১৯৩২ সালে জাক লাঁকা, বামে বসে থাকা জন
১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত মেরিল্যান্ড রাজ্যের অন্তঃপাতী বল্টিমোর শহরে ফরাসি-মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের এক বিশেষ সভা বসিয়াছিল। আমাদের এই আলোচনার বিষয়ের সহিত ঐ সভার আলোচ্য বিষয়ের বিশেষ মিল আছে। ফরাসিদেশের বুদ্ধিজীবী মহলে ততদিনে তত্ত্বজ্ঞানের প্রস্থানস্বরূপ ‘গঠনতন্ত্র’ [structuralism] নামক নতুন প্রস্তাব লইয়া আলোচনা জমিয়া উঠিয়াছে। আর মার্কিনদেশেও ইহার প্রভাব ছড়াইয়া গিয়াছে। তাই ১৯৬৬ সালের এই বল্টিমোর সভার বিষয় ঠিক হইয়াছিল ‘গঠনতন্ত্র’।
ঐ সভায় যাঁহারা হাজির হইয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন রলাঁ বার্থ [Roland Barthes], জাক লাকাঁ [Jacques Lacan], জাক দেরিদা [Jacques Derrida], লুসিয়ঁ গোল্ডমান [Lucien Goldmann], জঁ-পল ভেরনা [Jean-Paul Vernant] এবং ত্রিস্তান তোদোরব [Tristan Todorov] প্রমুখ নামজাদা বিদ্বান ও বুদ্ধিজীবী। অন্য এক নামজাদা বুদ্ধিজীবী জঁ ইপ্পোলিত [Jean Hyppolite] ফরাসি তরফে এই সভা আঞ্জাম করিয়াছিলেন। বলা হয়তো নিষ্প্রয়োজন নয় এই জঁ ইপ্পোলিত জার্মান হেগেলের ফরাসি অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করিয়া বিশেষ নাম কুড়াইয়াছিলেন। তিনি চাহিলে জাক লাকাঁর বিশেষ বন্ধু ও জাক দেরিদার প্রধান শিক্ষক হিসাবেও পরিচিত হইতে পারিতেন। দুর্ভাগ্যবশত মহাত্মা ইপ্পোলিত ১৯৬৮ সালে–নিতান্ত অপরিণত বয়সে–এন্তেকাল করিয়া সকলকে শোকসাগরে ভাসাইলেন।
কারণ যাহাই হউক অনেক দেরি করিয়া ১৯৬৬ সালের ঐ সম্মেলনের কার্যবিবরণী প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সাল নাগাদ। ইহার দুই বছর পর তাহার পুণর্মুদ্রণও হয়। পুনর্মুদ্রণের অজুহাতে বইয়ের নামেরও কিছু পরিবর্তন ঘটান হয়। ১৯৭০ সালের সংস্কার অনুসারে বইয়ের আসল নাম রাখা হইয়াছিল ‘বিচারশাস্ত্রের ভাষা ও মনুষ্যের জ্ঞানবিজ্ঞান : গঠনতন্ত্র বিসম্বাদ’। ১৯৭২ সালের সংস্কার অনুসারে উহার নাম পাল্টাইয়া রাখা হইল ‘গঠনতন্ত্র বিসম্বাদ: বিচারশাস্ত্রের ভাষা ও মনুষ্যের জ্ঞানবিজ্ঞান’। ইহার মানে বড় নাম ছোট হইল, ছোট নাম বড় হইল। পাঠিকারা ইহাতেই বুঝিবেন জ্ঞানের জগতে ‘গঠন’ [structure] নামে নতুন কোন ঘটনা ঘটিয়াছে। ইহাতে প্রমাণ এয়ুরোপের মনে মনে ‘গঠনতন্ত্র’ বড় আকারের ফটিক হইয়া উঠিয়াছে। ১৯৬৬ সালে ঠিক ইহাই অনুমান করিয়াছিলেন মহাত্মা জাক লাকাঁ। তাঁহার বল্টিমোর বক্তৃতায় সেই কথার প্রমাণ আছে। লাকাঁ বলিয়াছেন–‘[গঠন] ধারণাটি কী তাহা লইয়া লোকে কিছু কিছু ভুল করিবেই, তালগোল পাকাইবে, অনুমানের পর অনুমাননির্ভর ব্যবহার করিতে থাকিবে আর আমার মনে হয় বেশিদিন না যাইতেই শব্দটি লইয়া একপ্রকার হুজুগের চল হইবে।’
