ জীবনদৃষ্টির বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ নানা প্রেরণায় অংশটিকে বর্ণাঢ্য করেছেন। হোসেনের প্রতি আজরের দরদ ওর্ফে মানবিক-মর্যাদার দিক থেকে; আর তার শির-দখলের আকুলতাও মৃতের শেষকৃত্যের অধিকারের বরাতে। তার সমস্ত উচ্চারণে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গি, উদারনীতিবাদ এবং মানবিকতা ঠিকরে পড়েছে। কয়েক পৃষ্ঠার পরিচ্ছেদটিতে এক বর্ণের বিচ্যুতিও শনাক্ত করা যায় না (আজম ২০২১: ১৯৫)।

আলহামদুলিল্লাহ্! মনে হইতেছে, অধ্যাপক সাহেবের উপর অধ্যাপক পরম্পরায় সর্বমরহুম আনিসুজ্জামান আর মুনীর চৌধুরীর পথ বাহিয়া কাজী আবদুল ওদুদের ছায়াও পড়িয়াছে। এই ছায়া আধুনিকতার সংস্কার বিশেষ। আজর, তাহার পুত্রগণ এবং স্ত্রীর উক্তিতে প্রমাণ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কি পদার্থ। আজরের স্ত্রী বলিলেন, “এই হোসেন বিবি ফাতেমার অঞ্চলের নিধি, নয়নের পুত্তলি ছিলেন। হায়! হায়! তাহার এই দশা! এ জীবন থাক্ বা যাক্, প্রভাত হইতে না হইতে আমরা এ পবিত্র মস্তক লইয়া কারবালায় যাইব। শেষে ভাগ্যে যাহা থাকে হইবে।”

পুত্রেরা বলিল, “আমাদের জীবনপণ তথাপি কিছুতেই সৈনিক হস্তে এ মস্তক প্রত্যার্পণ করিব না। প্রাতে সৈনিককে বিদায় করিয়া সকলে একত্রে কারবালায় যাইব।’ পুনরায় আজর বলিতে লাগিলেন,—

ধার্ম্মিকের হৃদয় এক, ঈশ্বরভক্তের মন এক, আত্মা এক। ধর্ম্ম কি কখনও দুই হইতে পারে? সম্বন্ধ নাই, আত্মীয়তা নাই, কথায় বলে—রক্তে রক্তে লেশমাত্র যোগাযোগ নাই, তবে তাঁহার দুঃখে তোমাদের প্রাণে আঘাত লাগে কেন? ধার্ম্মিক জীবন কাহার না আদরের? ঈশ্বর প্রেমিক কাহার না যত্নের? তোমাদের কথা শুনিয়া, সাহস দেখিয়া প্রাণ শীতল হইল। পরোপকার ব্রতে জীবনপণ কথাটা শুনিয়াও কর্ণ জুড়াইল। তোমাদের সাহসেই গৃহে থাকিলাম। প্রাণ দিব, কিন্তু শির দামেস্কে লইয়া যাইতে দিব না (মীর ১৯৮০: ২৬০-৬১)।

আনিসুজ্জামান একহাতে লিখিয়াছেন, “কারবালার বিষাদান্ত ঘটনা এই গ্রন্থের বর্ণিতব্য বিষয়। গ্রন্থকার বলেছেন, ‘পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া বিষাদ-সিন্ধু বিরচিত হইল’। মশাররফ হোসেন আরবী-ফারসী জানতেন কিনা, তার স্পষ্ট উল্লেখ কোথাও পাই না। ‘মকতুল হোসেন’, ‘জঙ্গনামা’ ও ‘শহীদে কারবালা’ প্রভৃতি মিশ্র ভাষারীতির কাব্যে এই ঐতিহাসিক ঘটনার যে কাল্পনিক বিবৃতি আছে, ‘বিষাদ-সিন্ধু’তে আমরা তারই পরিচয় পাই। সম্ভবতঃ মিশ্র ভাষারীতির কাব্যকেই তিনি অনুসরণ করেছিলেন এবং তার একটি সাধু গদ্যরূপ পাঠকদেরকে উপহার দিয়েছিলেন” (আনিসুজ্জামান ১৯৬৪: ২৩৪-৩৫)।

মুনীর চৌধুরী আনিসুজ্জামানের মতো বাকসংযমী নহেন। তাঁহার বিচারে, মীর মশাররফ হোসেন “পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া” ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচিয়াছেন—“এ কথা অবিশ্বাস্য” (চৌধুরী ১৯৮৪: ৩৯)। আনিসুজ্জামান অবিশ্বাসী না হইলেও ঘোর সংশয়ী। তিনি পানি ছুঁইতে নারাজ, কিন্তু মাছ তাঁহাকে ধরিতেই হইবে। তাই অন্যহাতে লেখকের ‘মানসিকতার বিশেষ পরিচয়’ দিয়া নীচের অনুচ্ছেদটিও রচনা করিয়াছেন তিনি:

শিয়া মতাবলম্বী ফারসী কাব্য-রচয়িতাদের কাছে যেমন, তেমনি মিশ্র ভাষারীতির কবিদের কাছেও এই কাহিনী-কথনের অন্তরালবর্তী আবেগ তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গস্বরূপ ছিল। এজিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা, হাসান-হোসেনের প্রতি প্রবল ভক্তির উচ্ছ্বাস তাঁদের হৃদয় থেকে স্বতোৎসারিত হয়েছে। মশাররফ হোসেন কিন্তু ধর্মবুদ্ধির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে উপাখ্যান রচনা করতে বসেননি—ঐতিহাসিক চেতনার দ্বারা প্রণোদিত হয়ে তো নয়ই। কারবালা-কাহিনীর মধ্যে নিয়তি-নিপীড়িত মানবভাগ্যের যে করুণ লীলাখেলা প্রত্যক্ষ করে মাইকেল মধুসূদন এই বিষয় নিয়ে মহাকাব্য রচনার প্রেরণা অনুভব করেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ সেই প্রবল মানবীয় চেতনাই মশাররফ হোসেনকে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে (আনিসুজ্জামান ১৯৬৪: ২৩৫)।

উদ্বুদ্ধ করিলেই হইল না। তিনি কর্তব্যটা কিভাবে সম্পন্ন করিলেন তাহাও কি দেখিতে হইবে না! অধ্যাপক আজম তাঁহার উদ্ধৃতিবদ্ধ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি কোথায় খুঁজিয়া পাইয়াছেন এখানে তাহার একটা সন্ধান মিলিতেছে। তিনি যে লিখিয়াছেন, “‘আধুনিক’ জীবনদৃষ্টির বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ নানা প্রেরণা” পরিচ্ছেদটিকে বর্ণাঢ্য করিয়াছে—সেই প্রেরণা কি জিনিশ? এক—হোসেনের জন্য আজরের দরদ। দুই—মৃতের শেষকৃত্যের অধিকারের বরাতে তাঁহার “শির-দখলের আকুলতা”। তিন—তাঁহার সমস্ত উচ্চারণ ঠিকরাইয়া পড়িতেছে তিনটি কি চারিটি অমেয় পদার্থ: ‘ধর্মনিরপেক্ষতা,’ ‘সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গি’, ‘উদারনীতি’ এবং ‘মানবিকতা’।

ঐ পরিচ্ছেদে কি কি ঘটে তাহার অংশবিশেষ আমরা আগেই দেখিয়াছি। এখন অন্যান্য অংশ অল্পাধিক স্পর্শ করা যাইতে পারে। সীমারের কাছে আজর প্রস্তাব করিলেন মহামূল্য কর্তিত শির ঐ রাত্রির মতো তাহার হাতে দিতে। যুক্তিও দেখাইলেন। সীমারের কর্ণে কথাগুলি বড়ই মিষ্টবোধ হইল। আর দ্বিরুক্তি না করিয়া প্রস্তাব শ্রবণমাত্রেই সম্মত হইলেন সৈনিকপুরুষ: “গৃহস্বামী হোসেন মস্তক সম্মানের সহিত মস্তক লইয়া বহু সমাদরে গৃহমধ্যে রাখিয়া দিলেন। পথশ্রান্তিহেতু সীমারের কেবল শয়ন বিলম্ব; যেমনই শয়ন, অমনি অচেতন” (মীর ১৯৮০: ২৫৮)।

সীমারের নিদ্রার ভাব জানিয়া আজর স্ত্রীপুত্রসহ হোসেনের মস্তক ঘিরিয়া বসিলেন। এক পর্যায়ে সংকল্প করিলেন: “যাহাই হউক, আজরের এই প্রতিজ্ঞা জীবন থাকিতে হোসেন শির দামেস্কে লইয়া যাইতে দিবে না; যত্নের সহিত, আদরের সহিত, ভক্তি-সহকারে সে মহাপ্রান্তর কারবালায় লইয়া যাইয়া শিরশূন্য দেহের সন্ধান করিয়া সদগতির উপায় করিবে; প্রাণ থাকিতে এ শির আজর ছাড়িবে না” (হোসেন, ১৯৮০: ২৬০)। সকালবেলা সীমারের সহিত সুদীর্ঘ বাদানুবাদের পর:

আজর স্ত্রী পুত্রগণের নিকট যাইয়া বিষন্নভাবে বলিলেন, “হোসেনের মস্তক রাখিতে সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, তাহা বুঝি ঘটিল না। মস্তক না লইয়া সৈনিক পুরুষ কিছুতেই যাইতে চাহে না, আমি তোমাদের সাহায্যে সৈনিক পুরুষের ইহকালের মত লক্ষ টাকা প্রাপ্তির আশা এই স্থান হইতে মিটাইয়া দিতে পারিতাম। কিন্তু আমি স্বয়ং যাচ্ঞা করিয়া হোসেনের মস্তক আপন তত্ত্বাবধানে রাখিয়াছি। আবার সেও বিশ্বাস করিয়া আমার হস্তে সমর্পণ করিয়াছে; এ অবস্থায় উহার প্রাণবধ করিলে সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতার সহিত নরহত্যা পাপপঙ্কে ডুবিতে হয়। রাজ-অনুচর, রাজকর্ম্মচারী, রাজাশ্রিত লোককে প্রজা হইয়া প্রাণে মারা, সেও মহাপাপ। আমার স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, নিজ মস্তক স্কন্ধোপরি রাখিয়া হোসেনের মস্তক সৈনিকহস্তে কখনই দিব না! তোমরা ঐ খড়গ দ্বারা আমরা মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া সৈনিকের হস্তে দাও, সে বর্শায় বিদ্ধ করুক। খণ্ডিত শির প্রাপ্ত হইলে তিলার্দ্ধকালও এখানে থাকিবে না বলিয়াছে। তোমরা যত্নের সহিত হোসেনের মস্তক কারবালায় লইয়া, দেহসন্ধান করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উদ্যোগ করিবে, এই আমার শেষ উপদেশ। সাবধান কেহ ইহার অন্যথা করিও না” (মীর ১৯৮০: ২৬৩-৬৪)।

এই উচ্চারণে ধর্মনিরপেক্ষতা, সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গি, উদারনীতিবাদ এবং মানবিকতা যে ঠিকরাইয়া পড়িতেছে তাহার সংশয় নাই। শুদ্ধমাত্র একটা জিনিশই নাই যাহার নাম ‘কাণ্ডজ্ঞান’। একটা জিনিশই আছে যাহাকে ‘কাণ্ডজ্ঞানহীনতা’ ডাকা যাইতে পারে। আহমদ ছফা ইহার বেশি কি দাবি করিয়াছিলেন? তিনি কবুল করিয়াছিলেন এই লেখক “অত্যন্ত শক্তিধর”। শক্তিধর না হইলে কেহ কি এমন ‘আধুনিক’ অলৌকিকতার সাধন, এমন ‘অতিরঞ্জন’ ও ‘পুনর্সৃষ্টি’ সম্ভব করিতে পারেন? প্রশ্ন হইতেছে, ‘আধুনিকতা’ কি পদার্থ আর ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য’ই বা কাহাকে বলিব? মুনীর চৌধুরী একদা সত্য সত্য বলিয়াছিলেন, “আধুনিক বাংলা সাহিত্যে পঞ্চাশ বছরের পার্থক্য, তাৎপর্যের বিচারে, অনেক সময় প্রাচীন ও মধ্যযুগের কয়েক শত বৎসরের তুল্যমূল্য” (চৌধুরী ১৯৮৪: ১১)।

