ইংরেজি ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ খ্যাতনামা পণ্ডিত এডোয়ার্ড সায়িদ এন্তেকাল করিয়াছেন–এই কথা সকলেই জানেন। কিন্তু সকলেই জানেন কিনা আমি জানি না, তিনি ২০০১ সালে লন্ডনে ‘ফ্রয়েড ও এয়ুরোপের বিজাতি’ নামে একপ্রস্ত বক্তৃতা করিয়াছিলেন। ২০০৩ সাল নাগাদ তাঁহার সেই বক্তৃতা প্রকাশিত হইয়াছিল। এতদিনে পাতলা কাগজের মোড়কে আরও এক সংস্করণ বাহিরে আসিয়াছে। আমার সহৃদয় সুহৃদ আসাদুল (প্রকাশ শিশির) করিম লন্ডন হইতে আমার নিকট উপহারস্বরূপ একখণ্ড বহি পাঠাইয়াছেন। তাহাও এক বছরের কথা। বইপত্রের আলোচনা লিখিয়া আমি আংশিক জীবিকা নির্বাহ করিয়া থাকি। কিন্তু কে ছাপাইবে এই জাতীয় লেখা? বন্ধুবর ব্রাত্য রাইসু আমাকে সেই সুযোগ দিয়াছেন। ধন্যবাদ জানাইয়া তাহাকে বড় করিতে চাহি।
এই বক্তৃতায় এডোয়ার্ড সায়িদ বলিতে চাহিয়াছেন, মহাত্মা ফ্রয়েড এয়াহুদি বংশের সন্তান হইলেও নিজেকে এয়ুরোপকই মনে করিতেন। তবে এয়াহুদি পরিচয়ও তিনি কদাচ অস্বীকার করেন নাই। ১৯৩০ সালের পর এয়ুরোপ মহাদেশে এয়াহুদি বিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়া উঠিবার বহু আগেই এয়ুরোপ হইতে এয়াহুদিদের তাড়াইয়া দিয়া অন্য কোথাও উপনিবিষ্ট করিবার পরামর্শ দানা বাঁধিতেছিল। এয়াহুদি জাতির মধ্যে যাহারা ফিলিস্তিনে নতুন এয়াহুদি রাজ্য সংস্থাপনের কল্পনায় উত্তেজনা পাইয়াছিলেন তাহাদিগকে সচরাচর জায়নিস্ট বা ‘জায়নপথিক’ বলা হইয়া থাকে। শহর জেরুসালেমে এই নামের একটি পাহাড় আছে। জায়ন কথাটি তাহার নাম হইতেই আসিয়াছে।
টিওডর হার্তসল নামক এক বিশিষ্ট সাংবাদিক এই জায়ন বা এয়াহুদি রাজ্য আন্দোলনের নেতা বনিয়া গেলেন। তিনি দাবি উঠাইলেন প্রস্তাবিত অখিল এয়াহুদি রাজ্যটি ফিলিস্তিনেই বসাইতে হইবে। ইহার আগে, বিশেষ ১৯ শতকের শেষভাগে, দক্ষিণ আমেরিকার আর্হেন্তিনা কিম্বা আফ্রিকার কোন নির্দিষ্ট এলাকায় এই রাষ্ট্র গড়ার প্রস্তাবও উঠিয়াছিল।
আমরা জানি ১৯১৪ হইতে ১৯১৮ সালের যুদ্ধ শেষ হইবার আগে ফিলিস্তিন অঞ্চল তুরস্কের ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের তাঁবে ছিল। তখনই এয়ুরোপের এয়াহুদি নেতারা অল্প অল্প জায়গাজমি কিনিয়া ফিলিস্তিনে এয়াহুদি বসতিবিস্তারের সূচনা করেন। আমাদের কালের ইতিহাসবিজ্ঞরা প্রত্যক্ষ করিতেছেন এই নতুন অভিবাসন বা হিজরত প্রক্রিয়ার শুভ সূচনা ঘটে ১৮৭০ সালের পরের কোন এক সময়ে। ১৯১৪-১৮ সালের যুদ্ধ, যাহা সচরাচর প্রথম মহাযুদ্ধ নামে কথিত আছে, ঘটিবার পর তুরস্কের পরাজয়সূত্রে ফিলিস্তিন রাজ্যও ইংরেজ সাম্রাজ্যের অধীনে চলিয়া যায়। যুদ্ধ চলিবার সময়ই এয়ুরোপের এয়াহুদি নেতাগণের নেতা ধনকুবের মহাত্মা রথশিল্ড বরাবর ইংরেজ রাষ্ট্রনেতা বালফুর মহাশয় সেই বিখ্যাত ঘোষণা পাঠাইয়াছিলেন যাহাতে ওয়াদা দেওয়া হইয়াছিল ফিলিস্তিনে এয়াহুদি জাতির জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ সরকার সহায় হইবেন। ১৯৪৮ সালের মধ্যে ঐ ওয়াদামাফিক সেই সহায়তাই করা হইল। ততদিনে ফিলিস্তিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ না হইলে কি হইবে, এয়ুরোপ হইতে অপর্যাপ্ত জনসংখ্যা আমদানিপূর্বক শ্রেষ্ঠ শক্তি বনিল এয়াহুদি জাতি। এসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইল।
আজ প্রায় ষাট বৎসর হইতে চলিল পশ্চিমের বলবান জাতিপুঞ্জের সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা পাইয়া এসরায়েল রাষ্ট্র বিরাজমান রহিয়াছে। এই রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে শুদ্ধ এয়াহুদি জাতির বাসভূমি আকারে। দুনিয়ার যে কোন দেশের এয়াহুদি ব্যক্তিকে সহজেই ইহার নাগরিক করা হইতেছে। অথচ এমন একদিন ছিল (ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের যুগে বা তাহার পর যে ব্রিটিশ যুগ কাটিল তাহাতেও) যখন ফিলিস্তিন দেশটিতে আরব মুসলমান, আরব এয়াহুদি ও আরব খ্রিস্টানগণ একসঙ্গেই বসবাস করিতেন। এখন সেই অবস্থা আর নাই।
মহাত্মা এডোয়ার্ড সায়িদ নিজেও খ্রিস্টান মাতাপিতার সন্তান। তিনি বিশ্বাস করিতেন বিশুদ্ধ এয়াহুদি রাষ্ট্র এসরায়েল সমস্যার কোন সমাধান করে নাই। বরং নতুন সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছে। ‘ফিলিস্তিন সমস্যা’ বলিয়া যাহা পরিচিত তাহা সায়িদের বিচারে আদৌ ‘ফিলিস্তিন সমস্যা’ নয়, আসলে ইহা এসরায়েল সমস্যার অন্য নাম মাত্র। তাহা হইলে ইহার সমাধান কী? সমাধান স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, বহুজাতীয় বা নিদেনপক্ষে (আরব ও এয়াহুদি এই দুই জাতি ধরিয়া বলিলে) একটি দ্বিজাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নিহিত। কিন্তু আজ প্রবল প্রতাপযুক্ত পশ্চিমা সাম্রাজ্যের সমর্থনধন্য জায়নপথিকগণ এই ধর্মের কাহিনি শুনিবেন কোন দুঃখে?
এই বিশ্বাসের সমর্থনে আমাদের হাতের ছোট্ট বহিটির মধ্যবর্তিতায় মনীষী এডোয়ার্ড সায়িদ একপ্রস্ত অতিরিক্ত যুক্তি দেখাইলেন। জীবনের শেষ বছরে মহাত্মা জিকমুন্ট ফ্রয়েড ‘হজরত মুসা ও একেশ্বরবাদ’ নাম দিয়া একটি নাতিবৃহৎ বহি বাহির করিয়াছিলেন। ঐ বহির প্রস্তাব অনুসারে হজরত মুসা এয়াহুদি জাতির বহুকীর্তিত একেশ্বর-বিশ্বাসের প্রবর্তক। এই একেশ্বরবাদ জিনিশটি সেকালের মিশরদেশ হইতে আনিয়া এয়াহুদি জাতির মধ্যে প্রবর্তন করিয়াছিলেন তিনিই। সঠিক বলিতে হইলে বলিতে হয় হজরত মুসা নিজে মোটেও এয়াহুদি ছিলেন না, ছিলেন ফেরায়ুনের দেশ মিশরের লোক। তিনি এয়াহুদি ছিলেন না অথচ এয়াহুদিদের প্রধান কীর্তি ঈশ্বরোপাসনায় এককেন্দ্রিকতার জারি করিয়াছিলেন তিনিই।
মহাত্মা ফ্রয়েড বলিয়াছেন, এই সত্য সত্য হইলে বলিতে হইবে এই দুনিয়ায় জাতিগত শুদ্ধতা বা রক্তের বিশুদ্ধতা বলিয়া কিছুই নাই। এয়াহুদি জাতির উপাস্য যে ঈশ্বর হিব্রূভাষায় যাহার নাম দাঁড়াইয়াছে ‘এয়াহবে’ তিনিও জন্মসূত্রে এয়াহুদি নহেন, আরব। আরব্য ঈশ্বর আর মিশরিয়া নবী এই হইতেছে, ফ্রয়েড দেখাইয়া দিতেছেন, এয়াহুদি জাতির ইতিকথা। ইহার সহিত সায়িদ যোগ করিলেন, এয়াহুদি জাতির একমাত্র আশা এই ইতিহাসেই। ইহা যদি সত্য হয় তো সওয়াল উঠিতেছে : বিশুদ্ধ এয়াহুদি জাতির লোক লইয়া এসরায়েল রাষ্ট্র গড়িবার গোড়ার মাটিটা থাকিতেছে কোথায়?
বর্তমানে কে না জানে ফিলিস্তিনদেশে মুসলমান-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকল জাতির শিশু ও কিশোর, যুবা ও বৃদ্ধ ছোট ছোট কংকর হাতে লড়াই করিতেছে বন্দুক, ট্যাংক ও যুদ্ধংদেহি উড়োজাহাজের সঙ্গে। এসরায়েল বসাইয়াছে পাথরের দেওয়াল। এয়াহুদি জাতি ও আরব জাতির বসতি আলাদা করিতে হইবে, ইহাই এই দেওয়াল রচনার ভিত। ফিলিস্তিনি কংকর এই দেওয়াল ভাঙিয়া মতিচুর বা মিহিদানা বানাইবার প্রস্তাব, কথাটি বলিয়াছেন এডোয়ার্ড সায়িদ নিজে নহেন, বরং খ্রিস্টোফার বোলাম নামক একজন এয়ুরোপক বুদ্ধিজীবী। ইনি এডোয়ার্ড সায়িদের বইয়ের ভূমিকা লিখিয়াছেন।
বইয়ের উপসংহার লিখিয়াছেন লন্ডনের খ্যাতনাম্নী অধ্যাপিকা জ্যাকুলিন রোজ। মহিয়সী রোজ নিজেও এয়াহুদি জাতির সন্ততি। কিন্তু তিনি এসরায়েল রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ (বা আপার্টাইড) নীতি অনুমোদন করেন না। তিনি দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন, ভিয়েনার ‘ফ্রয়েড প্রতিষ্ঠান ও জাদুঘর’ কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত সায়িদের বক্তৃতা বাতিল করিয়া বড় মাপের ভুল করিয়াছেন। বলা প্রয়োজন, ইঁহারাই অধ্যাপক সায়িদকে এই বক্তৃতা দিতে ডাকিয়াছিলেন । কিন্তু তাঁহাদের অজুহাত ছিল খুবই খোঁড়া। মুখে তাঁহারা বলিয়াছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই’ এই বাতিল ঘোষণা।
কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহারা খেপিয়াছিলেন এডোয়ার্ড সায়িদের হাতে ধরা একটি কংকর দেখিয়া। এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া আমি শেষ করিব। ২০০১ সালের মে মাসে ভিয়েনায় অনুষ্ঠেয় এই বক্তৃতার দাওয়াত সায়িদকে দেওয়া হয় প্রায় এক বছর আগেভাগে, মোতাবেক ২০০০ ঈসায়ি সালের জুলাই মাসে। দুর্ভাগ্যবশত পরবছর অর্থাৎ ২০০১ সালে, দিনমান বলিতে ৮ ফেব্র“য়ারি তারিখে, এই দাওয়াত বাতিল করা হয়। কারণ আগের বছরের একটি ঘটনা ও সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া সৃষ্ট প্রচারণা।
এডোয়ার্ড সায়িদ ২০০০ সালের জুন-জুলাই মাসে সপরিবারে লেবাননে বেড়াইতে গিয়াছেন । জুলাই মাসের ৩ তারিখ নাগাদ লেবানন রাজ্যের দক্ষিণ সীমানায় পৌঁছিলেন তিনি। সেখানে ‘খিয়াম’ নামক জায়গায় একটি কুখ্যাত এসরায়েলি বন্দিশালা ছিল। ঐ শালায় কয়েক হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে হত্যা করা হয়, নির্যাতন করা হয় আরো অনেক মানুষকে। ২০০০ সালে সেই জায়গা হইতে যুদ্ধের কারণে ঐ বন্দিশালা উঠিয়া গিয়াছে। সায়িদ ও সঙ্গের জোয়ান মানুষজন শূন্যস্থান লক্ষ্য করিয়া সেই দিকে কয়েকটি কংকর ছুঁড়িয়া মারিলেন। সেই শূন্যস্থানে তখন কোন মানুষজনই ছিল না। না সমর-সম্বন্ধীয় না অন্য ব্যবসা-সম্বন্ধীয়। দুইদিন পর এসরায়েলের পত্রপত্রিকা ও দূরদর্শনে সেই ছবি প্রচারিত হইয়া পশ্চিমে ছড়াইল। সায়িদের পরিচয় দাঁড়াইল ‘প্রস্তর নিক্ষেপরত ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদী’। অবশ্য তাঁহাকে অনেক আগেই ‘সন্ত্রাসের অধ্যাপক’ পুরস্কার দিয়াছিল এসরায়েলি আর পশ্চিমা প্রচার।
ভিয়েনার ‘ফ্রয়েড প্রতিষ্ঠান ও জাদুঘর’ সেই কারণেই এই বক্তৃতা বিয়োজন করিলেন। ভিয়েনা হইতে খোদ ফ্রয়েডও একবার লন্ডনে সর্বশেষ নির্বাসিত হইয়াছিলেন। ১৯৩৯ সালে সেখানেই তিনি এন্তেকাল করেন। হয়তো সেই স্মৃতি জিয়াইয়া রাখিবার মানসেই লন্ডনের ফ্রয়েড জাদুঘর একই কায়দায় ভিয়েনায় বিয়োজিত ফ্রয়েড বক্তৃতার আয়োজন শেষমেশ করিলেন খোদ মহানগর লন্ডনেই।
ফ্রয়েড বিপ্লবী রাজনীতি করিতেন এই অপবাদ তাঁহার চরম শত্র“ও দিবেন না। এডোয়ার্ড সায়িদও শক্তি প্রয়োগ করিয়া শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহা মনে করিতেন না। তাঁহার বক্তৃতায় যে সত্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তাহা যে কোন কংকরের সহিত প্রতিযোগিতায় পর্যন্ত জিতিয়া যাইবে। এমনকি কোন কোন বোমার সহিতও ইহার তুলনা চলিবে। তবে এই বোমা মনে হইতেছে আত্মঘাতী হইবে না।
ঢাকা, ২/১০/২০০৭
দোহাই
1. Edward W. Said, Freud and the Non-European, reprint (London: Verso, 2004).
2. Edward W. Said, From Oslo to Iraq and the Road Map: Essays (New York: Pantheon Books, 2004).
১৮ অক্টোবর ২০০৭, বিডিনিউজ২৪ডটকম
একজন বাঙালির লেখা এমন আড়ষ্ট ও বিদ্যাসাগরেরও আগের জটিল সাধু গদ্যরীতি কেন!
সহজ সরল বাংলায় লেখা হলে অনেক বোধগম্য হতো।