এই বক্তৃতার তাৎপর্য পুরাপুরি বুঝিতে না পারিয়া স্বল্পশিক্ষিত সাংবাদিকরা মনে করিয়াছিলেন জাক লাকাঁ বড় কঠিন লোক। তাঁহার কথা বুঝিবার সাধ্য সাধারণের নাই। তাঁহারা আরো বলিয়াছিলেন, লাকাঁ সাহেব যেহেতু ইংরেজি ভাষাটি সঠিক আয়ত্ত করিয়া সারেন নাই, তাই তাঁহার বক্তৃতা দশজনের পক্ষে ভালোমতে হজম করাও সম্ভব হয় নাই। আমরা সেই বক্তৃতার অনুবাদ এখানে পেশ করিতেছি। আমাদের তর্জমার ত্রুটিসহ পাঠকগণ দেখিবেন এই বক্তৃতার বিরুদ্ধে যাহা রটিয়াছে তাহা পুরাপুরি সঠিক নয়। ইহা হয়তো বোঝা যায়। নহিলে বাংলায় অনুবাদ করিবার কথাই উঠিত না।
কেহ কেহ বলিয়াছিলেন বল্টিমোর সম্মিলনে মিলনকথা যাহা উঠিয়াছিল তাহা ভাষা ও মানুষের সম্বন্ধটা কী সেই জিজ্ঞাসা লইয়া। একদল জিজ্ঞাসিয়াছিল–মানুষ ভাষা তৈয়ার করিয়াছে নাকি ভাষাই মানুষ তৈরি করিয়াছে? কেহ কেহ দাবি করিয়াছিলেন ফরাসিদেশ হইতে প্রচারিত ‘গঠনতন্ত্র’ নামক প্রচারণা প্রমাণ করিয়াছে যে ‘মানুষ’ বলিয়া সামান্য কিছু নাই। তাই ‘সহজ মানুষ’ বলিয়া বিশেষ কিছু থাকিবে কি করিয়া? বিজ্ঞানের ইতিহাস ব্যবসায়ী মিশেল ফুকো সাহেবের নামে এই প্রচারণা কিছুদিন গাঢ় চলিয়াছিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করিতে হইতেছে উপরোক্ত ১৯৬৬ সম্মিলনে মিশেল ফুকো হাজির হয়েন নাই। তবে তর্কের খাতিরে স্বীকার করিতে দোষ নাই ঐ বছর ছাপা তদীয় ‘ভাষা ও বস্তু’ (লে মো এ লে শোজ) বইয়ে তিনিও ঐ রকমের ইশারাই করিয়াছিলেন ।
অথচ তিন বছরের মাথায় ছাপা ‘জ্ঞানগরিমার আদিকথা’ নামক পুস্তকে ফুকো ঘোষণা করিলেন ‘গঠনতন্ত্র’ তথা ‘মনুষ্য বলিয়া কিছু নাই’ কথাটি তাঁহার নহে। এহেন দাবি অলীক ও অসার। তিনি ১৯৬৬ সালের বইয়ে বলিয়াছিলেন ‘মানুষ’ অর্বাচীন এবং তাহার অন্তর্ধান অত্যাসন্ন। অথচ তিনি ১৯৬৯ সনের কেতাবে তিনিই ঘোষণা করিলেন–আমি কিন্তু কোথাও ‘গঠন’ কথাটি ব্যবহার করি নাই। (ফুকো ১৯৭২: ২০০-২০১) সুতরাং ‘গঠনতন্ত্র বিসম্বাদ’ [the structuralist controversy] কথাটি অলীক বুলি মাত্র। তবে শেষমেশ এই ফুকো কবুল করিলেন তিনি নিজেও মনুষ্য সাধকের সাধনার মূল্য খানিক কমাইয়া দেখিয়াছিলেন আর কিছু বাড়াইয়া দেখিয়াছিলেন এই গঠনে সেই গঠনে পাওয়া যুগপৎ মিলের মূল্য ।