মীর মশাররফ হোসেনের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য লইয়া আধুনিক গবেষক অনেকখানি নিঃসংশয়। কাজী আবদুল ওদুদ তাঁহার তুলনায় খানিক কম। কাজী আবদুল ওদুদের সারানুবাদক সাজিয়া মুনীর চৌধুরী লিখিয়াছিলেন: “কাজী আবদুল ওদুদই প্রথম মীর-মানসের দ্বন্দ্বমূলক মূলসূত্র স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করেন”।

মশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বিষাদ-সিন্ধু’ বিশ্লেষণে উদ্যোগী হয়ে তীক্ষ্ন অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা তিনি মীর-মানসের একেবারে তলদেশ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করেছেন। বিপরীতধর্মী সরলতা ও জটিলতা, গতানুগতিকতা ও মৌলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধার্মিকতা, গ্রাম্যতা ও নাগরিকতা, মধ্যযুগীয়তা ও আধুনিকতা সকলই মীরের স্বভাবজ। বিগত কালের রসবোধ ও জীবন চেতনার যে প্রকাশ পুথি সাহিত্যে লক্ষ্য করি, মীর-মানস তার সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেনি  (চৌধুরী ১৯৮৪: ১২)।

মীর মশাররফ হোসেন অনুসৃত সাহিত্যাদর্শের অনাবিলতা, হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ লোপ করার সাধনা, ভাষারীতির সংস্কৃতানুসারী সাধুতা ইত্যাদি ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। মুনীর চৌধুরী এই কারণেই চতুর্মুখে ব্রজেন্দ্রনাথের প্রশংসা বিতরণ করিয়াছেন। ব্রজেনবাবুর লেখার নমুনা অনেকেই উদ্ধার করিয়াছেন। আমরাও করিলাম:

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘সীতার বনবাস’ বাংলা দেশের ঘরে ঘরে যেমন এককালে পঠিত হইয়াছিল, ‘বিষাদ-সিন্ধু’ তেমতই আজও পর্য্যন্ত জাতীয় মহাকাব্যরূপে বাঙালী মুসলমানের ঘরে ঘরে পঠিত হয়; বাংলা-সাহিত্যের অপূর্ব্ব সম্পদ্ হিসাবে সকল সমাজেই এই গদ্যকাব্যখানির সমান আদর। আর একটি কথা, আজ তাঁহার সম্পর্কে আমাদের স্মরণীয়—তিনি জীবনে এবং সাহিত্যে সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে ছিলেন, হিন্দু-মুসলমান—বঙ্গমাতার এই দুই বিবদমান সন্তানের মিলন সাধনের জন্য আজীবন চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সাহিত্য-প্রতিভা এমনই উচ্চশ্রেণীর ছিল যে, সুদূর অতীতের কারবালা-প্রান্তরের ট্র্যাজেডিকে তিনি সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর ট্র্যাজেডি করিয়া তুলিতে পারিয়াছেন (বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩৯৯: ৪৮)।

আগেই বলিয়াছি, মুনীর চৌধুরী ব্রজেনবাবুর লেখার অকুণ্ঠ প্রশংসা বাঁটোয়ারা করিয়াছিলেন: “এই সুনির্বাচিত সুশৃঙ্খলিত তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে আমাদের সাম্প্রতিক বর্ণনামূলক সংযোজনা এখন পর্যন্ত তুলনায় ক্ষীণ এবং গৌণ”। সঙ্গে সঙ্গে এই সামান্য কুণ্ঠাটুকুও তিনি অগোচর রাখেন নাই: “হয়ত স্বাভাবিক কারণে একটা বিষয়ে ব্রজেনবাবুর মীমাংসা সীমাবদ্ধ, একপেশে।” মুনীর চৌধুরীর বিচারে, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণের বাহিরে রহিয়া গিয়াছিল এই পদার্থ নিচয়: “মীর-মানসে মুসলমানী ঐতিহ্যের চক্রমণ, মীর-রচনাবলীর মধ্যে সেই ধর্মীয় চেতনার বহুরূপী প্রকাশ।” চৌধুরী সাহেব সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন: “মীর রচনাবলীর এক বৃহৎ অংশ যে এই প্রশ্নের বিশদ বিচার দাবী করে, সে কথা অস্বীকার করবে কে” (চৌধুরী ১৯৮৪: ৯)!

এই প্রশ্নের বিশদ বিচার যে কিছু পরিমাণ স্বয়ং চৌধুরী সাহেবই করিয়াছিলেন তাঁহার তুলনা নাই। তবে তাঁহার আগে এই কঠোর বিচারের পথ-প্রদর্শন মুহম্মদ আবদুল হাই সাহেবের কীর্তি। মীরের ধর্মনিরপেক্ষ কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কিছু আভাস হাই সাহেবের রচনায়ও মিলিবে। আবদুল হাইয়ের মতে, মীর মশাররফ হোসেন সজ্ঞানে উপন্যাস রচনা করিতে বসিয়াছিলেন। আর কারবালার বিষাদময় ইতিহাস তাঁহার যে অজানা ছিল এমনও নয়। কিন্তু হাই সাহেব অভিযোগও করিয়াছেন, “তবু লিখতে বসে তিনি ইতিহাসের যথার্থ অনুসরণ করেননি।” হাই সাহেবের বিচারে:

এ গ্রন্থ রচনায় মীর সাহেব ইতিহাস অনুসরণ যতটা না করেছেন, তার চেয়ে বেশী অনুসরণ করেছেন নানা কিংবদন্তীপূর্ণ উপাখ্যানমূলক পুথি সাহিত্যকে। কারবালার কাহিনী সংক্রান্ত মক্তুল হোসেন, জঙ্গনামা, শহীদে কারবালা প্রভৃতি পুঁথিই তাঁর বিশেষ অবলম্বন ছিল। এসব পুঁথিতে কারবালার বিষাদ করুণ কাহিনীকে আরও বিষাদময় ক’রে তোলার দিকে পুঁথিকাররা বিশেষভাবে নজর দিয়েছেন; মীর সাহেব সে বেদনাকেই মুসলমানদের জাতীয় বেদনা হিসেবে অভিব্যক্তি দেবার জন্য ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচনা করেন। মুসলমানদের এ জাতীয় বেদনাকে গভীরতা দেবার এবং সুদূরপ্রসারী ক’রে তোলবার জন্যেই তিনি বিষাদের এক সমগ্ররূপ ধ্যান করেছেন। যেমন বিন্দু সিন্ধুর ব্যাপ্তিসাধক ও স্ফীতিবর্ধক, তেমনি মহরম-সংক্রান্ত প্রচলিত গালগল্প এবং পুঁথির কাহিনীগুলো থেকে বিষাদময় ঘটনা ও কাহিনী আহরণ ক’রে তিনি তাঁর বিষাদ-সিন্ধুর শ্রী ও সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন” (হাই ১৯৬৪: ৭৯-৮০)।

শহীদ মুনীর চৌধুরী (১৯২৫—১৯৭১) 

বাঙালী মুসলমানের মন বিচার করিতে বসিয়া আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান সমাজে সমাদৃত পুথি সাহিত্যে নজর দিয়াছিলেন। পুথির বিচারে তিনি প্রথমে দেখিলেন তাহার ভাব, পরে ধরিলেন ভাষা। তাঁহার বিবেচনায়, ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হইবার কারণে নতুন সমাজে যে সামাজিক আকাঙ্ক্ষার জন্ম হইয়াছিল সেই আকাঙ্ক্ষার স্ফূর্তি কিংবা—তাঁহার ভাষায় বলিতে—‘পূর্ণদৈর্ঘ্যে মুক্তিলাভ’ ও অপূর্ণ থাকিয়া যাইবার পরিণতি এই পুথি। বাঙালি মুসলমান সমাজের দশা দাঁড়াইয়াছিল এমনই: আধিপত্য অর্জনের—নিদেনপক্ষে মুক্তি পাইবার—সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নাই। মরদ আছে, মুরোদ নাই।

তারপর তিনি অন্য দরজাটা খুলিলেন। ভাষার প্রশ্নে ভাবদ্বৈধ কি ক্ষতি করিল তাহা বুঝাইবেন বলিয়া একটু পিছন হইতে দুইটি কথা আমল করিলেন। প্রথম কথা: “ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবী ভাষা এবং ইসলাম অনেকটা অভিন্নার্থক ছিলো। আরবী ভাষা গ্রহণ না করে ইসলাম গ্রহণ করলে প্রকৃত মুসলমান হওয়া যাবে না, সে সময়ে এরকম একটা মত অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিলো”। এই যুক্তিতেই মিশর হইতে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের (যাহার নাম ‘মাগরেব’ বা অজানা মুল্লুক)—অধিবাসীগণ যুগপদ আরবি জবান ও আরব্য বর্ণমালা দুইটাই কবুল করিয়াছিলেন (ছফা ১৯৮১: ১৪)।

দ্বিতীয় কথা: পূর্বাঞ্চলে ইসলাম প্রসারের পর—বিশেষ ইরান যখন ইসলামে দীক্ষিত হয়—আরবির সঙ্গে ফারসিও ইসলামী মর্যাদা লাভ করে। ছফার ভাষায়, “ইরানীরা আরবী ভাষা গ্রহণ করেননি, কিন্তু আরবী বর্ণমালা তাঁদের মেনে নিতে হয়েছে। তারপরে ইরান থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পেরিয়ে ভারতবর্ষ অবধি মুসলিম শক্তির যে জয়যাত্রা সূচিত হয়েছে তার পেছন পেছন ফার্সী ভাষাও ভারতে প্রবেশ করেছে। এমন কি মোগল বিজেতারাও তাঁদের মাতৃভাষা তুর্কীর পরিবর্তে ফার্সীকেই সরকারী ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন” (ছফা ১৯৮১: ১৪-১৫)।

ফলস্বরূপ, ইসলামের সঙ্গে ভারতে যতটা ফারসি ও তুর্কি ভাষা আসিয়াছিল আরবি ততটা আসে নাই। ভারতে—ভাষার মহলে—আরেকটি মজার ঘটনা ঘটিয়াছে। আহমদ ছফার কথায়: “ভারতের হিন্দুরা বড়ো আশ্চর্য জাত, তাঁরা দরবারে চাকুরী করার জন্য উত্তমরূপে ফারসী ভাষা শিক্ষা করেছেন, ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো’ উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু নিজেদের ভাষা বাদ দিয়ে কখনো ঐ ভাষাটিকে গ্রহণ করেননি। সুতরাং ভারতে ফার্সী ছিলো জনগণের দৈনন্দিনতার স্পর্শলেশবর্জিত দরবারবিহারী একটি অভিজাত শ্রেণীর ভাষা। স্থানীয় মুসলিম জনগণের মধ্যেও তার বিশেষ প্রসার ঘটেনি। স্বাতন্ত্র্যগর্বী মুসলমানেরা নিজেদের প্রয়োজনে ফার্সী বর্ণমালাকে গ্রহণ করে ভারতীয় ভাষাসমূহের সমন্বয়ে উর্দু নামে একটি পাঁচমিশেলী ভাষা তৈরী করেছেন” (ছফা ১৯৮১: ১৫)।

এই দুঃখেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একদা বিলাপ করিয়াছিলেন, “ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উত্তর ভারতে তুর্কি ও অন্যান্য বিদেশি মুসলমানরা রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হওয়ার ফলে একটি নতুন বিদেশি—আরব্য অথবা আরব্য-পারস্য—লিপি লইয়া আসা হয়, শতাব্দীক্রমে কোন কোন ভারতীয় ভাষায় এই লিপি গ্রহণ করা হইলে পরিণতিস্বরূপ তাহা ভারতের জাতীয় লিপির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া দাঁড়ায়, এমন কি কার্যক্ষেত্রে কাশ্মীর আর সিন্ধু প্রভৃতির মতন কোন কোন ভাষাভাষী অঞ্চল হইতে তাহাকে উৎখাত করে” (চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৪-৩৫: ৩১৮; দুবের ২০২০: ২০৬০)।

