প্রবন্ধ

আদম বোমা (১); পশ্চিমা সাম্রাজ্যের বর্ণপরিচয়

Spread the love

অস্মদ্দেশে সাধারণ্যে – উদাহরণ দিয়া বলিতেছি – এডোয়ার্ড সায়িদ যতখানি সুপরিচয় লাভ করিয়াছেন তালাল আসাদ মনে হয় ততখানি প্রচারধন্য নহেন। তিনি যে একেবারে ডুমুরের কুসুম তাহাও নহে। আমাদের এই বিদ্ধাবুদ্ধিধনদৌলতবিবর্জিত ব্যাপক দেশে যাঁহারা দুনিয়াদারির খবরসবর অল্পস্বল্প হইলেও রাখেন তাঁহাদের সাক্ষাৎ তালাল আসাদ আদৌ আনকোরা নাম নহেন। তিনি জন্মসূত্রে খানিকটা আরব। আর লেখাপড়া করিয়াছেন ইংলন্ডে।
talal-asad-2.jpg
তালাল আসাদ

অনেক অনেক দিন আগের কথা। ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে তরুণ তালাল আসাদ সদলবলে ‘নরবিজ্ঞান ও পররাজ্যাভিযান’ নামধেয় এক চমৎকার বহি প্রকাশ করিয়া ইংরাজভূমি আর ইংরাজি প্রভাবাধীন জগতে ব্যাপক নাম কুড়াইয়াছিলেন। (আসাদ ১৯৯০) বর্তমান লেখক অন্তত তাঁহার নাম প্রথম মুখস্থ করিয়াছিলেন ঐ বইযোগেই। ১৯৮০ দশকের শেষ নাগাদ তালাল আসাদ মার্কিন মুলুকে হিজরত করেন। অদ্যাবধি সেইদেশেই তাঁহার বসবাস। যতদূর জানি নতুন ইয়র্কের একটি মধ্যমসারির বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এখনো অধ্যাপনাকর্মে নিয়োজিত আছেন। সেইখানেই বর্তমান লেখকের সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় হইয়াছিল।

ইত্যবসরে তালাল আসাদের আরো দুইখানি প্রবন্ধ সংকলন – একটার নাম ‘ধর্মের কুলজি’, অন্যটা ‘দুনিয়াদারির রূপজগৎ’ – বাজারে উঠিয়াছে। (আসাদ ১৯৯৩; আসাদ ২০০৩) এইগুলির কোনটাই গড়পড়তা অধ্যাপকের পুতিগন্ধমাখা চাকরিচৌকি বা জারিজুরি লেখা নহে। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাইবে তালাল আসাদ এমনকি নোম চমস্কি কিম্বা এডোয়ার্ড সায়িদের মতন লিবারেলও নহেন। ‘ধর্মের কুলজি’ গ্রন্থের এক প্রবন্ধে তিনি অতি দক্ষতার সহিত সালমান রুশদির ‘শয়তানি পদাবলি’র পিছনে ব্রিটিশ লিবারেল মহলের সমর্থন যে বহুল পরিমাণে ছদ্মবেশী এসলামবিরোধী জঙ্গিবাদের আর মধ্যযুগীয় ধর্মযোদ্ধা মানসিকতার ফসল ছিল তাহা তুলিয়া ধরিয়াছেন।

গত বছর (মানে ২০০৬ সালে) মার্কিন দেশের কালিফোর্নিয়া রাজ্যের অন্তর্গত আরবিং শহরের এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তালাল আসাদ তিনদিনব্যাপী যে অতিথি বক্তৃতা (ওয়েলেক লাইব্রেরি বক্তৃতা) দিয়াছিলেন তাহা সদ্য এই বছর ছাপা হইয়াছে। এই নিবন্ধে সেই প্রবন্ধ সমালোচনা করিব বলিয়া মনস্থির করিয়াছি।