কী ঘটিয়াছিল এই সময়? বিশেষ করিয়া বলিতে নৃবিজ্ঞানসাধক হজরত ক্লদ লেভি-স্ত্রোস [Claude Lévi-Strauss] যখন দেখাইয়াছিলেন ফ্রয়েডের আবিষ্কৃত অজ্ঞানের গঠন আর মনুষ্যজাতির মধ্যকার পরিবার ও আত্মীয়তা-সম্পর্কের গঠন একই প্রকার গঠনেরই রকমফের মাত্র, প্রকৃত প্রস্তাবে গঠনতন্ত্র প্রস্তাব পেশ করা হইয়াছিল তখনই । ইহাতে জাক লাকাঁ আরও আহুতি দিলেন–বলিলেন অজ্ঞানের গঠন পরিষ্কার ভাষার মতন । গঠনতন্ত্র সত্য সত্যই গড়িয়া উঠিল।
ইহার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাইলেন যাঁহারা তাঁহারা আগের শতকের দর্শনতত্ত্বজ্ঞানী নিৎসের [Friedrich Nietzsche] দোহাই পাড়িলেন। ফুকো একা নহেন, কিছু পরিমাণে জাক দেরিদা আর বহুল পরিমাণে জিল দল্যুজ [Gilles Deleuze] তাঁহার সঙ্গী হইলেন । ইঁহাদের মধ্যে কিছু প্রভেদ থাকিলেও মূল প্রশ্নে সকলেই একমত হইলেন। তাঁহারা ধরিয়া লইলেন ‘গঠনতন্ত্র’ মানে সহজ মানুষের অন্তর্ধান। তাই ফুকো ও দল্যুজ নিৎসের আশ্রয় লইলেন আর দেরিদা উটপাখির মত ভাষার বালিতে আমুণ্ডুপদনখর ডুবিলেন।
‘গঠনতন্ত্র’ কথাটি শুরু হইতেই এই ভুল বোঝাবুঝির উপর দাঁড়াইয়া আছে। অনেকেই মনে করিয়াছিলেন ‘গঠন’ (structure) থাকিলে ‘সহজ মানুষ’ (subject) থাকিতে পারে না। অথচ জাক লাকাঁ একেবারে বিসমিল্লাহ হইতেই বলিয়া আসিতেছিলেন এই ধারণাটি আদপেই সঠিক নহে। পক্ষান্তরে তিনি দাবি করিলেন, গঠন ও সহজ মানুষের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। গঠনের পরই শুদ্ধ সহজ মানুষের আবির্ভাব ঘটে, পূর্বে বা বিহনে নহে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছিল: ‘সহজ মানুষ’ (subject) কী বস্তু? জাক লাঁকা বলিলেন–‘সহজ মানুষ’ কথাটার অর্থই হইতেছে ‘যাহা সহজ নহে’। কোন জিনিস ভাষার মধ্যে ধরিয়া রাখা সহজ নহে বলিয়া আমরা কি বলিতে পারি জিনিসটুকু নাই? সেই সময় শার্ল মোরাজে (Charles Morazé) নামক জনৈক ইতিহাস বিশারদ আওয়াজ তুলিয়াছিলেন ‘ঋণাত্মক একের বর্গমূল’ (the root of minus one) কথাটির অর্থ কী? গণিতশাস্ত্রে এই চিহ্নটিকে ‘অযৌক্তিক’ [irrational] সংখ্যা বলা হইয়া থাকে। অথচ ইহা তো খোদ গণিতেই কাজ করে। জাক লাকাঁ ইহার বরাত দিয়া বলিলেন প্রাণীস্বরূপ মানুষ বা ‘জীব’ ও ‘সহজ’ মানুষের মধ্যকার পার্থক্যও অনুরূপ বটে। ‘সহজ মানুষ’ কথাটা যদি অযৌক্তিক মনে হয় তবে তাহা ভাষারই দোষ। কিন্তু তাই বলিয়া ইহা কাজ করে না বা ইহা নাই বলা যাইবে না।