নানাদেশ হইতে আগত বাংলাদেশের বহিরাগত অভিজাত শ্রেণীর ভাষাও হইল ফারসি। দেশজ মুসলমানেরা যত ধর্ম পরিবর্তন করিয়াছিলেন তত ভাষাবদল করিতে পারিলেন না। তবে তাহারা প্রশাসক ও ধর্মপ্রচারকগণের ভাষাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখিতে বাধ্য হইলেন। আহমদ ছফার মন্তব্য প্রাসঙ্গিক: “বাঙালী মুসলমানের চোখে ফার্সী এবং উর্দু ভাষা দুটো আরবীর মতই পবিত্র ছিলো। আর এই দুটো রাজভাষা এবং শাসক নেতৃশ্রেণীর ভাষা হওয়ায় তাঁদের শ্রদ্ধা নিশ্চয়ই অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিলো। কিন্তু এ দুটির একটিকেও পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করার জন্য একটি সমাজের পেছনে যে শক্ত আর্থিক ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ থাকা প্রয়োজন ছিলো দু’টির কোনটিই তাদের ছিলো না” (ছফা ১৯৮১: ১৫-১৬)।

বাঙালি মুসলমানের অন্তত একাংশ একসময় কি কারণে, কোন বিশ্বাসে আরবি বর্ণমালা এস্তেমাল করিয়া বাংলা লিখিবার কোশেস করিয়াছিলেন সে কথাও ছফা সংক্ষেপে বিবৃত করিলেন: “কিন্তু বাঙালী মুসলমানেরা নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে আরবী, ফার্সী এবং উর্দু এই তিনটি ভাষায় তালিম গ্রহণ করার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। আরবী, ফার্সী এবং উর্দু ভাষাটাও যখন তাদের পক্ষে পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করা অসম্ভব মনে হয়েছে তখন তারা ঐ বর্ণমালাতে বাংলা লেখার চেষ্টা করেছেন”। এক্ষণে একটা মন্তব্যও যোগ করিতে বাধ্য হইলেন তিনি: “এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে নেয়ার আছে, কোন ব্যক্তি বিশেষ একটা ভাষা রপ্ত করতে পারেন। কিন্তু সেটাকে সামাজিকভাবে রপ্ত করা বলা চলে না”  (ছফা ১৯৮১: ১৬)। মোট কথা, বাংলাদেশ কখনও আরবি-ফারসি তো পরের কথা, উর্দুও সামাজিকভাবে রপ্ত করিতে পারে নাই।

থিবো দুবের বলিয়াছেন, “আঠার শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আরবি হরফে লিখিত বেশির ভাগ হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির অনুলিপি প্রস্তুত করা হয়েছিল ও সংরক্ষণ করা হয়েছিল চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চলে যা আজকের মিয়ানমারের অংশ। সংরক্ষিত রাখা সতের শতকের পাঠগুলো দেখে মনে হয় যে আরবি হরফে বাংলা লেখার চর্চা সতের শতকেই আরম্ভ হয়েছিল” (দুবের ২০২০: ১৪৪৯)।

দুবের সাহেবের সিদ্ধান্ত এমন আহামরি কিছু নয়। ইহাকে ‘অসামান্য বিশ্লেষণ’ বলা হীনমন্যতার নিদর্শন মাত্র। তিনি স্বীকারই করিয়াছেন, স্বদেশী ভাষায় বইপুস্তক রচনার জন্য কেন আরবি হরফ গ্রহণ করা হইয়াছিল তাহার সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায় নাই। তারপরও দুবের লিখিয়াছেন, “যদিও এ অনুমান অনস্বীকার্য যে স্বদেশিয় সাহিত্যের ইসলামিকরণের জন্যই হয়তো এই চর্চার সূচনা হয়েছে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল এই একটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করা ভুল হবে। এক সম্প্রদায়ের প্রভাব-বলয় থেকে আরেক সম্প্রদায়ের প্রভাব-বলয়ে প্রবেশের ঘটনাকে নির্দিষ্টভাবে হিন্দুয়ানি থেকে মুসলমানি সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হওয়া বলা যায়, এবং এই ঐতিহাসিক পট-পরিবর্তনের মধ্যে নিহিত আছে এক জটিল অভিজ্ঞতাপ্রসূত ও ধারণাপ্রণোদিত রদবদল, যার সাথে স্পষ্ট করে সাম্প্রদায়িকতার যোগসূত্র নেই” (দুবের ২০২০: ১৪৪৯)।

‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলিতে দুবের কি বুঝিয়াছেন তাহা আদৌ পরিষ্কার নয়। যাহা তিনি জানেন না, তাহার সহিত যোগসূত্র আছে কি নাই জানিবেন কিভাবে! দুবের সাহেব—যতদূর দেখিতে পাই—আহমদ ছফার লেখার সহিত পরিচিত হইবার সময় লাভ করেন নাই। তিনি—দেখিতেছি—আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতামত উদ্ধৃত করিয়াছেন। দুবের হিসাব কষিয়া পাইয়াছেন, আবদুল করিম “একাই শত শত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন, সেগুলো আজকেও সংরক্ষিত যে কোনো হরফে লিখিত প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সর্বমোট হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিগুলোর প্রায় অর্ধেক। তিনি যতগুলো বাংলা সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন তার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশটিই ছিল আরবি হরফে লিখিত” (দুবের ২০২০: ১৪৪৯)।

দুবের বেশ সাহসী হইয়াছেন। এই সাহসের মধ্যে প্রাচ্য ব্যবসায়ীর বাড়াবাড়ি দৃশ্যমান। এই অহমিকা কপটতার অপর পিঠ: “আবদুল করিমের মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাদ্রাসাসমূহে যে ব্যক্তিরা শিক্ষালাভ করেছিলেন তারা বাংলা পড়তে ও লিখতে শেখেননি। কিন্তু, কিছু কিছু পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণে মনে হয় যে এই মতামত সার্বিকভাবে সত্য নয়। কারণ, বেশ কিছু হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি ও সেগুলোর পুষ্পিকা পর্যবেক্ষণ করলে প্রমাণ পাওয়া যায় যে মাদ্রাসায় পড়লেও তারা একাধিক ভাষায় অক্ষরজ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে তারা বাংলা পড়তে জানতেন” (দুবের ২০২০: ১৪৫৯)। দুবেরের এই উক্তি দুর্বল ও সরল। কোন ভাষায় অক্ষরজ্ঞান জন্মিলেই ঐ ভাষায় জ্ঞান হইল বা অধিকার জন্মিল বলে না। দুবের সাহেব যেনবা ইচ্ছা করিয়াই বলিতেছেন, ধর্মাবিশ্বাস বা ভাবাদর্শ এক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই পালন করে নাই।

আহমদ ছফা যে ব্যাখ্যা দিয়াছেন তাহার সহিত আবদুল করিমের ব্যাখ্যা গোড়ায় মিলিলেও শেষ পর্যন্ত দুই ব্যাখ্যা কিন্তু স্বতন্ত্র। যাঁহারা আরবি হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা করিয়াছেন তাঁহারা বাংলায় অক্ষরজ্ঞান লাভ করেন নাই—এমন কোন কথা আহমদ ছফা অঙ্গীকার করেন নাই। তখনও বাংলায় সামাজিকভাবে বাংলা শিক্ষার প্রসার হয় নাই—একথা তো ধ্রুব সত্য। ‘সামাজিকভাবে রপ্ত করা’ বলিতে আহমদ ছফা তাহাই নির্দেশ করিয়াছেন। আহমদ ছফার ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাঁহার কথায়, “ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকেও আরবী হরফে বাংলা পুঁথিপত্র যে লেখা হয়েছে সেটাকে ক’জন অবসরভোগী পুঁথিলেখকের নিছক খেয়াল মনে করলে ভুল করা হবে। আসলে তা ছিলো বেহেশতের ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ!” (ছফা ১৯৮১: ১৬)।

প্রচলিত অর্থে যাহাকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’—বা ‘জাতীয়তা’—বলা হয় তাহার সহিতও আরবি বর্ণমালায় বাংলা লেখার সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আরবি (অথবা আরবি-ফারসি) হরফে ভারতীয় ভাষাদি লেখার চেষ্টাকে ভারতীয় লিপির ‘প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী’ বলিয়াছিলেন। দুবের সাহেব বাংলা ভাষা অনেক দূর শিখিলেও সবটুকু শেখেন নাই। বাংলা ভাষা এত সরল বা কৃপার পাত্র নয়। সুনীতিবাবুর ইংরেজিতে ব্যবহৃত ‘এ সিরিয়াস রাইভাল’ কথাটির বাংলা অনুবাদ তিনি করিয়াছেন ‘মারাত্মক শত্রু’ (দুবের ২০২০: ১৪৬০)। উত্তর ভারতে ত্রয়োদশ শতক নাগাদ এই নতুন লিপি আমদানির দায় সুনীতিবাবু চাপাইয়াছেন তুর্কি ও অন্যান্য বিদেশি মুসলমান রাজশক্তির ঘাড়ে ঘাড়ে। তিনি সিন্ধু কি কাশ্মীরে আরব্য-পারস্য লিপি প্রবর্তনে আহত হইতেই পারেন। পক্ষান্তরে, এই ঘটনাকে শুদ্ধমাত্র আরবি লিপির ধ্বনিতাত্ত্বিক গুণ বা গৌরবের ফল মনে করাও আবার উল্টো সরলতার আমদানি বৈ নয়। এই কথাটা যে উপরচালাকি তাহা মনে রাখিতে হইবে।

থিবো দুবের আরেকটা অসার দাবি করিয়াছেন, “ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে বলতে গেলে, এখানে গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখতে হবে, ঘটনাচক্রে বাংলা ভাষা লিখিতরূপে প্রকাশের ক্ষেত্রে আরবি হরফ বাংলা লিপির চেয়েও বেশি প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে উঠতে পেরেছিল। কেননা, আরবি হরফ অনেক বেশি ধ্বনিবৈশিষ্ট্য (উচ্চারণবৈশিষ্ট্য) প্রকাশে সক্ষম যা বাংলা বর্ণমালা দিয়ে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হতো না” (দুবের ২০২০: ১৪৬০-৬১)।

নবীন প্রাচ্য-ব্যবসায়ী দুবের সাহেব বাংলা পাণ্ডুলিপি আরবি অক্ষরে লেখার একটি সম্ভাব্য ভাষাতাত্ত্বিক (যাহা মূলত ধ্বনিতাত্ত্বিক) কারণ প্রস্তাব করিয়াছেন মাত্র। তিনি এই উপলব্ধির পেছনের বড় দুইটি কারণ—বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ও পবিত্র ভাষাস্বরূপ আরবির সম্মান—এই প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণই এখতিয়ারের বাহিরে রাখিয়াছেন। আরবি হরফ বাংলা বর্ণমালার তুলনায় বাংলা ভাষার ধ্বনিবৈশিষ্ট্য অনেক বেশি প্রকাশে সক্ষম—কি সক্ষম নয়—এই মাতব্বরি প্রশ্ন উত্থাপনের আগে আরো একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। সেই প্রশ্নের ডাক নাম ‘বাসনা’—অর্থাৎ যাহাকে বলে ‘আমি চাই তাই আমি’। এখানে বানান এক হইলেও দুই ‘আমি’ কিন্তু এক আমি নহে। ফরাশি দার্শনিক দেকার্তই এ কথা প্রথম হাজির করিয়াছিলেন। একটি বহিঃশক্তির হাত আছে দুইয়ের মাঝখানে।

আরবি হরফে অনেক বেশি ধ্বনিবৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা যায় বলিয়া বাঙালি মুসলমান আরবি অক্ষর গ্রহণ করেন নাই—বাংলা অক্ষরজ্ঞান অর্জন কঠিন বলিয়াও তাহার দ্বিধা উপস্থিত নহে। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিলেন বেহেশতের ভাষা যে অক্ষরে লেখা হয় সেই অক্ষরের কাতারে শামিল হওয়ার—বা অন্য কোন কারণের—জন্য। উদাহরণ তো হাতের কাছেই ছিল—ইরানিরা আরবি গ্রহণ করিয়াছেন, করিয়াছেন তুর্কিরা, উত্তর ভারতের নতুন ভাষা উর্দুও গ্রহণ করিয়াছে নাস্তালিক লিপি। তো বাংলা কেন দূরে থাকে! এই যুক্তি দুবের সাহেব আদৌ বিবেচনায় লন নাই। তবু দুবেরের এই শোচনীয় বিশ্লেষণই গবেষকের চোখে ‘অসাধারণ’ ঠেকিয়াছে (আজম ২০২১: ১৯৮)।