তালাল আসাদ তাঁহার বক্তৃতামালা শুরু করিয়াছেন ইংরাজি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখের ঘটনা বা দুর্যোগ হইতে। সারা জাহানের মুসলমান জনগণও – বিশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের – কপালে এই ঘটনা আরো বড় দুর্যোগ আকারে হাজির হইয়াছে। কারণ এই দুর্যোগকে একদিকে দেখা হইতেছে সন্ত্রাসবাদের দৃষ্টান্ত হিসাবে। অন্যদিকে ইহার সহিত মুসলমান সমাজ কোন না কোনভাবে – শুদ্ধ ব্যক্তি আকারে নহে, আগাপাশতলা সমাজ হিসাবেই – জড়িত বলিয়া দোষারোপ করা হইতেছে। অনেকেই বলিয়াছেন সন্ত্রাসবাদ জিনিশটা খোদ এসলাম ধর্মের অন্তরেই প্রোথিত রহিয়াছে। অর্থাৎ ইহা এসলামের স্বভাবের মধ্যেই পাওয়া যায়। সুতরাং সন্ত্রাসবাদের হাত হইতে রক্ষা পাইতে হইলে এই অশুদ্ধ এসলাম ধর্মকে শুদ্ধ করিতে হইবে। এই শুদ্ধি অভিযানের দায়িত্ব – পাশ্চাত্য জগতের পক্ষে – লইয়াছে বর্তমান দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা তাহার তাঁবেদার মিত্রশক্তিপুঞ্জ দুনিয়ার যে এলাকাকে তাহারা পয়লা ‘মধ্যপ্রাচ্য’ নাম দিয়াছেন সেই এলাকায় কম করিয়া বলিলেও চারিটি যুদ্ধ শুরু করিয়াছেন – একটি আফগানিস্তানে, একটি এরাকে আর দুইটির মধ্যে ফিলিস্তিনের গাজা জেলায় ও লেবাননে একটি করিয়া। বলা হইয়াছে ঐ সকল দেশের জনসাধারণকে রক্ষা করাই এই সকল যুদ্ধের লক্ষ্য। কিন্তু তালাল আসাদ দেখাইতে চাহেন আসল লক্ষ্য তাহা নহে, ‘অন্য কিছ’ু। এই ‘অন্য কিছ’ু অন্যকিছুই নহে, শুদ্ধ এসলাম ধর্মের শুদ্ধি বা সংস্কারকর্ম। এই লক্ষ্যেরও আবার লক্ষ্য আছে । আর তাহা হইতেছে পাশ্চাত্যের মনোমত প্রজাসমাজ ও প্রজারাষ্ট্র গড়িয়া তোলা। ইহার লক্ষ্য অন্য ধরনের অর্থাৎ অন্য বিশ্বাসের সমাজ ও মানুষকে আইন করিয়া নিষিদ্ধ করা।

এই ধরনের লক্ষ্য অর্জন করিতে এয়ুরোপ ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবের ঘরে কয়েক দফা চুরির আশ্রয় লইতে হইয়াছে। তালাল আসাদ তাহার কয়েকটি এক্ষণে পরিষ্কার দেখাইয়া দিতে পারিয়াছেন।

এয়ুরোপ ও মার্কিন দেশ এই সমস্ত যুদ্ধ শুরু করিয়াছে সন্ত্রাসবাদ দমন করিবার অজুহাতে। যদি তাহা সত্য হইয়া থাকে তবে তাহাদিগকে দেখাইতে হইবে যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যে প্রভেদ আছে। শুদ্ধ প্রভেদ থাকিলেই চলিবে না, দেখাইতে হইবে ইহাদের ঘোষিত যুদ্ধ জিনিশটা ন্যায়সংগত হইলেও বিরোধিপক্ষের সন্ত্রাসবাদ ন্যায়সংগত নহে। ইহার তাৎপর্য সুতরাং এই যে যুদ্ধের অধিকার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও শক্তির আছে। কিন্তু সন্ত্রাসের অধিকার বলিয়া কোন অধিকার কাহারও থাকিতে পারে না।

ইহাতে কিন্তু একটি সমস্যা হাজির হয়। যুদ্ধের অধিকার যাহারা রাখেন তাহাদিগের ঘাড়ে যুদ্ধকে যুদ্ধ হিসাবে পরিচালনা করার দায় পড়ে। তাহাদের যুদ্ধ যেন সন্ত্রাসবাদের সমতুল্য বা তাহার চেয়েও মন্দ বস্তু না হইয়া ওঠে তাহা দেখিতে হইবে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে হইতেছে কি?