জাক দেরিদা এক জায়গায় জাক লাকাঁর কাছে জানিতে চাহিলেন ইহাকে ‘সহজ মানুষ’ বা ‘অজ্ঞান’ বলিবার কারণ কী? ইহার উত্তরে লাকাঁ সভাস্থলে উপস্থিত বিদ্বানমণ্ডলীর কাছে একটি গল্প বলিয়াছিলেন।
একদিন হোটেলে একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল। জাক লাকাঁর ঘরে একটি টেবিল এক জায়গা হইতে আরেক জায়গায় সরাইবার দরকার হইল। তিনি যাহাকে বলে বেলম্যান বা পিয়ন তাহাকে টেবিলটি সরাইতে বলিলেন। পিয়ন সাহেব
তাহাতে ক্ষেপিয়া গেলেন। বলিলেন, ‘মহাশয়, ইহা আমার কর্তব্য নহে। আপনি দরকার মনে করিলে কথাটা বলিবেন গৃহ-পরিচারক বা হাউস-কিপারকে। গৃহ-পরিচারকগণ আসিয়া কাজটা করিয়া গেলেন বটে, কিন্তু তাহারা মহাত্মা লাকাঁর কোন কথাই শুনিলেন না। তাঁহারা শুদ্ধ স্ব স্ব উপরিওয়ালার আদেশ অনুসারে কাজ সারিয়া চলিয়া গেলেন। ইহা হইতেই–লাকাঁ বলিলেন–তিনি ঠাহর করিলেন কাজ যাহা হইয়াছে তাহা (সহজ মানুষস্বরূপ) তাহার ইচ্ছায় হইয়াছে মনে করিলে তিনি ভুল করিবেন। কাজ হইয়াছে হোটেলের নিয়ম অনুসারে, খরিদ্দারস্বরূপ জাক লাকাঁর ইচ্ছায় নহে। মাঝখানকার খরিদ্দারবেশী জাক লাকাঁ নামক অস্থিরতাটুকুরই অপর নাম ‘সহজ মানুষ’। টেবিলটা বড় বেঢপ জায়গায় ছিল। এখন বেশ ঢপ জায়গায় চলিয়া আসিয়াছে। মাঝখানে সৃষ্ট শূন্যতাই এক্ষণে প্রমাণ করিতেছে ঐখানে কি একটা যেন ছিল। অধৈর্যপরায়ণতার বাহক এই স্থানটির নামই ‘সহজ মানুষ’। (রাবাতে ২০০২: ৪০ )
জাক লাকাঁর এই বক্তৃতার নাম দেখিয়াও অনেকেই ইহা পড়িতে চাহিবেন না মনে হয়। সে কি নাম রে বাবা! ‘অন্তর্জগতে যাহা না মিশিলে কোন সহজই জন্মায় না সেই পরকীয়া বা গঠনের কথা’ [‘Of Structure as an Inmixing of an Otherness Prerequisite to Any Subject Whatever’]। মহাত্মা লাকাঁ সেইদিনের বক্তৃতায়ই জানাইয়াছিলেন সমস্যাটি লইয়া তাহার কাজের বয়স ততদিনে ১৫ বৎসর হইবে। কাজেই তাঁহার সমস্ত কথা একদিনে বলা সম্ভব হইবে না।
সেদিনের বক্তৃতার আরও একটি কথা মনে রাখিবার মত যুৎসই হইয়াছিল। বক্তৃতার শেষভাগে এক জায়গায় তিনি বলিলেন: ‘অজ্ঞান কী বস্তু সংক্ষেপে তাহার সবচেয়ে সুন্দর ছবি এই সুবেহ সাদেকের বল্টিমোর শহর।’ কিছু একটা আছে বোঝা যাইতেছে কিন্তু সঠিক কী যে আছে বুঝিতেছি না । তাহা বুঝিতে হইলে খানিক কল্পনার শরণ লইতে হইবে।
মনে রাখিতে হইবে সেই ১৯৫৩ সন হইতেই লাকাঁ বলিয়া আসিতেছিলেন ‘অজ্ঞানের গঠন ভাষার মতন’। ১৯৬৬ সনে–এই বক্তৃতাতেই–তিনি জাহির করিলেন ঐ কথাটি কিছু পরিমাণ বাহুল্যদুষ্ট ছিল। এক্ষণে তাঁহার সহজ মত দাঁড়াইল: ‘অজ্ঞানের গঠন আছে বলিলেই চলিত কারণ গঠন মানেই তো ভাষা’।
লাকাঁর কথা যৎসামান্য উদ্ধার করিতেছি:
সত্য বলিতে ‘ভাষা আকারে’ কথাটি বাহুল্য বটে, কারণ ‘গঠিত’ বলিতে যাহা বুঝায় ‘ভাষা আকারে’ বলিতেও হুবহু তাহাই বুঝায়। গঠিত বলিতে বুঝায় আমাদের জবান, আমাদের অভিধান ইতি আদি। গঠিত অর্থ যাহা, ভাষা অর্থও অবিকল তাহাই।
মনে রাখিবার মতন মচমচে কথা এই বক্তৃতায় আরো এক প্রস্ত পাওয়া যাইতেছে। ‘চিহ্ন’ (sign) ও ‘পদ’ (signifier)-এর মধ্যে ভেদ আছে–এই প্রস্তাব প্রচারের লক্ষ্যে লাকাঁ জানাইলেন চিহ্ন মানে যাহা দিয়া সজ্ঞান এক প্রাণীর খবর অন্য প্রাণীকে দেওয়া চলে। কিন্তু ‘যাহা সহজ মানুষের হইয়া সহজ মানুষের সঙ্গে যায় না, যায় অন্য এক পদের সঙ্গে তাহাকেই পদ কহে’।
আরো এক জবর খবর–এইস্থলে তিনি বলিয়াছিলেন–আছে। ভাষার বা পদের জগতে যাহা আছে তাহাকে ‘বাসনা’ (desire) বলা হয়। বাসনার এক মানে যাহা বাস করে না–যাহা অস্থির, যাহা অধৈর্য। কিন্তু বাসনার তলে তলে আরো এক জিনিস বাস করে। তাহার নাম মজা (jouissance)। বাসা আর মজা মারা ঠিক এক জিনিস নহে। ভাষা মানে বাসনার বিধি–আইন ও ঈশ্বর যে অর্থেই ইচ্ছা–ধরিয়া লইতে পারেন। ভাষাই বিধি। ভাষাই নিষেধ। নিষেধ বা সীমা আছে বলিয়াই প্রাণী (এখানে মানুষ) সেই নিষেধের বেড়া ভাঙ্গিয়া–বা আইল ডেঙ্গাইয়া–ঘাস খাইতে চায়। নিষেধ বা আইল না থাকিলে তো আইলডেঙ্গার দরকারই হইত না–মজাও হইত না। কাজেই বল্টিমোর শহরের বিজ্ঞাপনচিত্রে লেখা ‘এনজয় কোকা-কোলা’ বা ‘কোকা-কোলার মজা মার’ দেখিয়া লাকাঁ বলিলেন সকলেই সকলকে বলিতেছে ‘মজা মার’।
এই মজা মারিতে মারিতে বেশি মারিলে একসময় ব্যথা করিতে শুরু করে। অথচ এই ব্যথার সীমায় পৌঁছাইতে না পারিলে মজা যে সে মারিতেছে তাহার প্রমাণই হয় না। লোকে বলে মজাই জীবন, মজা না মারিলে এ জীবন লইয়া সে কী করিত? মজা জীবনের চাহিতেও বড়। জীবন তুচ্ছ। যে কেহই ত্যাগ করিতে পারেন। সকলেই যাহা সহজে পারেন না ভারতীয় শাস্ত্রে তাহারই অপর নাম ‘ভক্তি’।
পাঠিকা, খেয়াল করিয়াছেন ‘ভক্তি’ কথাটার তাৎপর্য? ‘ভক্তি’ কথাটার আগে ‘বি’ উপসর্গ লাগাইলে কী হয়? ‘বিভক্তি’। বিভক্তি আসিয়াছেন ‘বিভাগ’ করিবার ক্রিয়া হইতে। তাহা নহে তো কী? তাহা হইলে ‘ভক্তি’ আসিয়াছেন ‘ভাগ হইতে’। প্রাণীমানুষ বা ‘জীব’ ভাগ হইলেই ‘সহজ মানুষ’ তৈয়ার হয়েন। এই ভাগকর্মটি করেন যে হাজাম বা নাপিত তাহারই অপর নাম ভাষা। ভাষাই ভাগ করেন। কাজেই ভাগ হইতে যাহার উৎপত্তি তিনিই বিভক্ত বা নিছক ‘ভক্ত’, তাহার পরায়ণতার নামই ভক্তি। খোদ ভক্তি ও মজার মধ্যে তাহা হইলে একটা না একটা যোগ আছে।
মজা মারিতে মারিতে বেশি মারিলে ভাগ বা ভক্তি আর থাকিবেন না। তখন মজার রাশ টানিয়া ধরিতে হইবেক। ভাষা ও মজার, পরকীয়া ও আপনকার এই যুগলবন্দিকেই আমরা এতদিনে ‘গঠন’ বলিয়া চিনিতে পারিলাম। আর জাক লাকাঁর কর্জ নগদ নগদ স্বীকার করিলাম। লাকাঁ কথিত সমাচার এইখানেই মূর্তি পাইল: আপনকার হৃদয় বা অন্তরের সহিত বাহির বা পরকে মিশাইলেই শুদ্ধ সেই ‘সহজ মানুষ’ দেখা দিবেন–অন্য হেতু অন্য কোথা, অন্য কোনখানে দিবেন না। কারণ তাহা যে দিবার নহে।
দোহাই
১. Michel Foucault, The Archeology of Knowledge [L’archéologie de savoir, Paris: Gallimard, 1969], trans. A. M. Sheridan Smith (New York: Pantheon, 1972); ইংরেজি এই সংস্করণে ১৯৭০ সালে কলেজ দো ফ্রঁসে ফুকোপ্রদত্ত বক্তৃতা L’ordre du discourse (Paris : Gallimard, 1971) এর অনুবাদ ‘The Discourse on Language’ অন্তর্ভূক্ত হইয়াছে।
২. Michel Foucault, The Order of Things [Les mots et les choses: une archéologie des sciences humaines, Paris: Gallimard, 1966], A. Sheridan, tr. (New York: Random House, 1970).
৩. Jacques Lacan, ‘Of Structure as an Inmixing of an Otherness Prerequisite to Any Subject Whatever’, in Richard Macksey and Eugerio Donato, eds., 1970, infra, pp.186-200.
৪. Richard Macksey and Eugenio Donato, eds., The Structuralist Controversy: The Languages of Criticism and the Sciences of Man (Baltimore: The Johns Hopkins University Press, 1972).
৫. Richard Macksey and Eugenio Donato, eds., The Languages of Criticism and the Sciences of Man: The Structuralist Controversy, (Baltimore: The Johns Hopkins University Press, 1970).
৬. Jean-Michel Rabaté, The Future of Theory (Oxford: Blackwell, 2002).
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০০৮, arts.bdnews24.com
সলিমুল্লাহ খানের তর্জমায় জাক লাঁকার সংশ্লিষ্ট লেখার লিংক
মাননীয় সলিমুু্ল্লা খানের বক্তব্য ইউটিউবে শুনেছি। রসিকতা ,বিষয় থেকে বিষয়ান্তর এবং প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে বিচরণ তাঁর বৈশিষ্ট্য। শ্রোতা হিসেবে আমার আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু,এক জটিল সাধু ভাষার গদ্যরীতি পাঠক হিসেবে হোঁচট খেতে খেতে পাঠের ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন। সহজ ভাষায়, ভালো লাগে না।