নিজের বিশ্বাস অনুসারে সকলের সমালোচনার অধিকার সকলেরই ষোল আনা আছে। এই বিশ্বাসের অনুপান যদি হয় অজ্ঞান অহমিকা আর অন্যায় অবিশ্বাস তবে তাহা ভয়াবহ। অধ্যাপক আজম কি কারণে আহমদ ছফার বিশ্লেষণকে ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অনৈতিহাসিক’ বলিয়া তিরস্কার করিলেন তাহা বুঝিতে পারিলাম না। অথচ কিছুক্ষণ না যাইতেই তিনি বলিলেন: “এত এত তথ্যবিকৃতি এবং অনৈতিহাসিকতা সত্ত্বেও ছফার শেষ সিদ্ধান্তটি ঠিক হতেও পারে: বাঙালি-মুসলমান আরবি, ফারসি ও উর্দুর জন্য অন্ধ-আবেগ লালন করত” (আজম ২০২১: ১৯৮-৯৯)।

এই সত্যে সন্দেহ কি! তবে এই হয়তো শেষ কথা নয়। কথাটি দুবের সাহেবের চোখে সম্পূর্ণ ছানি ফেলিয়া দিয়াছে। মুনীর চৌধুরীর ভঙ্গি ধার করিয়া বলিতে ইচ্ছা হয়, বাঙালি মুসলমানের আরবি-ফারসি-উর্দু প্রীতি জায়েজ করার জন্য তুলনায় “বাঙালি-হিন্দু শতাব্দী-পরম্পরায় সংস্কৃতের প্রতি যে অন্ধ আবেগ” দেখাইয়াছে তাহার পরিমাণগত তারতম্য পরীক্ষা করার আবশ্যকতা ছিল না।

যদি কোন যুক্তি আপনি খণ্ডনই করিতে চাহেন তবে ঐ যুক্তির যেখানে পরিপূর্ণ প্রকাশ সেখানেই খণ্ডন করিবেন। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তির কুশ-পুত্তলিকা দাহ করিয়া কোন ফায়দা হইবে না। আহমদ ছফার যুক্তিখণ্ডনের নামে আপনি একটা খড়ের পুতুল গড়িয়াছেন, আর তাহাতেই আগুন দিয়া তপস্যা শুরু করিয়াছেন। তর্কে জিতিবার বাসনা অপরিমেয় বলিয়া আপনি বিনাদোষে সততার সীমালঙ্ঘন করিতে কুণ্ঠা করেন নাই। উদ্ হইতে আহরণ ভুরি ভুরি করা যাইতে পারে। তবে একটা মাত্র হরণ করিয়াই এই যাত্রা অবসরে যাইব।

পুনশ্চ আহমদ ছফার আশ্রয় লইতেছি: “বাঙালী মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না, এবং জানে না এই কথাটি ঢেকে রাখার যাবতীয় প্রয়াসকে তার কৃষ্টি-কালচার বলে পরিচিত করতে কুণ্ঠিত হয় না” (ছফা ১৯৮১: ২৬)। তিনি যাহা লিখিয়াছিলেন পারিলে তাহা খণ্ডন করুন। যাহা লেখেন নাই তাহা আরোপ করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করা যাইবে, তাহাতে সত্যের হেরফের হইবে না। আহমদ ছফা লিখিতম্:

বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতা সাহিত্যের দুই মুখ্য উপাদান। বিশ্বাস অভিজ্ঞতার নবরূপায়ণে সাহায্য করে। আলোকিত বিশ্বাস আলোকিত রূপায়ণ ঘটায় এবং অন্ধবিশ্বাস অন্ধ রূপায়ণ। মুসলমান পুঁথিলেখকদের বিশ্বাসের যে শক্তি তা অনেকটা অন্ধবিশ্বাস, কেননা ইসলামী জীবনবোধসমৃদ্ধ বিমূর্ত কোন ধারণা তাঁদের ছিল না। তাই তাঁদের শিল্পকর্ম অতটা অকেলাসিত। প্রতিপদে কল্পনা হোঁচট খেয়েছে বলে তাঁদের রচনার শক্তি নেই। আলাওল, দৌলত উজীর প্রমুখ মুসলমান কবি উৎকৃষ্ট কাব্যরচনা করতে পেরেছেন। তার কারণ তাঁদের কতিপয় সুযোগ ছিলো। আলাওল নিজে আরবী ফার্সী এবং সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। কাব্যের স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতা সম্বন্ধে তাঁর পরিপূর্ণ বোধ ছিলো। তদুপরি তিনি রাজসভায় বসে কাব্যরচনা করেছিলেন। রাজসভায় যে রুচি-চর্চা এবং জীবনাদর্শের আলোচনা চলতে পারে, জনসভায় তা চলে না। একই কথা দৌলত উজীর সম্বন্ধেও কম-বেশী প্রযোজ্য (ছফা ১৯৮১: ৮-৯)।

প্রসঙ্গক্রমে আরেক দল কবির কথাও আহমদ ছফা উত্থাপন করিয়াছেন যাঁহারা ছিলেন বাঙালি মুসলমান সমাজের নিয়ম। আলাওল প্রমুখ ছিলেন ব্যতিক্রম: “কিন্তু যে সকল মুসলমান কবিকে জনগণের ধর্মবোধ পরিতৃপ্তি এবং রসপিপাসা মিটাবার জন্য কলম ধরতে হয়েছিল সেখানে কবি কি বলতে চান, কাদের জন্য বলতে চান এবং যা বলছেন তা অনুধাবণযোগ্য কিনা এইসব বিবেচনার বিষয় ছিলো” (ছফা ১৯৮১: ৯)।

একটু পরেই তিনি ইঁহাদের কথাই আবার লিখিলেন: “সুযোগ পেলে তাঁরা আরবিতে লিখতেন, নইলে ফার্সীতে, নিদেনপক্ষে উর্দুতে। যখন দেখা গেল এর একটাও সামাজিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয় তখন তাঁরা বাধ্য হয়েই বাংলা লিখতে এসেছিলেন”। আহমদ ছফা আরো একটা ব্যতিক্রমের কথা বলিয়াছেন। এই ব্যতিক্রমের নাম আবদুল হাকিম। একশ্রেণীর পুথিলেখক আরবি, ফারসি, কিংবা উর্দু লিখিতে চাহিয়াও সফল হইতে পারেন নাই—কারণ সামাজিকভাবে ঐ সব ভাষার একটাও বাংলাদেশে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। সপ্তদশ শতাব্দীর এবং সন্দ্বীপের কবি আবদুল হাকিম ব্যতিক্রমবিশেষ। তিনি লিখিয়াছিলেন এই বিখ্যাত পয়ার যাহা বাংলা ভাষার দাবায় আজও নিত্য ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

যেজন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী
সেজন কাহার জন্ম নির্ণএ ন জানি।

এই বাণী ব্যর্থ হইয়াছিল। মমতাজুর রহমান তরফদার লিখিয়াছেন, “এ বাণীর আবেদন ব্যাপকভাবে সার্থক হতে পারত কোনো-না-কোনো মধ্যবিত্ত লোকজনের মধ্যে; কিন্তু সে-কালে বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠেনি” (তরফদার ১৯৯৪: ৩০)।

আহমদ ছফা মন্তব্য করিলেন আবদুল হাকিম বাংলা ভাষাতে লিখিতে বসিয়াছিলেন দুই কারণে। প্রথম কারণ: বাংলা তাঁহার একমাত্র আদি এবং অকৃত্রিম ভাষা। দ্বিতীয় কারণ: যাহারা সত্য সত্য বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করিতেন হাকিম সাহেব তাহাদের “শ্রেণীভুক্ত” ছিলেন না। বাড়তি কারণ: বাংলা ভাষাকে যাহারা ঘৃণা করিতেন তাহাদের সেই উঁচু ভাষায়—ধরিয়া লইলাম সেই ভাষা ফারসিতে—তাঁহার অধিকার ছিল না।

কোন ভাষা জানা বলিতে কি অধিকার বোঝায়? ভাষাবিশেষ হইতে অনুবাদ করিবার সামর্থ্য থাকা মানে সেই ভাষায় অধিকার থাকা বোঝায় না। অধিকার শব্দের ব্যাপক অর্থ আধিপত্য, সংকীর্ণ অর্থ স্বাচ্ছন্দ্য। আহমদ ছফা বৃথা লেখেন নাই:

আবদুল হাকিমের এই উক্তির মধ্যে প্রচণ্ড একটা ক্ষোভ এবং মর্মবেদনা লক্ষ্য করা যায়। সে সময়ে নিশ্চয়ই এমন লোক ছিলেন যারা সত্য সত্য বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করতেন। আবদুল হাকিম নিজে সে শ্রেণীভুক্ত নন, তাই সে উঁচু ভাষাতে তাঁর অধিকারও ছিল না। তাই তিনি তাঁর একমাত্র আদি এবং অকৃত্রিম ভাষাতেই লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন (ছফা ১৯৮১: ১৭)।

অধ্যাপক আজমের মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক: “কিন্তু আলাওলের বিপরীত উদাহরণ হিসাবে একই কালের কবি সৈয়দ সুলতানের নাম নেয়া যেতে পারে। আবদুল হাকিমের কথা বলা যেতে পারে। ছফা অবশ্য ভুল করে আবদুল হাকিমকে পুথি সাহিত্যের গোত্রভুক্ত করেছেন। ভুলভাবে ভেবেছেন যে, আবদুল হাকিম আরবি-ফারসি জানতেন না। যাই হোক, আলাওল-দৌলত উজিরের বিপরীতে দোভাষী পুথিকে স্থাপন করা যায় না। কালগত ব্যবধান আছে। ভাবগত ব্যবধান—যে ব্যবধানের উপর খোদ তাঁর থিসিস প্রতিষ্ঠিত—আরো অনেক বেশি” (আজম ২০২১: ১৮৫)।

আবদুল হাকিম আরবি-ফারসি জানিতেন না, আহমদ ছফা সে কথা বলেন নাই। তিনি বলিয়াছেন হাকিমের সে অধিকার ছিল না। আবদুল হাকিম সপ্তদশ শতাব্দীর লোক এবং তিনি বাংলা ভাষায় লেখার সিদ্ধান্ত লইয়াছিলেন। আমরা জানিতে পারিয়াছি তিনি ফারসি ভাষাটা জানিতেন। ইহাতে তাঁহার সিদ্ধান্ত অধিক বৈপ্লবিক পর্যই তাৎপর্যই বহন করে। তবে বঙ্গে জন্মিয়াও যাহারা বঙ্গবাণীকে হিংসা করিতেন তাহাদের তিনি খাতের বাহিরে নিক্ষেপ করিতে পারেন নাই। দুর্ভাগ্যের মধ্যে, নীচুতলার মুসলমানদের উপর ঐ হিংসুকগণের প্রভাবই প্রবল ছিল—শুদ্ধমাত্র সপ্তদশ শতাব্দীতে নয়, অষ্টাদশ, মায় ঊনবিংশ শতাব্দীর অস্তাচল পর্যন্ত। আহমদ ছফার কথায় অধ্যাপক আজমের গাত্রদাহ হইতে পারে। কেননা তিনি আরো একপ্রস্ত সত্যের সন্ধান পাইয়াছেন: “স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে যে অধিকার-চেতনা অপেক্ষাকৃত পরে জাগ্রত হয়, আসলে তা ছিলো ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের আন্দোলন এবং অগ্রগতির সম্প্রসারণ মাত্র” (ছফা ১৯৮১: ২৩)।