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবাদের প্রধান অভিযোগ সন্ত্রাসবাদীরা অকারণে, বিনাদোষে বা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করিয়া থাকে। উদ্দেশ্য নিজেদের রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিল করা। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ বা যুদ্ধবন্দি হত্যা – বর্তমান পাশ্চাত্য জগত সমর্থিত আইনের বিধান অনুসারেও – যুদ্ধাপরাধের অন্তর্ভুক্ত। এহেন অপরাধ সচরাচর সন্ত্রাসবাদীরাই ঘটাইয়া থাকে। তাই তাহারা নিন্দার্হ। কিন্তু তালাল আসাদ দেখাইতেছেন পাশ্চাত্যের যোদ্ধাবাহিনীও তো একই অপরাধ আকছার করিয়া বেড়াইতেছে। তাহা সত্য হইলে পরাশক্তিগণের যুক্তির তলায় মৃত্তিকাটা থাকিতেছে কোথায়? তাহারা নিন্দার পাত্র হইবেন না কেন?

পাশ্চাত্য জগতের পক্ষ হইতেও বলা হয় লেবাননে কি গাজায়, এরাকে কি আফগানিস্তানে নিরপরাধ লোক মারা যাইতেছে কথাটি মিথ্যা নহে। কিন্তু না মারিয়া উপায় নাই। শাদাদিল মানুষের এই অভিযানের লক্ষ্য বৃহত্তর। অসীম স্বাধীনতা আর অপরিসীম ন্যায়। সেই বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জন করিতে হইলে ‘কোল্যাটারেল ড্যামেজ’ বা আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি হিসাবে এইটুকু কসুর তো সহ্য করিতেই হইবে। তাহা হইলে প্রশ্ন উঠিতেছে: যুদ্ধাপরাধের সহিত আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতির প্রভেদটা কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তরে পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞ উকিল ও পণ্ডিতগণ বলিতেছেন – প্রভেদ আছে তবে তাহা উপায়ে নহে, উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ তাঁহারা স্বীকার করিয়া লইতেছেন নির্বিকার হত্যা শুদ্ধ সন্ত্রাসবাদীরাই করে না, ন্যায়সংগত যুদ্ধের কারবারীরাও করেন। সুতরাং নির্বিচার হত্যা করে বলিয়াই সন্ত্রাসবাদীরা খারাপ – ইহা বলা যাইতেছে না। তাহা হইলে নির্বিচার হত্যা খারাপ হইল কেন? খারাপ হইবার কারণটা লুকাইয়া আছে হত্যাকারীদের উদ্দেশ্যের মধ্যেই। পাশ্চাত্য জগত যেহেতু পৃথিবীতে শান্তি ও ন্যায়ের রাজ্য কায়েম করিতে বদ্ধপরিকর – অর্থাৎ যেহেতু তাহাদের উদ্দেশ্য ভাল, তাই তাহারা নির্বিচারে হত্যা করিলেও অন্যায় হইতেছে না। বড় ন্যায় ছোট্ট (ও মাঝারি) ন্যায়কে শুদ্ধ কাছেই টানে না, মাঝে মাঝে দূরেও ঠেলিয়া দেয়।

সন্ত্রাসবাদীরা যেহেতু বড় ন্যায়ের নাগাল পায় নাই, সুতরাং তাহাদের নির্বিচার হত্যা – মায় আত্মহত্যা অবধি – অন্যায়জনক। তালাল আসাদ দেখাইতেছেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই যুক্তি ধোপে টিকিবার যোগ্য নহে। টিকিলে পাশ্চাত্যের যুুক্তি পর্যন্ত বর্ণের কলুষযুক্ত বিবর্ণ হইবার আশংকা থাকিয়া যায়।


পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা সন্ত্রাসবাদের সহিত ন্যায়যুদ্ধের পার্থক্য আরো এক জায়গায় প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন নির্বিচার হত্যা করিয়া সন্ত্রাসবাদী তো বিবেকের কামড় অনুভব করে না। অথচ ন্যায়যোদ্ধা তাহা করে। ন্যায়যোদ্ধা জানেন নিরীহ লোক হত্যা অন্যায়। কিন্তু তাহা না করিয়া উপায় থাকে না বলিয়াই তাহারা নির্বিচারে লোক মারিতে বাধ্য হন। বাধ্য হইলেও এই বাবদ তাঁহারা সত্য সত্য অনুতাপ বোধ করেন। তাঁহারা জানেন যাহা করিতে তাঁহারা বাধ্য হইয়াছেন, তাহা অন্যায়কর্ম। এহেন কর্ম শুদ্ধ অনন্যোপায় অবস্থায় করা যায়।

তালাল আসাদ প্রশ্ন উঠাইয়াছেন – অনন্যোপায় যে হইলাম তাহা নির্ণয় করিবে কে? উপায়ের তো কখনও শেষ নাই। কোন উপায় শেষ উপায় তাহা কে বলিবে? পররাজ্য দখল করিতে গিয়া যদি দেখি পানিতে বিষ মিশাইয়া দিলে সহজেই শত্র“ সংহার করা যাইবে – নইলে পররাজ্যটি দখল করার কোন উপায় থাকিতেছে না – তখন আমি তো অনন্যোপায় হইলাম। অতয়েব মাখ বিষ। পাশ্চাত্য ন্যায়ের যুক্তিতে দেখা যায় ইহাও সিদ্ধ ।

তালাল আসাদ বলিতেছেন যাহাদিগকে সন্ত্রাসবাদী বলা হইতেছে তাহাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগও তো ইহাই। তাঁহারা নিরস্ত্রদের আক্রমণ করেন যেন অস্ত্রধারী কর্তৃপক্ষ চাপে পড়িয়া নতি স্বীকার করে। আর ন্যায়যোদ্ধারাও যদি একই কাজই করেন তো প্রভেদটা থাকিতেছে কই! সন্ত্রাসবাদীরাও বলে অন্য উপায় থাকিলে তাহারা সন্ত্রাস করিতেন না। তাহাদের এই দাবির সমর্থন পাওয়া যায় জাতিসংঘের অন্যতম সংস্থা আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তে। নিরুপায় হইলে বা অনন্যোপায় হইলে প্রত্যেক সার্বভৌম রাষ্ট্রের ‘পরমাণু বোমা’ ব্যবহার করিবার অধিকার আছে। এই কথা ঐ আদালতের সিদ্ধান্তে পাওয়া যায়। তালাল আসাদ তাহা উল্লেখ করিয়া বলিতেছেন: ইহা কি মনুষ্যজাতির আত্মহত্যা অধিকার স্বীকার করিবার সমতুল্য যুক্তি নহে? পরমাণু বোমার আবিষ্কার ও ব্যবহার মনুষ্যজাতির সম্মিলিত আত্মহত্যার পক্ষে যাত্রা বৈ কি!

তালাল বইআর একটি যুক্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক আদালত কিন্তু সন্ত্রাসবাদকে (যাহা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়) দণ্ডনীয় অপরাধ বলিতে রাজি হয় নাই। ভারত, তুরস্ক ও শ্রীলংকা প্রভৃতি বহুজাতিক রাষ্ট্রের দাবি ছিল যে সকল জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সশস্ত্র আন্দোলন বা অন্য ভাষায় সন্ত্রাসকে কৌশল হিসাবে ব্যবহার করিতেছে তাহাদিগকে বলা হউক এই ধরনের সন্ত্রাস দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। এই আবদার এখনও আইনের মর্যাদা পায় নাই। কারণ তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ দাবি করিতেছে তাহারাও যুদ্ধই করিতেছেন। আমরা তো দেখিলামই প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ন্যায়যোদ্ধারাও অনেক সময় একই রকম সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় লইয়া থাকেন। নির্বিচারে বেসামরিক নাগরিক হত্যা করিবার পক্ষে তাহারা যুক্তি দেখান এহেন হত্যা না করিলে আরও মূল্যবান আরও অধিক প্রাণ নষ্ট হইত। তাহা হইলে সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা নির্ণয় করা কঠিন এই কথা মানিতে হয়।


তালাল আসাদের আরও একটি যুক্তি যুৎসই হইয়াছে। তিনি বলিতেছেন সন্ত্রাসবাদের কেচো খুড়িতে গিয়া সভ্যতার সাপ বাহির হইয়া আসিতেছে। ২০০১ সালের অনেক আগে হইতেই আধা ইংরেজ আধা মার্কিন প্রাচ্য বিশারদ বার্নার্ড লুইস প্রমুখ পণ্ডিত ‘সভ্যতার সহিত সভ্যতার সংঘর্ষ’ প্রভৃতি আওয়াজ তুলিয়াছিলেন। স্যার বিদিয়াধর সূরযপ্রসাদ নাইপলের মতো জনপ্রিয় লেখক আর সামুয়েল হান্টিংটন প্রমুখ প্রচারক তাহাই বাজারে ছাড়িয়া জোর লাভবান হইয়াছেন। আসাদ দেখাইতেছেন – ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ মানে ‘সভ্যতার সহিত সভ্যতার সংঘর্ষ’ নহে, ইহা প্রকৃত প্রস্তাবে অসভ্যতার বিরুদ্ধে সভ্যতার যুদ্ধ মাত্র। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক যুদ্ধেও একই যুক্তিই দেখান হইত।

এসলাম ধর্মের অন্তরে সন্ত্রাসবাদ জন্মসূত্রে গৃহিত বলিয়া যাহা প্রচারিত হইয়াছে তাহার অর্থ এই যে এসলাম ধর্ম অন্তর্গত বিষাদেই সভ্যতার পরিপন্থী। সুতরাং নিজেকে আমূল সংস্কার না করিলে সভ্য জগতে তাহার জায়গা নাই। পাশ্চাত্যের এই নগ্ন প্রচারের অতি উৎসাহে আর আতিশয্যে আরো ভয়ানক প্রমাদ আছে। তালাল আসাদ প্রমাণ করিয়াছেন আত্মঘাতী বোমা বা আদমবোমা এসলাম ধর্মের অন্তরে প্রোথিত চিরস্থায়ী সত্য নহে। অর্থাৎ ইহাকে ঈমানের সহিত সমান মর্যাদা দেওয়া যাইবে না। ইহা শুদ্ধ ইতিহাসের বিশেষ পর্যায়ের বা পরাধীন মুসলমান সমাজের পরাধীনতার প্রকাশ মাত্র। অর্থাৎ পরাধীনতা দূর হইলে আদমবোমাও ফরাসি কি মার্কিনদেশে বীমা করিয়া প্রদর্শনীতে পাঠানো সম্ভব হইলেও হইতে পারে।

রবার্ট পেপ নামক জনৈক পশ্চিমা রাষ্ট্রপণ্ডিত গণিয়া দেখিয়াছেন ২০০১ সালের আগের ২২ বছরের মধ্যে – অর্থাৎ ১৯৮০ হইতে ২০০১ সালের ভিতর – তামাম দুনিয়ায় ১৮৮টি মতো সাধারণ আদম ওরফে আত্মঘাতী বোমা ফাটিয়াছে। নানান দেশের রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীঘটিত আত্মঘাতী বোমার হিসাবটা ইহার মধ্যে ধরা হয় নাই। পেপ সাহেব দেখাইতেছেন এই দ্বাবিংশ বৎসর পর্বে গণিত ১৮৮টি আদমবোমার মধ্যে গোটা ৭৫টিই ফাটাইয়াছেন শ্রীলংকার ‘তামিল ব্যাঘ্রকুল’ ওরফে ‘তামিল টাইগার্স’ দল – ইঁহারা জাতে তামিল, তালে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আর ধর্মে হিন্দু বলিয়া প্রকাশ। (আসাদ ২০০৭: ৫৪) ইহাতে প্রমাণ এই বিষয়ে এসলাম ধর্মের কোন একচেটিয়া অধিকার নাই। পশ্চিমা পণ্ডিতগণ এই সত্য হজম করিবেন কী উপায়ে?

তালাল আসাদ প্রমাণ করিয়াছেন, আদমবোমা শুদ্ধ মুসলমানরাই ফাটায় না, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ফাটাইতে পারেন। আর এসলাম ধর্মও এমন কথা বলে নাই যে সকল যুগে সকল দেশে এই জাতীয় বোমা বানাইতে কি ফাটাইতে হইবেই। না বানাইলে বা না ফাটাইলে ধর্মই থাকিবে না এমন কথা সকল মুসলমানের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গও নয়। তবুও আজকাল এই এসলাম বিরোধী প্রচার যুদ্ধ জোরদার হইতেছে। কিন্তু কেন? তাহার কারণ খুঁজিতে হইবে ইতিহাসে।

তালাল আসাদ মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে যে অসম যুদ্ধ চলিতেছে তাহা কলাকৌশলে নবীন হইলেও চরিত্রে হুবহু আগেকার যুগের ঔপনিবেশিক বা পররাজ্যলোভী দখলদারী যুদ্ধেরই নতুন সংস্করণ। যদি তাহাই হয় তবে পশ্চিমের যুদ্ধ ‘সভ্যতার সহিত সভ্যতার যুদ্ধ’ নয় – অসভ্যতার সহিত সভ্যতার যুদ্ধ মাত্র। ইহারই অপর নাম বর্ণবাদ।

তালাল আসাদ রচিত ‘আদমবোমা’ পড়িলে সেই বর্ণপরিচয় গাঢ় হয়। তালাল দেখাইতেছেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বর্ণবাদী বলিয়াই তাহারা পশ্চিমের সাথে যুদ্ধে পরাজিত সকল অপশ্চিমা জাতিকে ‘অসভ্য’ বা জংলি বলিয়া গালি দেয়। তাহারা বলেন অসভ্য জাতির যোদ্ধারা নিঠুর, দয়ামায়া কথাটি উহাদের অভিধানে নাই। তাই তাহাদের প্রতি দয়া দেখাইবার প্রশ্নই ওঠে না। আসাদ বলিয়াছেন পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যাধিপতিরা যেভাবে নানান যুদ্ধাপরাধ যেমন নির্বিচার হত্যা, বন্দি নির্যাতন ও এমনকি অসামরিক গণহত্যাকেও মানবদরদী কর্মের উদাহরণ বলিয়া চালাইয়া দিতেছেন তাহার তুল্য কোন যুক্তি তথাকথিত অসভ্য জাতিগোষ্ঠী কোনদিনও দেখাইতে পারে নাই। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ যে নিঃসন্দেহে সভ্য ইহাতে তাহাই প্রমাণিত হয়।

তাই তালাল আসাদ বলিতেছেন আসল প্রশ্ন অন্য জায়গায়। মানুষ আত্মহত্যার মতো ন্যক্কারজনক কাজ করে কেন? আসল প্রশ্ন ইহা নহে। আত্মহত্যার দৃশ্য দেখিয়া জ্যান্ত মানুষজন কী বলে, কী করে তাহাই আসল কথা।

ফিলিস্তিনের আত্মঘাতী বোমা পশ্চিমে যত আলোড়ন তোলে শ্রীলংকার বোমা তত তোলে না কেন? আপন ও পর এখানে সবল হইয়া আসে। তাহা ছাড়াও কথা আছে। খ্রিস্টধর্মের তত্ত্ব সন্ধান করিয়া আসাদ দেখাইয়াছেন আত্মত্যাগ, রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ডের ধর্মবোধ মধ্যযুগের উত্তরাধিকার হিসাবেই এ যুগের ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছে।

তালাল আসাদ বলিতে চাহেন বর্তমান দুনিয়ার সংঘর্ষ আদপেই সভ্যতার সহিত সভ্যতার সংঘাত নহে। কারণ পরস্পরের প্রভাবমুক্ত বিশুদ্ধ কোন সভ্যতাই নাই। সংঘাত কিছু যদি থাকিয়া থাকে তাহা প্রতিটি সভ্যতার ভিতরেই আছে। মুসলমান সমাজও এই সংঘাতমুক্ত নহে। এই সমাজেও আসাদ বলিতেছেন আধুনিক লিবারেল বনাম অন্ধবিশ্বাসীর সংঘাত আছে। তিনি না বলিলেও আমরা বুঝিতে পারি শাসক ও পীড়িতের সংঘর্ষ হইতে মুসলমান সমাজও নিস্তার পায় নাই।

তবে তালালের জোরটা পড়িয়াছে খোদ আধুনিক সভ্যতার ঝাণ্ডাধারীর উপর। তাঁহার বিচারে আধুনিক সভ্যতাও ‘সভ্যতা ও অসভ্যতার সংঘাত’ হইতে মুক্ত হয় নাই। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার, তাহার গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার গোড়ায় ছিল তথাকথিত অসভ্য জাতির উচ্ছেদ অথবা পরাধীনাবস্থা। এই কথা একদা বলিয়াছিলেন জার্মান মনীষী ম্যাক্স ব্হেবার। তালাল আসাদ তাঁহার সহিত একমত হইয়াছেন।

আজ অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার গোড়ায় হাত পড়িয়াছে। আজ সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘দেশপ্রেমিক আইন’ পাশ হইয়াছে। অনেকেই মনে করেন ইহা সেই দেশের নাগরিক স্বাধীনতায় কিঞ্চিৎ বিয়োগ কিম্বা ভাগ বসাইয়াছে। আসাদও মনে করেন ইহা পশ্চিমের সমাজ যে অসুখে পড়িয়াছে তাহার সামান্য লক্ষণ বৈ নহে। আপন অন্দরের এই সংঘর্ষকে পশ্চিমা সমাজের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়গণ ‘সভ্যতার সহিত সভ্যতার সংঘাত’ নাম দিয়াছেন। আজ তাহাদের সভ্যতা বাণিজ্য ও সমর বিশেষ হইয়াছে। সংকটের নিদান পাইবেন মনে করিয়া অদূরদর্শী নেতারা কাল্পনিক এসলামের বিরুদ্ধে অন্তহীন ক্রুসেড পরিচালনা করিতেছেন।

অতীতের ক্রুসেড যেমন হয় নাই এই ক্রুসেডও তেমন সফল হইবে না। তাহার আগেই সভ্যতার হৃদয় বিদারক কাণ্ড ঘটিবে। কারণ আজ পর্যন্ত যত মানব সমাজ দেখা গিয়াছে তাহাদের সকলের ইতিহাসই শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস।

দোহাই
1. Talal Asad, On Suicide Bombing, New York: Columbia University Prees, 2007.
2. ——, ed. Anthropology and the Colonial Encounter, 5th Printing Atlantic Highlands, NJ.: Humanities Press, 1990 [1973].
3. ——, Genealogies of Religion: Discipline and Reasons of Power in Chistianity and Islam, Baltimore: The Johns Hopkins University Press, 1993.
4. ——, Formations of the Secular: Christianity, Islam, Modernity, Stanford: Stanford University Press, 2003.

 

প্রকাশ
৮ নভেম্বর ২০০৭, বিডি নিউজ

One thought on “আদম বোমা (১); পশ্চিমা সাম্রাজ্যের বর্ণপরিচয়

  1. অনেকবার পড়েছি, বিশ্লেষণ ও দর্শন যেন একাকার। মূল্যবান প্রবন্ধ । জ্ঞান ও চৈতন্যের ভেতর মহৎ বেদনার অনুভব করার শক্তি যাদের আছে তারা এই প্রবন্ধে খোঁজে পাবে মনের খোরাক।আধুনিক পৃথিবীর দুই বিশ্বের যে ফারাক তাকেও ধরতে পারবে। অতি অবশ্যই নিজেরই পড়া থাকতে হবে ইতিহাস-দর্শন। ইতিহাস-দর্শন পড়া না থাকলে, মার্কসীয় চিন্তাকে ধারণ করতে না পারলে ড, সলিমুল্লাহ খানকে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তাই, বলবো সলিমুল্লাহ খানের লেখা পড়ে যদি বুঝতে হয় পাঠক আমাকে/ আপনাকেও কিছুটা শিক্ষিত ও ঐ বোধের জায়গায় পৌঁছতে হবে। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *