বিষয় সলিমুল্লাহ খান

অর্থ–পারভেজ আলম

Spread the love

অর্থ
সলিমুল্লাহ খান

‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’
লিখতে সে ভুলে
লিখেছে ইশকুলে
‘তোরা দেখে যা আমি না মায়ের কোলে’
বলুন পাঠক কহুন পাঠিকা
কি নকল করল সে কবি নজরূল থিকা !
আমি নার মধ্যে থামি আমিনার মধ্যে থামি না
আমির অর্থও শুদ্ধ আমি না
কি এই নায়ের অর্থ যদি অন্তর্যামি না?
না বলেই হা বলি কোলে থাকি নামি না
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে আমি না।

(১৯৯৮)
——-

গত পরশু সলিমুল্লাহ খানের জন্মদিন ছিল। নানান ব্যস্ততায় খেয়াল করা হয় নাই। খানের এই পুরাতন কবিতাটা অতি সম্প্রতি চোখে পড়েছে। এই অসাধারণ কবিতা নিয়ে ব্যাখ্যামূলক আলাপ করতে গেলে সময় লাগবে। তাও পাঠকের সুবিধার্থে কবিতাটার কয়েকটি বিশেষ দিক টুকে রাখলামঃ

১। স্টাইল ও ভাব-ভাবুকতার দিক থেকে কবিতাটি উত্তর-আধুনিকতা, আধুনিকতা, ও ক্লাসিকাল (প্রাগাধুনিক) বাংলা কবিতার সাবলীল মিশেল।

২। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গজল “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে”র ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি হলো এই কবিতার প্রাণ। “কে এলো” – নজরুলের গজলে উত্থাপিত এই প্রশ্নটি খানের কবিতাতেও রয়ে গেছে। এবং নজরুল এই প্রশ্নের যে উত্তর দিয়েছেন (ইতিবাচক ভাষায় না হলেও), খানের কবিতাতেও তার ধারাবাহিকতা পাওয়া যাবে। কে এলো আমিনা মায়ের কোলে? নজরুল এই প্রশ্নের উত্তরে যে ইশারা করেছেন, তা বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত আশারি-মাতুরিদি কালামতত্ত্ব ও সুফিতত্ত্বের সিলসিলা বহন করে। তার ভাষায়ঃ

“খোদার জ্যোতি পেশানিতে ফোটে কে এলো ওই
আকাশ গ্রহ তারা পড়ে লুটে কে এলো ওই”

হ্যা, নজরুল সরাসরি উত্তর দিচ্ছেন না বটে। কিন্তু খোদার জ্যোতি বা নূর কার কপালে ফুটে ওঠে? কোন সে সত্ত্বা, যার সামনে গ্রহ-নক্ষত্র-আসমান সব লুটিয়ে পড়ে (বা সেজদা দেয়)? নজরুল সরাসরি উত্তর না দিলেও তার ব্যবহৃত রূপকগুলার মধ্যেই উত্তরের ইশারা রয়ে গেছে। এবং, উত্তরটাতো বাঙালি মুসলমান মাত্রই জানেন। এহলো নূর মুহাম্মদ বা রুহুল কুদ্দুস বা ইনসানে কামেলের ধারণা। খোদ আদর্শ মানুষ বা আদমেরই ধারনা। আল্লাহ বা পরমের সবচাইতে নিকটবর্তী সত্ত্বার ধারণা।

কে এলো – এই প্রশ্নটি যে নজরুলই প্রথম করেছেন তা না। বাঙলা ভাষার কবি-ভাবুকরা তার আগেও সরাসরি উত্তর না দিয়ে এবং মূলত প্রশ্ন তোলার মাধ্যমেই নূর নবী ও ইতিহাসের মাটিতে জন্ম নেয়া নবী (এবং খোদ মানব জাতির) সম্পর্ক নিয়ে আলাপ তুলেছেন। যেমন, ফকির লালন গেয়েছেনঃ

“মদিনায় রাসুল নামে কে এল ভাই।
কায়াধারী হয়ে কেন তার ছায়া নাই।।”

৩। কিন্তু নজরুলের কবিতায় যেই ট্রান্সেন্ডেন্টাল রূহ বা প্রাণের এই ধরায় আগমনের বর্ণনা পাওয়া যায়, সে কি খানের কবিতাতেও উপস্থিত আছেন? “বলুন পাঠক কহুন পাঠিকা – কি নকল করল সে কবি নজরূল থিকা”! খান কী নকল করেছেন? আর নিজের আকল ও খেয়াল কতোটুকু ব্যবহার করেছেন?

এ বিষয়েও বেশি আলোচনা করা আপাতত সম্ভব না। তবে, যা বলা দরকার, এই কবিতায় কেবল বাঙলার পুরাতন কাব্য ও ভাবুকতার নকলই করা হয়েছে, তা না। বিখ্যাত সাইকোএনালিস্ট জাক লাকাঁকেও খান এইক্ষেত্রে নকল বা অনুসরণ করেছেন। এবং যেহেতু লাকাঁনিয় সাইকোএনালিসিসের ফ্রেমওয়ার্কে হেগেলিয় ডায়ালেক্টিক্সও উপস্থিত আছে, সেহেতু, হেগেলের নকলও এই কবিতায় পাওয়া যাবে।

লাকাঁ কথিত যেই রিয়েল বা “সত্য”, তাকে যেমন প্রতীক বা প্রতীকী ব্যবস্থার (বা ভাষার) মধ্যে ধরা যায় না, তেমনি কল্পনা তথা খেয়ালের দিগন্তেও সে অধরা রয়ে যায়। কেনোনা, “আমি” নামক যেই সাবজেক্ট বা কর্তা, তিনি গঠিত হন ভাষা তথা প্রতীকী ব্যবস্থায় প্রবেশ করার মাধ্যমে। এবং তা করতে গিয়ে, মায়ের সাথে (মা আমিনা তথা প্রকৃতির সাথে) তার বিচ্ছেদ ঘটে। লাকাঁর তত্ত্ব মোতাবেক, ভাষার দুনিয়া হলো বাপেদের দুনিয়া। বিগ আদার তথা বড় বাপেরাই এই দুনিয়ার প্রভু (কখনো কখনো “জাতির পিতা” নামক অবতার রূপে তার পূজা করা হয়)। এই দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ পরমকেও কল্পনা করে স্বৈরাচারী ও সার্বভৌম বাপ রূপে।

নারীবাদী অনেক তাত্ত্বিকের ক্রিটিক মোতাবেক, লাকাঁর চিন্তার অন্যতম দুর্বলতা হলো যে তা নারীকে রাখে ভাষা তথা প্রতিকী ব্যবস্থার পূর্বে ও বাইরে। মানে, প্রকৃতি ও পুরুষের বিচ্ছেদকে পুনরুৎপাদন করে লাকাঁর তত্ত্ব। আমি নারীবাদী তাত্ত্বিকদের এই ক্রিটিকের সাথে একমত। অবশ্য গত শতকের ধাতবাদী নারীবাদীরা (যারা নারী ও পুরুষের ধাতগত পার্থক্যে বিশ্বাস করতেন) লাকাঁর এই তত্ত্ব ব্যবহার করে নতুন ধরণের লেখা ও তাত্ত্বিকতারও জন্ম দিয়েছিলেন। যেমন ইলেন সিক্সুস প্রচারিত “নারীর লেখা” (Écriture féminine) নামক তত্ত্ব ও স্টাইল প্রবলভাবেই লাকাঁর তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল ছিল।

মা আমিনা বা প্রকৃতির সাথে বিচ্ছেদ খানের এই কবিতারও বিষয়বস্তু। কিন্তু এই বিচ্ছেদকে কবি পূর্ণতা দিয়েছেন, তা বলা যাবে না। এই কবিতার যে “আমি না”, তিঁনিতো ভাষা তথা প্রতীকী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে পড়া কোন বড় অপর বা বিগ আদার না (যেহেতু পুরুষ “আমি”র সাথে তার সম্পর্কটা নেতিবাচক)। এই কবিতার “আমি” মা আমিনার কোল থেকে নামেন না, আবার তার কোলে থাকেন/থামেনও না। এই দ্ব্যর্থতার মধ্যে সুফিতত্ত্ব ও বাঙলার ফকিরি দার্শনিকতার সিলসিলা দেখা কঠিন নয়। কিন্তু এরমধ্যে লাকাঁর প্রভাবও আছে কী? মনে হয় না। বরং, কবি এইক্ষেত্রে লাকাঁর ধাতবাদী চিন্তার সাথে একটা নফি বা নেতির সম্পর্ক রচনা করেছেন বলেই মনে হয়। অথবা, আমি লাকাঁ অতো ভালো বুঝি না এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দেয়ার জন্যে। খান নিজে ভাল বলতে পারবেন। কিংবা লাকাঁর আরেক অনুরাগী তরুণ বুদ্ধিজীবী তাহসিন আহমেদ অমিও চেষ্টা করতে পারেন উত্তর দেয়ার।

৪। কবিতাটি নেতিবাচক/নেগেটিভ ডায়ালেক্টিক নির্ভর। নফির (নিগেশন) ব্যবহার নজরুলের গজলটিতেও ছিল। তবে, খানের কবিতাটি নফির ব্যবহারকে নিয়ে গেছে আরো চূড়ান্ত একটি দিগন্তে। যিনি মা আমিনার কোলে, তিঁনি হলেন – আমি না। তিঁনি সেই প্রতীকি ব্যবস্থার ঊর্ধজগতের সত্ত্বা, যেই প্রতীকী ব্যবস্থার মধ্যে “আমি” নামক সাবজেক্ট গঠিত হয়েছে। আমি না (ব্যতিত) যেই সমগ্র, যেই সমগ্র থেকে বিচ্ছন্নতা হলো “আমি”র স্বরূপ, তিঁনিই হলেন আমি না, যিনি এসেছেন মা আমিনার কোলে। এই কবিতায় তাই একমাত্র যেই এজবাত (হ্যা) করা হয়েছে, তা কালেমার মতোই একধরণের নফি-এজবাত, যাতে না-এর পথ ধরেই কেবল হ্যা বলা সম্ভব। কবির ভাষায়ঃ

“আমির অর্থও শুদ্ধ আমি না
কি এই নায়ের অর্থ যদি অন্তর্যামি না?
না বলেই হা বলি কোলে থাকি নামি না।”

খানের কবিতায় এহেন নেগেটিভ ডায়ালেক্টিকের প্রাবল্যের কারন কি কেবলই লাকাঁর (ও লাকাঁর তত্ত্বে উপস্থিত হেগেলের) প্রভাব? না কি ফ্রাংকফুর্ট স্কুলের নেগেটিভ ডায়ালেক্টিক্সের সিলসিলাও তিনি ধারণ করেন? এর উত্তর হ্যা হতে পারে। আবার নাও পারে। নফির শক্তি বাংলা কবিতা ও দর্শনের অন্যতম শক্তি। খানের কবিতায় এর উপস্থিতির জন্যে হেগেল-লাকাঁ-ফ্রাংকফুর্ট স্কুলের নকল জরুরি নয়। আগেই দেখিয়েছি, খোদ নজরুলের গজলটাতেও এজবাতের চাইতে নফির জোর বেশি।

“নফি-এজবাত যে জানে না, মিছেরে তার পড়াশোনা” – লালনের এই বাণীটি যথেষ্ট বিখ্যাত। সত্যও বটে। আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি সমাজ যদি আসলেই নফি-এজবাত (নিগেশন-এফার্মেশন) বুঝতো, তবে তারা হেগেলের ফেনোমেনলজি অফ স্পিরিট বুঝতেও এতো গলদঘর্ম হইতো না। কিন্তু নফি-এজবাত না বোঝায় তারা হেগেলও ঠিকমতো বোঝেন নাই। এবং ফলস্বরূপ, হেগেল যে সিন্থেসিসের কথা বলেছেন, তাও বোঝেন নাই। মানে, হেগেল কথিত আউফহেবুং বা সাবলেশন যে একধরণের ফানা-বাকা বিষয়ক তত্ত্ব (আমির ফানার মাধ্যমে বর্তমানে পরমকে ধরবার তত্ত্ব), সেটা বুঝতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন (যে ব্যর্থতাকে আমরা পেছনে ফেলেছি কেবলই অতি সাম্প্রতিক কালে)। আরবি-ফারসি ভোকাবুলারি এবং সুফি ও ফকিরি চিন্তাকে বুঝতে না চাওয়ার কারনে সাফার করতে হয়েছে আধুনিক শিক্ষিত বাঙালিকে।

অথচ হেগেল ও লালন একই সময়ের মানুষ ছিলেন। এবং হেগেলের মতোই, লালনের নফি-এজবাত সংক্রান্ত তত্ত্বেও নফি বা নিগেশনের জোরটাই বেশি। হ্যা, লালন বিভিন্ন সময়ে বলেছেন নফি-এজবাতের গুরুত্বের কথা। কিন্তু পরমের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি বরাবরই নফির লজিকাল অপারেশনের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। লালনইতো দাবি করেছেনঃ “নফির জোরে পাবি দেখা, বেদে নাই যার চিহ্নরেখা”। এবং তিনিইতো গেয়েছেনঃ

“আহামদ লিখিতে
মিম নফি হয় তাঁর কিসেতে
সিরাজ শাঁই কয় নফি করতে
তাতে লালন কিঞ্চিত নজির দেখে তাঁর।।”

ছবিঃ যদিও এই লেখাটা লিখলাম সলিমুল্লাহ খানের ৬৭ তম জন্মদিন উদযাপন করতে গিয়ে, কিন্তু কবিতার বিষয়বস্তুর (“আমি না”) কারনেই খানের ছবি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকলাম। তার বদলে কবিতার মূল থিমের (নবীর জন্ম) সাথে জড়িত দুইটা প্রাগাধুনিক মিনিয়েচারের ছবি দিলাম। প্রথম ছবিটা ওসমানি আমলের তুর্কির। দ্বিতীয় ছবিটা মুঘোল আমলের হিন্দুস্তানের। দুই ছবির মূল থিমে মিল আছে (একটা আরেকটার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে)। দুই ছবিতেই নবীর জন্মকে ধরায় নূরের আগমন হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ফারাক হলো যে ওসমানিদের ছবিটাতে নবী মা আমিনার কোলে রয়ে গেছেন। আর মুঘোলদের ছবিটাতে তিনি কোল থেকে পুরাপুরি বিচ্ছিন্ন। আমার ব্যক্তিগত পছন্দ ওসমানিদের ছবিটাই, তাই প্রথমে ওটাই দেবো ভেবেছিলাম। পরে মনে হইল যে খানের কবিতার যেই দ্ব্যর্থতা, তা প্রকাশ করার জন্যে দুইটা ছবিই দেয়া যাইতে পারে।

 

পারভেজ আলম

২০ আগস্ট ২০২৫