এই সময় বাঙালি মুসলমানদের কাতার হইতে যাঁহারা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করিবার সামর্থ্য অর্জন করিয়াছিলেন তাঁহাদের মনও দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। একদিকে বাঙালি হিন্দু সমাজের—মানে উঁচুবর্ণের হিন্দুদের—আধিপত্য, অন্যদিকে উত্তর ভারতের সামন্ত মনোভাবাপন্ন অভিজাত মুসলমান শ্রেণীর নেতৃত্ব—এই দ্বিধার দুই মেরু। আহমদ ছফার জবানিতে: “লেখাপড়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থস্বার্থের দিক থেকে অনেকদূর অগ্রসর হিন্দু সমাজের সঙ্গে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো এবং অন্যদিকে উঁচুতলার মুসলমানদের মূল্যচেতনা এবং জীবনদৃষ্টিকে স্বীকার করে নেয়া ছাড়া তাঁদের গত্যন্তর ছিলো না” (ছফা ১৯৮১: ২৩)।

বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেও যে বাঙালি মুসলমান মনের এই দ্বিধা কিংবা ত্রিধা কাটে নাই—কোন বিশেষ হেরফের হয় নাই—তাহার এক প্রমাণ ভাষা বিষয়ে তাহাদের অপরিণামদর্শিতায় মিলিতেছে। দ্বিতীয় প্রমাণ: সমস্ত সামাজিক কর্মকাণ্ড ধর্মের চৌহদ্দিতে সীমিত রাখার মধ্যে। মৌলবি সৈয়দ আহমদ খান আরবি ও ফার্সি জানিতেন—জানিতেন ভালো ইংরেজিও—তবু উত্তর ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের স্বার্থে তিনি মাতৃভাষা উর্দুতেই লিখিতেন। কিন্তু বাংলাদেশে যাঁহাদের মুসলমান সমাজের নেতা—সৈয়দ আমীর আলী আর নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখ—বলা হইত তাঁহারা ইংরেজি অথবা উর্দুতেই মশগুল থাকিতেন। আহমদ ছফার কথায়, “তাঁরাও নীচুতলার মুসলমান অর্থাৎ বাঙালী মুসলমান সম্বন্ধে চিন্তা করার কোন অবকাশই পাননি। শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সংস্কার বলতে তাঁদের মনে প্রভুত্ব হারানো উঁচুকোটির মুসলমানদের কথাই জাগরুক ছিলো” (ছফা ১৯৮১: ২৩; মোটা হরফ যোগ করা হইল)।

ভাষার প্রশ্নেই ‘বাংলার মুসলমান’ অর্থাৎ উঁচুতলার মুসলমান—নেতারা—বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। আর বাঙালি মুসলমান সমাজও নিজেদের কর্তব্য সর্বদা নির্ধারণ করিতে পারেন নাই। উর্দু ও ফারসির মোহ তাহাদিগের সামাজিক লক্ষ্য দুই কি তিন ভাগে ভাগ করিয়া ফেলিয়াছিল। বিগত শতাব্দীতে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম হইবার পর—ব্যাজের ব্যাজ আর কাহাকে বলে!—ইংরেজির মোহ এই দ্বি কিংবা ত্রিমুখিনতার আগুনে নতুন ঘৃতাহুতি দান করিয়াছে।

বাঙালি মুসলমান সমাজে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক প্রতিভাবানের অভাব হয় নাই কোনদিন। কিন্তু প্রতিভার সামাজিক শর্ত যতদিন অপূর্ণ থাকিবে ততদিন সেই প্রাকৃতিক প্রতিভা কোন সামাজিক কাজে আসিবে না। আহমদ ছফা মোটেও ভুল বকেন নাই: “মৌলিক চিন্তাভাবনা করেছেন এমন মানুষ মুসলমান সমাজে খুব বেশি জন্মাতে পারেনি। নতুন যুগের আলোকে জগত এবং জীবনকে ব্যাখ্যা করে সমাজের সামনে তুলে ধরেছেন এমন মানুষ সত্যই বিরল” (ছফা ১৯৮১: ২৪)।

সামাজিক লক্ষ্যের এই দ্বি কিংবা ত্রিমুখিনতার অন্য কুফল কি রাজনীতিতে কি সমাজনীতিতে রক্ষণশীল চিন্তার আধিপত্য। এই রক্ষণশীলতার শেষ দুর্গ ধর্মের মুখোশ—শুদ্ধ মুখোশ নহে মুখবিশেষ। আহমদ ছফা ঊনবিংশ শতাব্দীর বহুল আলোচিত দুইটি আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, “বাঙালি মুসলমান বলতে যাদের বোঝায় তারা মাত্র দুটি আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন এবং অংশগ্রহণ করেছিলেন” (ছফা ১৯৮১: ২৫)।

এই দুই আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র—অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বলিয়াই—ছিল প্রগতিশীল। এ সত্যে সন্দিগ্ধ না হইয়াও আহমদ ছফা সাহসের সহিত উচ্চারণ করিলেন—ইহাদের সামাজিক আদর্শ ছিল পশ্চাদগামিতার নামান্তর। এই আন্দোলনগুলি হিন্দু জমিদার শ্রেণী আর শাসক ইংরেজশক্তির মুখোমুখি দাঁড়াইতে ভয় পায় নাই কিন্তু সামাজিক গতিহীনতার—বা আরো ভালো হয় যদি বলি অসমগতির—গোড়ায় হাতও দিতে পারে নাই। হাত দেবেন কোথায়! তাহারা নিজেরাই তো গতিহীনতার আলামত! তাই ‘সামাজিক দিক দিয়ে পশ্চাদগামী’। আহমদ ছফার মন্তব্যের সারবত্তা যাহাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে নাই তাহারা বলিতেই পারেন, “বস্তুত উনিশ শতকের ধর্মীয় পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনগুলোই বাংলাদেশের সমাজের সামষ্টিক তাজাভাব ও বিকাশ অব্যাহত রেখেছিল” (আজম ২০২১: ২০১)।

তথাকথিত ওয়াহাবি ও ফরায়জি আন্দোলন কেন সামাজিক দিক দিয়ে পশ্চাদগামী তাহার ব্যাখ্যা আহমদ ছফা দিয়াছেন। তিনি বাঙালি মুসলমানের পরাজয়ের মধ্যেও জ্যান্ত বা ‘তাজাভাব’ অস্বীকার করেন নাই। ধর্মান্তর গ্রহণেই তাহার প্রমাণ। কিন্তু তিনি মনে করিয়াছেন একান্ত ধর্মকেন্দ্রিক কল্পনা-প্রতিভার দোষেই এই সমাজের জাগতিক বিকাশ ব্যাহত হইয়াছিল। তিনি এই আন্দোলনের শ্রেণীচরিত্রও বিশদ করিয়াছেন। খুব কম লোককেই দেখি এই বিচারের মর্ম বুঝিতে পারেন। ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের দেহে আর মনে—প্রয়োজনে আর আয়োজনে—বিচ্ছেদ ঘটিয়াছিল।

এই দু’টি আন্দোলনেই বাঙালী মুসলমানেরা মনেপ্রাণে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু উঁচু শ্রেণীর মুসলমানেরা এই আন্দোলন সমর্থন করেছেন তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। আসলেও কৃষক জনগণই ছিলেন এই আন্দোলন দু’টির হোতা। আধুনিক কোনো রাষ্ট্র এবং সমাজ দর্শন এই আন্দোলন দু’টিকে চালনা করেনি। সে সময়ে বাংলাদেশে আধুনিক রাষ্ট্র এবং সমাজ সম্পর্কিত বোধের উন্মেষ ঘটেনি বললেই চলে। সমাজের নীচুতলায় কৃষক জনগণকে সংগঠিত করার জন্য ধর্মই ছিল একমাত্র কার্যকর শক্তি (ছফা ১৯৮১: ২৫)।

যে কোন নতুন ধর্মের হাজারো হিতকর দিক থাকে। এইসবের মধ্যে ধর্মাদর্শের সংগঠন ক্ষমতা অতুলনীয়। কিন্তু সমাজে যে ভেদাভেদ সকল ভেদাভেদের গোড়া, যে ভেদাভেদ দিন দিন আরো বেশি শক্তিশালী হইয়াছে, তাহার উচ্ছেদসাধনের ক্ষমতা ধর্মের আছে কিনা সংশয়। সামাজিক প্রভুত্ব ও প্রতাপের অধিকারী শ্রেণীই কোন দেশের আসল শাসক শ্রেণী। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হইবার পরও বাঙালি মুসলমানেরা সেই প্রভুত্ব আর প্রতাপের অধিকারী শ্রেণীর হাত হইতে ছাড়া পাইয়াছেন এমন প্রমাণ নাই। লাভের মধ্যে, তাহাদের নিজ শ্রেণীর—নীচু জাতিবর্ণ এবং শ্রেণীর—অন্তর্গত ভাই-বেরাদরের সঙ্গে জল-অচল পার্থক্য তৈরি হইল। মুসলমান রাজশক্তির সঙ্গে তাহাদের নৈকট্যও আদৌ বাড়িল না (নিয়োগী ১৯৯০: ৯৭৪)।

একহাতে কখনও তালি বাজে না। এই সামাজিক পশ্চাদগামিতার ইতিহাসে বাঙালি উঁচুবর্ণের হিন্দুনেতাদের প্রতিভাও কম কার্যকর প্রমাণিত হয় নাই। মমতাজুর রহমান তরফদার সেই দুঃখের একপ্রস্ত সারমর্ম দিয়াছেন:

দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর শাসন-শোষণের জন্য বিদেশী ও বিজাতি তুর্কী-আফগান-মোগল শাসকদের প্রতি শিক্ষিত হিন্দুর মনে সঙ্গত কারণেই বিদ্বেষ জমেছিল। এই বিদ্বিষ্ট মনোভাব নিয়ে তাঁরা তাঁদের প্রতিবেশী মুসলমানের দিকেও তাকালেন এবং তাদেরকেও বিদেশী মনে করার অভ্যাসটি আয়ত্ত করলেন। বঙ্কিমের উপন্যাসগুলিতেও এই মনোভাব কখনো প্রচ্ছন্নভাবে এবং কখনো বা প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। হিন্দুদের এই সঙ্গীন মানসিকতাও মুসলমানদের বহির্মুখিনতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং প্রাক-মুসলিম যুগের ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি তাদেরকে অনেকটা উদাসীন করে তুলেছিল (তরফদার ১৯৯৪: ৩০)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনগুলি—হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজেই—জাগিয়া উঠিয়াছিল বেশ কিছু পরিমাণে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের তৎপর্যতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। এখানে আমরা শুদ্ধ বাঙালি মুসলমান সমাজের আন্দোলন দুইটির প্রভাব প্রসঙ্গেই আমাদের মন্তব্য সীমিত রাখিব। তরফদার সাহেব লিখিয়াছেন, “মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর সাধারণ নিম্নশ্রেণীর হিন্দু, বৌদ্ধ, ও কৌম সমাজের লোকজন ইসলামে দীক্ষা দেন। নবদীক্ষিত লোকজনের সংস্কৃতিতে প্রায় অটুট রইল পূর্বোক্ত শ্রেণীগুলির মধ্যে প্রচলিত অনার্য ধ্যান-ধারণা—জড়বাদী ও প্রতিবাদী মানসিকতা। মুসলমানদের এই অনার্য সংস্কৃতিই উনিশ শতকের মৌলবাদী ওহাবি ফরায়াজি বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল” (তরফদার ১৯৯৪: ৯)।

বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রয়োজনে আর আয়োজনে—দেহে আর মনে—পরকীয়া আগেও ছিল। দেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর সেই পরকীয়া পরিপূর্ণ বিচ্ছেদে—মায় মারাত্মক মারাত্মক কলহে—পরিণত হয়। বাঙালি মুসলমান সমাজের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানের বিরোধ বা বিভেদ প্রায় ছিল না বলিলেই চলে। মুসলমান সংস্কৃতির শহর-বন্দরকেন্দ্রিক রূপটি গড়িয়া উঠিয়াছিল উর্দু-ফার্সি ভাষা ও অভিজাত মুসলমানদের লইয়া। এই অভিজাত শ্রেণী ইংরেজ অধিকারের পর শেষ হইয়া গেল। কিন্তু তাঁহাদের জায়গায় বাংলাভাষী মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়িয়া উঠিতে ঊনবিংশ শতাব্দী পার হইয়া যায়। তরফদার সাহেব লিখিয়াছেন:

বৌদ্ধ ও হিন্দু সমাজের নিম্নস্তর থেকে দীক্ষিত মুসলমানগণ স্বাভাবিকভাবে তাদের আদি পেশায় পুরুষানুক্রমে নিয়োজিত থাকলেন। সামাজিক গতিশীলতা সৃষ্টির জন্য কতকগুলি চালিকাশক্তির দরকার। এগুলি হচ্ছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পেশার পরিবর্তন, ধন সঞ্চয় বা পুঁজির গঠন এবং ভূমি ও রাজশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন। এসব চালিকাশক্তির কোনটিই সাড়ে ছয় শ’ বছরে বাঙালি মুসলমানদের অধিগত হয়নি। হিন্দু সমাজে এই শক্তিগুলি বরাবর সক্রিয় ছিল বলে প্রাক-মুসলিম আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত—সেই সমাজে প্রায় একটানাভাবে একটি মধ্যশ্রেণীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতিহাসের এই অসমগতির দরুন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যবিত্তের ইতিহাসও আর্থ-সামাজিক কারণেই অনেকটা স্বতন্ত্র হয়ে গিয়েছিল (তরফদার ১৯৯৪: ৯)।১০

বাঙালি মুসলমান সমাজের বিষাদান্ত অন্তর্বিরোধের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিবার মতন নতুন কিছু বর্ণহিন্দু ভদ্রলোকও জুটিয়াছেন। দৃশ্যত: বঙ্কিমের যুগ আজও বিগত হয় নাই। অধ্যাপক গৌতম ভদ্রের প্রগতিশীলতার আবড়ালে এই কপট ঘৃতাহুতির একটি উত্তম উদাহরণ পাইলাম। বাঙালি মুসলমান সমাজের পিছাইয়া থাকার জাগতিক কার্যকারণের দিকে তিলার্ধ ভ্রুক্ষেপও না করিয়া তিনি যাহা লিখিয়াছেন তাহা অসততার (ইংরেজিতে যাহাকে বলে ‘ব্যাড ফেইথ’) চূড়ান্ত নিদর্শন: “উনিশ শতকের পুঁথি সাহিত্যে ‘ঈমান’ শব্দের ছড়াছড়ি। পুরোনো ক্ষমতার অবসান, নতুন শাসনতান্ত্রিক কাঠামোয় চাকুরির সন্ধান, ‘ওহাবী আন্দোলন’ ইত্যাদি নানা নতুন অভিজ্ঞতার মোকাবেলা দেশজ মুসলমানরা করছিল। ফলে প্রচলিত ও ‘সনাতনী’ বর্গগুলিকে বার-বার যাচাই করা, প্রয়োজনমাফিক সেগুলিকে জাহির করার তাগিদ দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। হাতে লেখা পুঁথিতে ও পরে বটতলায় ছাপা পুঁথিতে, নানা কেচ্ছা, মসলা মাসায়েল (ধর্মীয় জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন) সম্পর্কিত আলোচনায় এই তাগিদের চিহ্ন স্পষ্ট” (ভদ্র ১৯৯৪: ৪০১-০২)। ‘অস্বাভাবিক নয়’ বলিয়াই তিনি কর্তব্য সমাপন করিলেন না। যাঁহারা এই ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রাকৃত’ দশার অবসান প্রার্থনা করিলেন তাঁহাদের টুঁটিও চাপিয়া ধরিলেন নবযুগের এই বঙ্কিমচন্দ্র।

সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় দোভাষী সাহিত্যের নমুনা হিসাবে বা রোমান্স নির্ভর কাহিনী, আফসানা বা রূপকথার নজির হিসাবে এই রচনাগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেনের কথা বলাই বাহুল্য, আহমদ ছফা বা আনিসুজ্জামানের মত মুক্তবুদ্ধি সমালোচকরাও তাঁদের রচনায় এই পুঁথির জগতকে কুণ্ঠা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতে এই রচনাগুলি অনাধুনিক, জ্ঞানদীপ্তিতে উজ্জ্বল নয়, পুরাতন গৌরবগাথা ও ধর্মীয় মানসিকতায় আচ্ছন্ন” (ভদ্র ১৯৯৪: ৪০১-০২)।

গৌতম ভদ্র কি বলিতে চাহেন এই রচনাগুলি তাহার সংগৃহীত প্রতিজ্ঞার বিপরীত—অর্থাৎ আধুনিক জ্ঞানদীপ্তিতে অনুজ্জ্বল, পুরাতন গৌরবগাথা ও ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতায় আচ্ছন্ন—নয়? তিনি এখানেই থামেন নাই। পাদটীকাক্রমে উটকো যে স্থুল মন্তব্য তিনি করিলেন তাহা কি অর্থ বহন করে কিছুই বুঝিলাম না। ‘অগ্রগণ্য’, ‘প্রণম্য’ প্রভৃতি স্তোকবাক্যের আড়ালে তাঁহার ঘৃণা কোথাও অপ্রচ্ছন্ন নয়। তিনি লিখিতে কুণ্ঠিত হন নাই কিন্তু তাঁহার এই তুলনা নিরর্থক: “বাংলার ইসলামি পুথি সাহিত্য নিয়ে গবেষণার নানা ধারা আছে। মুনসী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ এবং আহমদ শরীফ সংগ্রাহক ও সম্পাদক রূপে অগ্রগণ্য ও প্রণম্য। সুকুমার সেনের রচনাও একই গোত্রভুক্ত” (ভদ্র ১৩৯৪: ৪১৪-১৫)।

মনে পড়িতেছে ১৯৭০-৭১ সালে নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদার ও সরোজ দত্ত প্রভৃতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের বিরুদ্ধে মূল্যায়নের নামে “কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ” করিতেন। ঐ সময় সরোজ দত্ত ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় ‘শশাঙ্ক’ ছদ্মনামে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কুৎসা রটনা করিয়াছিলেন। এই নকশালপন্থী বাবুদের বিষয়ে সমর সেন তাঁহার ‘বাবু বৃত্তান্ত’ নামক স্মৃতিকথায় যাহা লিখিয়াছিলেন ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে তাহার উদ্ধৃতি দিয়াছেন বদরুদ্দিন উমর। আমরা এখানে সমর সেনের বাক্য তুলিয়া রাখিতেছি: “আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার, বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা নক্শালপন্থীরা পর্যন্ত করেননি। তাঁর কোন প্রস্তরমূর্তি তাঁরা ভাঙেননি। সরোজ দত্তও অনেকের বিরুদ্ধে লিখেছেন, কিন্তু বঙ্কিমের বিরুদ্ধে তাঁর কলম থেকে কোন কথা বের হয়নি” (উমর ২০২১: ২৯২)।

গৌতম ভদ্র অতঃপর আহমদ ছফা, আনিসুজ্জামান, আর দীনেশচন্দ্র সেনের কুশপুত্তলিকা দাহ করিলেন। জ্বালানিস্বরূপ মুহম্মদ এনামুল হকের নামও লইলেন। আহমদ ছফার ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ সম্পর্কে তিনি অশিষ্ট ও অভদ্র ভাষায়, তাচ্ছিল্যের সহিত বলিলেন: “অন্যদিকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে গড়ে ওঠার প্রেক্ষিতে ইসলামি পুঁথি সাহিত্যকে বাস্তবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিরিখে ‘পিছুটান’ বলে তকমা মেরে দেওয়ার প্রবণতা অপ্রত্যাশিত নয়”। বিশ্লেষণের চেষ্টাটা তাঁহার শ্রদ্ধা অর্জন করিল না। পরিতাপের সহিত স্মরণ করিতেছি, বদরুদ্দিন উমর সত্য কথাই বলিয়াছিলেন: “… নকশালপন্থীরা যেভাবে বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙছেন, তাঁদের সমালোচনা করছেন, তার দ্বারা বিপ্লবের কোন সুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া সে কাজ করলে জামায়াতে ইসলামী আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে” (উমর ২০২১: ২৯১)।

এক্ষণে দেখিতে পাইতেছি, বদরুদ্দিন উমরের ভবিষ্যদ্বাণী বৃথা যায় নাই। গৌতম ভদ্রের পাশে মোহাম্মদ আজমও নীরবে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দ্বিতীয় বার ট্র্যাজেডি আকারে নাও ঘটিতে পারে। আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য’ সম্পর্কেও একই অবজ্ঞা প্রদর্শনপূর্বক ভদ্র মহাশয় লিখিলেন, “বিচারে অনেক বেশী ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করলেও আনিসুজ্জামানের বিখ্যাত গ্রন্থও এই ছকের অন্তর্ভুক্ত।” দীনেশচন্দ্রের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ হইতে একটি পংক্তিও উদ্ধার করিলেন তিনি: “প্রসঙ্গত লক্ষণীয় দীনেশচন্দ্র সেনের মন্তব্য, ‘মুসলমানী কেচ্ছার কলুষস্রোতের মুখে পড়িয়া বঙ্গসাহিত্য কলুষিত হইয়াছিল”। পরিশেষে—শাক দিয়া দুই চারিটা রোহিত মাছও ঢাকিলেন: “ব্যতিক্রমী মন্তব্যের নিদর্শন পাওয়া যায় মহম্মদ এনামুল হকের রচনায়। সাধারণ বাঙালী মুসলমানের জনসাহিত্যকে অবজ্ঞা করে ‘জাতীয় সাহিত্য’ সৃষ্টির প্রকল্পের বিরুদ্ধে তিনি মতপ্রকাশ করেন” (ভদ্র ১৯৯৪: ৪১৫)।

কোন জিনিশকে অবজ্ঞা না করা আর তাহাকেই ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ বলিয়া আত্মকণ্ডুয়ন করা এক জিনিশ নয়। এই প্রভেদ বুঝিতে না পারাকে কপট সাধুতা বা অসততা ছাড়া আর কিই বা বলা যায়!

হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন আহমদ ছফা

বাঙালি মুসলমানের সমস্যা লইয়া আহমদ ছফাই প্রথম লেখেন নাই। আশা করি, তাঁহাকে এই বিষয়ের শেষ লেখক বলারও প্রয়োজন হইবে না। যে সকল কথা তিনি নতুন বা প্রায় নতুন করিয়া বলিয়াছেন তাহার মধ্যে—আর্যবিজয় বা বর্ণাশ্রমধর্ম প্রতিষ্ঠার পর যাহারা শুদ্র, অচ্ছ্যুৎ, নিপীড়িত বা ব্রাত্য বলিয়া পরিগণিত হইয়াছিলেন তাহারা কি তাহাদের একাংশ কালক্রমে ইসলামে দীক্ষিত হইয়াছিলেন—এই কথাটাই মুখ্য। দ্বিতীয় কথা, ইসলামে দীক্ষিত হইয়া—অল্পাধিক ছয় শত বৎসরের মুসলিম শাসনাধীন রাষ্ট্রে বসবাস করিবার পরও—তাহাদের জাগতিক অবস্থার কোন দৃশ্যমান উন্নতি হয় নাই। তৃতীয় কথা, ইংরেজ রাজশক্তির অধীনে থাকিবার সময় মুসলমান অভিজাত শ্রেণী ধ্বংস হইয়া গেল, কিন্তু নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়িয়া উঠিল না। অথচ প্রতিবেশী হিন্দু সমাজে মুসলমান শাসনের যুগ হইতে লব্ধপ্রতিষ্ঠ উচ্চবর্ণের নেতৃত্ব ইংরেজ আমলে সমৃদ্ধির পথে আরো অগ্রসর হইল। ইহারই পরিণতিস্বরূপ বাঙালী মুসলমান সমাজে পুরানা সেই বিষাদান্ত, লক্ষ্যহীন, দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব নতুনভাবে গড়িয়া উঠিল। এই মনোভাব হইতে সে সমাজ আজও নিষ্কৃতি পাইল না।

১৯২৬ সালে ঢাকায় গঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামক প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনে পঠিত নিবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদও যথাসম্ভব শিষ্ট ভাষায় একই উপলব্ধির কথা প্রকাশ করিয়াছিলেন: “বাংলার মুসলমান সমাজের বয়স কম নয়, অন্যূন সাত আট শত বৎসর হবে; এই দীর্ঘ কালেও সে-সমাজ যদি এমন কোনো শক্তিমানের সূতিকাগার না হ’য়ে থাকে যাঁর কর্ম-প্রেরণায় সেই সমাজের লোকদের অন্তরে নব নব আশা ও উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে ও অন্যান্য সমাজের লোকের চিত্তে শ্রদ্ধা ও আনন্দ জেগেছে, তাহলে তার অবস্থা শুধু শোচনীয় নয় অত্যন্ত চিন্তনীয়। তারই ইঙ্গিত করে যদি কেউ বলেন বাংলার মুসলমান-সমাজ হীন উপকরণে গঠিত, তবে তাতে শুধু অসহিষ্ণু হয়ে আর কি লাভ হবে” (কাজী ১৯৮৮: ৬৭)।

পরাজয়ের পর পরাজয়ের এই স্মৃতি বিষণ্ণতার যে প্রলেপ পুরুষ-পরম্পরাক্রমে বাঙালি মুসলমানের গায়ে মাখিয়াছে তাহাকেই আহমদ ছফা তুলনা করিয়াছিলেন বাইবেলের ‘অরিজিন্যাল সীন’ বা আদিপাপের সহিত। আমরা মহাত্মা জিকমুন্ট ফ্রয়েডের কথা ধার করিয়া বলিতে পারি, ইহা আদিপাপের স্মৃতি নহে—আদিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি। আদিকাণ্ডকে ইংরেজি বচনে বলিতে হয় ‘প্রাইমাল সিন’। ইতিহাসে এই কাণ্ডেরই নিরন্তর পুনরাবৃত্তি চলিতেছে। ইহা হইতে বাহিরে আসিবার কোন পথ আহমদ ছফা সরাসরি নির্দেশ করেন নাই। তিনি শুদ্ধ বলিয়াছেন, “দু’ বছরে বা চার বছরে হয়তো এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না। কিন্তু বাঙালী মুসলমানের মনের ধরণ-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো পাওয়াও যেতে পারে” (ছফা ১৯৮১: ২৭)।

এই নির্মোহভাবে জানারই আধুনিক নাম ফ্রয়েডের আবিষ্কার বা মনোবিশ্লেষণ। সবিনয় নিবেদন করি: বাঙালি মুসলমান সমাজের ইতিহাসে এই মনোবিশ্লেষণের শ্রেষ্ঠ পথ-প্রদর্শক আহমদ ছফা। আমাদের ধারণা, আহমদ ছফা সারকথাটাই বলিয়াছিলেন—নির্মোহভাবে জানার চেষ্টাই প্রথম কাজ। আহমদ ছফার প্রস্তাব দুইটি যদি আমরা মহাত্মা ফ্রয়েডের ভাষায় তর্জমা করি তো দেখিব যাহাকে বলা হইয়াছে ‘বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস’ তাহা সেই আদিকাণ্ডের—বর্ণাশ্রমধর্মের যূপকাষ্ঠে পতিত অভিজ্ঞতার স্বয়ংক্রিয় পুনরাবৃত্তি-সমাহার বৈ নয়। ইহা হইতে বাহির হইয়া আসিবার কোন পথ যদি থাকে তবে সেই পথও পুনরাবৃত্তির মধ্যেই নিহিত। জাক লাকাঁ স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন অজ্ঞান বাসনার মৃত্যু নাই। অজ্ঞান বাসনা—যতই দমনের শিকার হউক—নানাবিধ সাকার লক্ষণে অর্থাৎ ভাষার আকারে বাঁচিয়া থাকে (ফেলম্যান ১৯৮৭: ৩৯-৫১)।

পুনরাবৃত্তির অপর নাম ভাষা কিনা জানি না, কিন্তু ভাষার অপর নাম পুনরাবৃত্তি বৈ নয়। কারণ অজ্ঞানের গড়ন অবিকল ভাষার মতো। ভাষা মানেই গড়ন। এই গড়নের অধীনে থাকিয়াই ভাষা নিত্যনতুন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মাতিয়া ওঠে। তাই এই পুনরাবৃত্তি সেই আদিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি মাত্র হইবে না। অভিন্ন হইয়াও তাহা হইবে ভিন্ন। ভিন্ন এই অর্থে যে দ্বিতীয় আবৃত্তিটা হইবে—পুনরাবৃত্তির মধ্যস্থতায়—আদিকাণ্ডের অর্থ কি তাহা খুঁজিয়া বাহির করিবার শল্য। তাহা হইতে বাহিরে আসিবার নিদান। আদিকাণ্ডের বিশ্লেষণ করিবার কর্তব্যই তাহাকে পুনরাবৃত্তির মধ্যে নতুনের বাহির হইয়া আসার পথের—অর্থাৎ সমাধানের—সন্ধান দান করিবে। পুনরাবৃত্তির মধ্যস্থতায় আদিকাণ্ডের বা কারণের অনুসন্ধান—ইহাই বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসে আহমদ ছফার অবিস্মরণীয় দান।

বোধিনী

১    সম্প্রতি অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী লিখিয়াছেন, ‘ছফার প্রবন্ধের প্রথম প্রকাশ ১৯৮১ সালে। আমি যে সংস্করণটি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি তা আরও পনেরো-ষোল বছর পরের, ২০১৭ সালের” (চক্রবর্তী ২০২০: ১৬)। এখানে বলিতে হয়, প্রথম তথ্যটি সঠিক নহে। ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁহার একই নামের বই। দীপেশবাবু বোধ হয় এই দুইটি প্রকাশকাল একপাত্রে গুলাইয়া ফেলিয়াছেন। ছাপাখানার ভূতের কারণে দ্বিতীয় গোলমালটা বাধিতে পারে। ১৯৮১ সালের পনেরো-ষোল বছর পর ১৯৯৬-৯৭ হয়, ২০১৭ সাল হওয়ার কথা নয়। অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমও ভুল করিয়াছেন; প্রবন্ধটির উল্লেখ করিতে বসিয়া তিনি আনমনে একাধিকবার ১৯৭৭ লিখিয়াছেন (আজম ২০২১: ১৮০, ১৮৫)। দুঃখের বিষয়, তাঁহার ‘গ্রন্থসূত্র’ তালিকায় ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ প্রবন্ধ কিংবা বই কোনটাই স্থান লাভ করে নাই।

২    “স্বধর্মী হলেও বাঙালী মুসলমান শাসনকার্যে মোগলদের সমান অংশীদার হ’তে পেয়েছিল, ইতিহাস এ মতের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দেয়। যে আভিজাত্য অর্থ ও শক্তির ওপর নির্ভর করে তাতে বাঙালীদের স্থান ছিল খুবই কম, উত্তর ভারতাগত ইরানী, তুর্কী বা রাজপুত শাসকশ্রেণীই তা নিয়ন্ত্রণ করেছে” (হবিবুল্লাহ ১৯৭৪: ১৫২-৫৩)।

৩    আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ বাংলা ১৩৫০ (ইংরেজি ১৯৪৩) সনে লিখিয়াছিলেন: “…এ মত পোষণ করা অন্যায় নয় যে, মোগল বিজয়ে শুধুমাত্র বাঙালী সমাজে ভেদ সৃষ্টির বীজই নিহিত ছিল না—মুসলমান সমাজকেও তা দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছিল। কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও বাঙালী মুসলমানের মধ্যে আশরাফ্ ও আতরাফের যে শ্রেণীভেদ ছিল ও এখনও কোথাও কোথাও আছে তার জন্ম এই মোগল যুগেই” (হবিবুল্লাহ ১৯৭৪: ১৫৪)।

৪    দীপেশ চক্রবর্তী এই ইঙ্গিতটা খানিক ধরিতে পারিয়াছেন মনে হয়। তিনি লিখিয়াছেন, “… এখানে আহমদ ছফার কয়েকটি মৌলিক বক্তব্য আমাদের এগোতে সাহায্য করে। কিন্তু আহমদ ছফার হাত ধরে এগোনোর আগে তাঁর ঐ ছোট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী, অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ও সৃষ্টিধর্মী প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’—যা অবলম্বন করে আমরা এগোবো—সে সম্বন্ধেও দু একটি কথা বলা দরকার। ছফার এই প্রবন্ধটি একটি ম্যানিফেস্টো গোছের রচনা। মূলত বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্য করেই তিনি তাঁর বক্তব্য রেখেছেন। তার ফলে তাঁর লেখাটিতে একটি বিশেষ আলঙ্কারিক ঝোঁক আছে। মাঝে মাঝেই তিনি কোন একটি প্রতিপাদ্য খুব জোর দিয়ে বলেন, যেন প্রতিপাদ্যটির কোন অন্যথা হতে পারে না, কিন্তু তারপরই একটি তুলনায় নরম বা সংশোধনী কথা বলে অতিকথনের জোরটা ইচ্ছে করেই একটু কমিয়ে দেন। এভাবেই তাঁর কথার গ্রাহ্যতা গড়ে ওঠে” (চক্রবর্তী ২০২১: ১৪)।

৫    ইমাম হোসেন শহিদ হইয়াছিলেন ইংরেজি ৬৮০ সালের ১০ অক্টোবর তারিখে। এডোয়ার্ড গিবন লিখিতেছেন: “একেলা, ক্লান্ত, এবং আহত অবস্থায় তিনি তাঁহার শিবিকার দ্বারপ্রান্তে বসিয়া রহিয়াছেন। যেই একফোঁটা পানি মুখে দিতে যাইবেন, অমনি তাঁহার মুখগহ্বরে একটি তীর আসিয়া বিঁধিল; আর তাঁহার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ থাকিতেই তদীয় পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্র-দুইটি নয়নাভিরাম যুবক—নিহত হইলেন। তিনি আসমানের দিকে হাত উঁচু করিলেন—দুই হাত রক্তে টইটম্বুর—আর জীবিত ও পরলোকগতদের জানাজা আদায় করিলেন। নৈরাশ্যের রথে চড়িয়া তাঁহার ভগিনী শিবিকা হইতে বাহিরে আসিলেন, আর কুফাবাসীদের সেনাপতিকে ভর্ৎসনা করিলেন, তাঁহার চোখের সামনে হোসেনের হত্যাকা- তিনি চাক্ষুষ না করেন। ভদ্রলোকের সম্ভ্রান্ত দাড়ির উপর একফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল; আর মৃত্যুপথযাত্রী নায়ক যখন তাহাদের ছত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন পরম সাহসী সৈনিক পুরুষেরাও পিছনে সরিয়া গেলেন। পরিতাপহীন শামের—বিশ্বাসীদিগের অভিসম্পাৎ যাহার উপর নামিয়া আসে—সৈনিকদের কাপুরুষ বলিয়া গালিগালাজ করিলেন; আর মোহাম্মদের পৌত্রকে আপন হস্তে বর্শা আর তরকারির গোটা তেত্রিশ ঘা মারিয়া জবেহ করিলেন। পতিত শরীর পায়ে দলন করিয়া তাঁহার কর্তিত মস্তক কুফার দূর্গে লইয়া গেলেন তাহারা আর অমানুষ ওবায়দুল্লাহ একটা বেত্রদ- দিয়া তাঁহার মুখে আঘাত করিলেন: জনৈক বয়োজ্যেষ্ঠ মুসলমান চিৎকার করিয়া উঠিলেন: “হায়! হায়! এই ওষ্ঠদ্বয়ের উপর আল্লাহর রসুলকে চুমু খাইতে দেখিয়াছি আমি!” সুদূর ভবিষ্যতে আর দূরদূরান্তের দেশে দেশে হোসেনের এই বিয়োগাবিধুর মৃত্যুদৃশ্য নিষ্ঠুরতম পাঠকের হৃদয়েও করুণার সঞ্চার করিবে” (গিবন ১৯৯৫: ২২৭)।

৬    ‘শহীদে কারবালা’ বা ‘শহীদ-ই-কারবালা’ নামের পুথিগুলি ছাড়াও কারবালার কাহিনী আরো অনেক পুথির উপজীব্য। গোলাম সাক্লায়েন তাহাদের মধ্যে কতকগুলির আলোচনা করিয়াছেন। এখানে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা আছে: জয়নবের চৌতিশা (শেখ ফয়জুল্লাহ্), মক্তুল হুসৈন (মুহম্মদ খান), জারীজঙ্গনা মা (হায়াৎ মামুদ),  শহীদ-ই-কারবালা ও সখিনা বিলাপ (জাফর), সংগ্রাম হুসন (হামীদ), জঙ্গনামা (ইয়াকুব), জঙ্গনামা বা ইমামএনের কেচ্ছা (রাধাচরণ গোপ), গুলজার-ই-শাহাদৎ বা শাহাদৎনামা (মুহম্মদ হামীদুল্লাহ খান), শহীদ-ই-কারবালা (জনাব আলী), শহীদ-ই-কারবালা (মুহম্মদ মুনশী সাদ আলী ও আবদুল ওহাব), দাস্তান শহীদ-ই-কারবালা (মুহম্মদ ইসহাক উদ্দীন), জঙ্গে কারবালা (কাজী আমীনুল হক) ইত্যাদি (দ্রষ্টব্য: সাকলায়েন ১৯৬৪: ২৪৪)।

৭    দিল্লীর নিয়ন্ত্রিত তুর্কী শাসনের বিরুদ্ধে উর্যুপরি বিদ্রোহ ও পরাজয় বাঙালী মুসলমান ও হিন্দু সমাজকে সংহত ও আত্মসচেতন করতে অনেকখানি সাহায্য করেছে—একথা বলায় অন্যায় হয় না। মুসলমানের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এই প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্যবোধ কোন্ পথে আত্মবিকাশ করতে আরম্ভ করেছিল তার কতকটা আভাস পাওয়া যায়—তুর্কী বা ফারসীর পরিবর্তে, শিলালিপি ও মুদ্রায় আরবী ভাষা, প্রকাশভঙ্গী ও সংকেতের একচেটিয়া ব্যবহারে। দিল্লীর মধ্যস্থতাকে অগ্রাহ্য করে সমুদ্রপথে আরব জগতের সঙ্গে ঘনিষ্টতা বৃদ্ধির যে চেষ্টা চলছিল, তারও নজির আছে” (হবিবুল্লাহ ১৯৭৪: ১৪১)।

৮    মমতাজুর রহমান তরফদার অতি সঙ্গত কারণেই লিখিয়াছিলেন: “আরব-ইরান-তুরান কেন্দ্রিক নষ্টালজিয়া থেকেই ভারতীয় ও বাঙালি মুসলমানদের সত্তার দেখা দিয়াছে এক মারাত্মক স্ববিরোধ বা split personality। তারা এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেননি, আবার বর্জনও করতে পারেননি। ১৯৪৭ [সালের] পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এই দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতাকে এক নাস্তিবাচক দর্শনের রূপ দিয়ে আর্থনীতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছে। যেখানে এই আত্মবিরোধ এত প্রবল, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার উন্মেষ না হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ দেখতে পাচ্ছি মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে বাংলা ভাষার জন্য মুসলমান কবির অসাধারণ গর্ববোধ। এতে তো ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবোধের ইঙ্গিত আছে। ইঙ্গিত শুধু ইঙ্গিতই রয়ে গেল; তাকে রূপরেখায় বাস্তবধর্মী করে তোলার জন্য না ছিল নেতৃত্ব, না ছিল আর্থনীতিক প্রক্রিয়া ও সামাজিক পরিবেশ। যখন মধ্যযুগের কোনো কবিকণ্ঠ দ্বিধাহীনভাবে গেয়ে ওঠে:

যার যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন।
সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন ॥

তখন মনে হয়, মধ্যযুগের সীমারেখা ডিঙিয়ে কেউ যেন আধুনিকতার বাণী শুনাচ্ছেন। এ-বাণী ব্যর্থ হয়েছিল” (তরফদার ১৯৯৪: ৩০)।

৯    জিজ্ঞাসা করিতে হয়, বাঙালি মুসলমান বলিতে ঠিক কাহাদের বোঝায়? এই প্রশ্নের উত্তরে আহমদ ছফা একত্র লিখিয়াছিলেন: “যারা বাঙালী এবং একই সঙ্গে মুসলমান তারাই বাঙালী মুসলমান”। এই সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ। কেননা অন্যত্র তিনি স্বীকার করিয়াছেন: “‘বাঙালী মুসলমান’ তাহারাই যাহারা ‘নীচুতলার মুসলমান’” (ছফা ১৯৮১: ২৩)।

১০  মমতাজুর রহমান তরফদার ন্যায়সঙ্গত কারণেই যোগ করিয়াছেন: “চৈতন্যের বৈষ্ণববাদ, উনিশ শতকের রেনাইসাঁস ও চলমান [মানে বিংশ] শতকের খিলাফত আন্দোলন এই স্বাতন্ত্র্যকে ঘোচাতে পারেনি” (তরফরদার ১৯৯৪: ৯)।

দোহাই

১    আনিসুজ্জামান, মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য (ঢাকা: লেখক সংঘ প্রকাশনী, ১৯৬৪)।
২    আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, সমাজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৭৪)।
৩    আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী, ১ম খণ্ড, আনিসুজ্জমান ও বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত (ঢাকা বাংলা একাডেমী ১৪০৮ [২০০১])।
৪    আহমদ ছফা, ‘বাঙালী মুসলমানের মন: লেখকের জবাব,’ সমকাল, ১৮শ বর্ষ, ৫ম সংখ্যা (জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৪), পুনর্মুদ্রণ, আহমদ ছফা বিদ্যালয়, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা (কার্তিক ১৪২১, অক্টোবর-নবেম্বর ২০১৪), পৃ. ১৯-২০।
৫    আহমদ ছফা, ‘উত্তর ভূমিকা: বাঙালী মুসলমানের মন,’ আহমদ ছফা রচনাবলি, ১ম খণ্ড, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮ [ক]), পৃ. ৮১-৮৮।
৬    আহমদ ছফা, ‘প্রসঙ্গ: বাঙালী মুসলমান’, আহমদ ছফা রচনাবলি, ৩য় খণ্ড, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮খ), পৃ. ২৪৮-২৫০।
৭    আহমদ ছফা, বাঙালী মুসলমানের মন (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮১)।
৮    এবনে গোলাম সামাদ, “বাঙালী মুসলমানের মন”, সমকাল, ১৮শ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা (চৈত্র ১৩৮৩), পুনর্মুদ্রণ, আহমদ ছফা বিদ্যালয়, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা (কার্ত্তিক ১৪২১, অক্টোবর-নবেম্বর ২০১৪), পৃ. ১৬১৮।
৯    কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী আবদুল ওদুদ-রচনাবলী, ১ম খণ্ড, আবদুল হক সম্পাদিত (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৩৯৫ [১৯৮৮])।
১০    গোলাম সাকলায়েন, বাংলায় মর্সীয়া সাহিত্য: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ (মধ্যযুগ হইতে আধুনিক যুগ পর্যন্ত) (রাজশাহী: বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৪)।
১১    গৌতম নিয়োগী, ‘বাঙালি সমাজ ও সাহিত্য সমীক্ষা,’ চতুরঙ্গ, মার্চ ১৯৯০, পৃ. ৯৭২-৭৪।
১২    গৌতম ভদ্র, ইমান ও নিশান: বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায় (কলকাতা: সুবর্ণরেখা, ১৯৯৪)।
১৩    থিবো দুবের, ‘দেশি বচনের বিস্মৃত পাঠ: আরবি হরফে বাংলা হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি,’ অনুবাদ: নূরুননবী শান্ত ও থিবো দুবের, ভাবনগর, ১২শ খণ্ড, ১৩-১৪শ সংখ্যা, (জুন-ডিসেম্বর ২০২০), পৃ. ১৪৪৮-১৪৬২।
১৪    দীপেশ চক্রবর্তী, ‘আনিসুজ্জামান-মানস ও মুসলিম বাংলা সাহিত্য: উপক্রমণিকা’, রাষ্ট্রচিন্তা: একটি রাষ্ট্রনৈতিক জার্নাল, ৫ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, (জানুয়ারি ২০২১ [মাঘ ১৪২৭]), পৃ. ১১-২৬।
১৫    বদরুদ্দিন উমর, আমর জীবন, ৩য় ও ৪র্থ খণ্ড (১৯৬৮-১৯৭১ এবং ১৯৭১-২০১৩), পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা: বাঙ্গালা গবেষণা, ২০২১)।
১৬    ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘স্বর্ণকুমারী দেবী/ মীর মশাররফ হোসেন’, সাহিত্য-সাধক চরিতমালা, ২৮ ও ২৯ নম্বর, ২য় খণ্ড, ৭ম মুদ্রণ (কলিকাতা: বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩৯৯)।
১৭    মমতাজুর রহমান তরফদার, বাংলাদেশের সংস্কৃতির স্বরূপ ও সম্ভাবনা (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪)।
১৮    মীর মশাররফ হোসেন, মশাররফ রচনা-সম্ভার, ২য় খণ্ড, কাজী আবদুল মান্নান সম্পাদিত (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৩৮৬ [১৯৮০]।
১৯    মুনীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী-রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত (ঢাকা: বাংলা একাডেমী ১৩৯১ [১৯৮৪])।
২০    মুহম্মদ আবুদল হাই, ‘বাংলা গদ্যের পরিণতি: বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মোশাররফ হোসেন, আর্জমন্দ আলী, গোলাম কীবরিয়া এবং মোজাম্মেল হক প্রভৃতি,’ মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহ্সান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ), ২য় সংস্করণ (ঢাকা: স্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৩৭১ [১৯৬৪]), পৃ. ৬৫-১৩০।
২১    মোহাম্মদ আজম, ‘আহমদ ছফার ‘বাঙালী মুসলমানের মন’: বাঙালি-মুসলমানের ইতিহাস-প্রণয়ণের সংকট’, তত্ত্বতালাশ: চিন্তামূলক প্রবন্ধের কাগজ, ২য় সংখ্যা (অক্টোবর ২০২১), পৃ. ১৮০-২০৮।
22    Rafiuddin Ahmed, The Bengal Muslims, 1871-1906: A Quest for Identity (Delhi: Oxford University Press, 1981).
23    Suniti Kumar Chatterji, ‘Sanskrit in Perso-Arabic Script: A Side-Light on the Medieval Pronunciation of Sanskrit in Kashmir and Northern India,’ Indian Linguistics: Journal of the Linguistic Society of India, 5-8 (1934-35); [as cited in d’Hubert 2020].
24    Shoshana Felman, Jacques Lacan and the Adventure of Insight: Psychoanalysis in Contemporary Culture (Cambridge, Mass.: Harvard University Press, 1987).
25    Sigmund Freud, Interpreting Dreams, trans. J. A. Underwood (London: Penguin Books, 2006 M).
26   Sigmund Freud, ‘From the History of an Infantile Neurosis [The ‘Wolfman’],’ trans. Louise Adey Huish, The Penguin Freud Reader, ed. Adam Phillips (London: Penguin Book, 2006 K) pp. 196-309.
27    Sigmund Freud, ‘Beyond the Pleasure Principle,’ trans. John Reddick, in The Penguin Freud Reader, ed. Adam Phillips (London: Penguin Books, 2006 L), pp. 132-195.
28    Edward Gibbon, The History of the Decline and Fall of the Roman Empire, vol. III, ed. David Womersley (London: Penguin Books, 1995).
29    Irfan Habib, The Agrarian System of Mughal India 1556-1605, 2nd ed. (Delhi: Oxford University Press, 1999).
30    Thibaut d’Hubert, ‘Dobhāshī,’ in Encyclopaedia of Islam, eds. Gudrun Krämer et al. (Leiden: Brill, 2014), pp. 77-78.
31    Jacques Lacan, ‘Seminar on “The Purloined Letter”,’ in Écrits, trans. Bruce Fink (New York: W. W. Norton, 2006), pp. 6-48.
32    Shireen Moosvi, Interpreting the History of Bengal under the Mughals,’ in In Quest of the Historian’s Craft: Essays in Honour of Profesor B.B. Chaudhuri, Part I: The Economy, eds. Arun Bandopadhyay and Sanjukta Das Gupta (New Delhi: Manohar, 2018), pp. 195-213.
33    Tapan Raychaudhuri, Bengal under Akbar and Jahangir: An Introductory Study in Social History, 2nd ed. (Delhi: Munshiram Monoharlal, 1969).
34    Max Weber, The Religion of India: The Sociology of Hinduism and Buddhism, trans. and ed. Hans H. Gerth and Don Martindale (Glencoe, IL: Free Press, 1958).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *