সাক্ষাৎকার

বিভাজনের রাজনীতিকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা হচ্ছে

Spread the love

প্রথিতযশা বাংলাদেশি লেখক, গবেষক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি পণ্ডিত ও গণবুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রসিদ্ধ। দেশের তরুণ লেখক ও চিন্তকদের মধ্যে সলিমুল্লাহ খানের অনুসারী রয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার দৃঢ় ভূমিকা হাসিনাশাহীর পতনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। মূলত হাসিনা সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন ও হত্যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি স্পষ্ট ভাষায় আওয়ামী লীগ শাসনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তার ওই বক্তব্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে ভূমিকা রেখেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাত মাস অতিবাহিত হয়েছে দেশ চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ পরিস্থিতিতে দেশের সাম্প্রতিক কিছু বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী

দেশ রূপান্তর : হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশ নানামুখী অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ফের শাহবাগ ও শাপলা চত্বর নিয়ে একটা ডিসকোর্স হাজির করার চেষ্টা দেখতে পারছি। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সলিমুল্লাহ খান : হাসিনার পতনের সময় নানা শ্রেণির, নানা পেশার, নানা মতবাদের লোক একত্র হয়েছিল। সে জন্যই হাসিনার পতন সম্ভব হয়েছে। এখন দেখা গেছে হাসিনার সমর্থকরা নানা রকমের আন্দোলন করার চেষ্টা করছে; আন্দোলন বলব না, তারা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এখন হাসিনার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন তাদের প্রধান দাবি কি ছিল?  আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এটা কোটাবিরোধী বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন। কিন্তু তাতে ব্যাপক জনগণ কেন এলো? এলো যে তার কারণ, হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, লুণ্ঠন এবং সম্পদ পাচারের মাধ্যমে সর্বনাশ করা হয়েছিল। এটা এক নম্বর। দুই নম্বরে মানুষের বাকস্বাধীনতা থেকে শুরু করে প্রাণের স্বাধীনতা পর্যন্ত লুণ্ঠন করেছিলেন তিনি। গুম, জোরপূর্বক অপহরণ এবং ক্রসফায়ারের নামে হত্যা অর্থাৎ একটা দমবন্ধ অবস্থা ছিল। এ জন্য মানুষ যারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তাদের একটাই দাবি ছিল, এই দমবন্ধ অবস্থার অবসান হওয়ার দরকার। কিন্তু ভবিষ্যত কী হবে এটা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব কার্যকর আছে। এই যে শাহবাগ এবং শাপলা এই জোড়া কথাটা আমি পছন্দ করি না। শাহবাগ আন্দোলনে নানান রাজনৈতিক দল ও মতবাদের লোক যুক্ত হয়েছিলেন। একদল বিশুদ্ধভাবে ১৯৭১-এ যুদ্ধাপরাধ যারা করেছেন তাদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। তারা মনে করেছিলেন যে হাসিনা সরকার বিচারের নামে একটা প্রহসন করছে অর্থাৎ বিচারের ভান করছেন বটে তবে সত্যিকারের বিচার করবেন কি না সন্দেহ ছিল। এ জন্য বিচারটা যেন ন্যায় এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে হয় সেজন্য বহু মানুষ দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু হাসিনা সরকার সেটাকে সুকৌশলে নিজের পক্ষে কাজে লাগিয়েছে। আন্দোলনকেও যে ছিনতাই করা যায় এটা হচ্ছে তার উদাহরণ।

তার বিপরীতে যে আন্দোলনকে শাপলা বলা হচ্ছে, সেখানেও দেখা গেছে নানামুখী লোক একত্র হয়েছিলেন। এই যে দুটো শক্তির যে লড়াই বলা হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। লড়াই একটাই, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কোনো যুদ্ধাপরাধ হয়েছিল কি হয়নি? যদি হয়ে থাকে, যারা যারা এটার সঙ্গে যুক্ত, পাকিস্তানি এবং তাদের সহযোগীরা, তাদের বিচার হওয়া উচিত নাকি উচিত নয়? এটা বিলম্বিত হলো কেন? এই আন্দোলন তো বেগম জাহানারা ইমাম শুরু করেছিলেন ১৯৯০-এর দশকে, তাহলে অসমাপ্ত সেই বিচারের প্রক্রিয়া যখন হাসিনা সরকার শুরু করল তখন হাসিনা সরকারকে চাপে রাখার জন্য কিছু কিছু লোক এই আন্দোলনে গিয়েছিলেন যাতে তারা আপস না করেন। এটা হাসিনার প্রতি অবিশ্বাস থেকে হয়। কিন্তু হাসিনা সরকার এটাকে কৌশলে নিজের পক্ষে নিয়ে তার পক্ষে ম্যান্ডেট হিসেবে দেখিয়ে যা ইচ্ছে করার- করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সম্মতি আদায় করেছেন আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও ঘটিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আন্দোলন হলো কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো না কেন? এটা থেকেই বোঝা যায় শাহবাগ আন্দোলনের দুর্বলতা। তাদের দোষটা তো আগে দেখতে হবে। এখন যে সবাইকে হরেদরে গড়পড়তায় শাহবাগী বলে গালি দেওয়া হচ্ছে এটা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রচারণার কৌশল। এর মধ্যে সারবত্তা কিছু নেই, কারণ শাহবাগী বলে কোনো বিশেষ প্রাণী নেই।

শাহবাগে একত্র হয়েছিল শত রকমের মানুষ, শাহবাগ হচ্ছে একটা এনসাইক্লোপিডিয়ার মতো যেখানে বহু এন্ট্রি ছিল এবং আমরা তখন শাহবাগে দাঁড়িয়ে শাহবাগের সমালোচনা করেছি। অর্থাৎ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার জন্য আওয়ামী লীগও দায়ী, আওয়ামী লীগকে চাপ দেওয়ার জন্য বহু লোক এখানে সমবেত হয়েছিলেন। কি কারণে, কি উদ্দেশে, কে কি বলছে সেগুলোর তো রেকর্ড আছে। এখন শাহবাগকে দমন বা মোকাবিলার জন্য একদল লোক কৌশলটা বের করল। তারা ইসলামবিরোধী বলে শাহবাগ আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করে হেফাজতের, নানান মাদ্রাসার ছাত্রসহ বহু লোককে সমবেত করলেন।

একটা জিনিস হলো কি, বাংলাদেশে কেউ ইসলামবিদ্বেষী নয়। বাংলাদেশে যেটা বাস্তব প্রশ্নে সেটা হচ্ছে কোন ধরনের ইসলাম আমরা চাই! এটা ছিল বাংলাদেশে আলোচনার বিষয়। মানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কিংবা ইসলাম বিরোধিতা আমাদের প্রশ্ন নয়। ইসলামের ভেতরে নানা মতবাদ আছে অর্থাৎ নানা ব্যাখ্যা আছে। নানা মজহাব আছে। এই নানা ধরনের ধারার মধ্যে বিরোধ আছে। বাংলাদেশে ইসলামবিরোধী বলে কোনো মুসলমান নেই। এমনকি যারা সেকুলারাইজেশনের কথা বলেন, তারা কিন্তু ইসলামের বিরোধিতা করেন না; তারা ইসলাম বিকাশের ভিন্নপথ প্রস্তাব করেন, সেটা তারা ভুল বলুন-শুদ্ধ বলুন সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়। কিন্তু শাপলায় নাস্তিক বনাম আস্তিক নামে একটা আজব তর্ক সামনে নিয়ে আসা হলো। এটা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সফল হয়নি। সেই কারণে তারা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করতে পারেননি। মানে শাপলায় যারা গিয়েছেন তারা তো মোটিভেটেড; তারা ছাড়া আর কেউ সেখানে নেই। তারা বলছেন কি, আমরা নবীজির সম্মান রাখার জন্য এখানে এসেছি। নবীজিকে যে বা যারা অপমান করেছে, সে তো ফ্রান্সে, সালমান রুশদি ইংল্যান্ডে। বাংলাদেশে নবীজিকে অপমান করার মতো কোনো দৃশ্যমান ঘটনা ছিল না, কেউ করেওনি।

দেশ রূপান্তর: কিন্তু কিছু ব্লগার তো ছিল।

সলিমুল্লাহ খান: না না, এদের মানুষ মনে করি না আমি। এরা হলো ঊনমানুষ। এরা সমাজে কোনো প্রভাবশালী অংশ নয়। যারা এ ধরনের ব্লগ লেখে তাদের বাংলায় বলে প্রান্তিক, মার্জিনাল। সুতরাং এদের টেনে সামনে এনে রাজনৈতিক ইস্যু করার প্রয়োজন ছিল বা আছে বলে আমি মনে করি না। তাহলে শাহবাগ এবং শাপলার নামে যে একটা বাইনারি তৈরি করা হলো- সেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। একটা বিষয় ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সেটা করা উচিত কি উচিত না, আলোচনা চলতেই পারত। সেটা সরিয়ে বলা হলো এরা নাস্তিক নাকি আস্তিক। দুটো কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ডিসকোর্স। এটা দিয়ে মোকাবিলা করার যে কৌশল, সেটা সফল হয়নি।

দেশ রূপান্তর: শাহবাগ বা গণজাগরণ মঞ্চ ক্যাপচার করে নিল। আর শাপলা চত্বরে যে জমায়েত হলো সেটাকে তো দমন করার কথা বলা হয়, আসলে কি হলো? সেই বাইনারি বিভাজন কি আবার ফিরে আসছে?

সলিমুল্লাহ খান: হাসিনা সেটাকে একদিকে দমন করলেন আরেক দিকে করলেন ক্যাপচার। উনি সেখানে রাতে সাউন্ড গ্রেনেড মেরে তাদের তাড়িয়ে দিলেন, এটাকে গণহত্যা বলছেন অনেকে। কতজনকে হত্যা করা হয়েছে সে পরিসংখ্যান এখনো প্রকাশিত হয়নি। তার সর্বোচ্চ তালিকা যেটা প্রকাশ করা হয়েছিল অধিকারের পক্ষ থেকে সেটার সংখ্যা ৬০/৭০ এর বেশি নয়। একজনকে হত্যা করাও অন্যায়। কাজেই সংখ্যা দিয়ে আমি এখানে ঘটনার গুরুত্বকে লাঘব করব না। কিন্তু এখনো যে সংখ্যাটা প্রকাশিত হয়নি এটা অস্বীকার করি কি করে! সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বললেন সংখ্যাটা তারা এখনো জানেন না। এতেই বোঝা যাচ্ছে ঐটা অনেক বেশি তৈরি করা বিষয়। অর্থাৎ দমন তো হয়েছে, দমনের পরে হেফাজতের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হাসিনার আনুগত্য স্বীকার করেছে (কওমি জননী উপাধি দিয়েছে)। এ কথাগুলো মনে রাখলে ভালো হবে।

বলতে চাচ্ছি শাহবাগকেও আত্মসাৎ করেছে হাসিনা রেজিম, শাপলাকেও আত্মসাৎ করেছে। দুভাবেই করেছে, দমন এবং আত্মসাৎ। ইংরেজিতে বললে- ক্যারোট অ্যান্ড স্টিক। তিনি প্রথমে মেরেছেন এরপর তাদের মূলা ঝুলিয়েছেন অর্থাৎ স্বীকৃতি দিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সংবর্ধনা নিয়েছেন। আর শাহবাগে প্রথমে এদের ক্যারট দেখিয়েছেন। মানে প্রথমে সরকারের তরফ থেকে তাদের খাওয়া দাওয়া দেওয়া হয়েছে, পরে এদের পিটিয়ে বের করে দিয়েছে।

দুটোর মধ্যে কিন্তু একটা বৈপরীত্য আছে। জিনিসটার একটা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দরকার। এটা ছিল আরবান মুভমেন্ট; আরবান ইউথের সমাবেশ হয়েছিল শাহবাগে আর শাপলায় রুরাল লোকজন এসেছে। ফলে এর মধ্যে একটা শ্রেণিবৈষম্যও দেখা গিয়েছে। ওখানে শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্তের সমাবেশ, প্রথম দিকের কথা বলছি। আর ওটা ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত গ্রাম থেকে যারা আসে, কৃষক মুসলমান তাদের সমাবেশ। এটা আপনি লক্ষ করতে পারেন, আমরা পরে টের পেতে শুরু করলাম যে, ভারতে কবির সুমনের মতো লোকও শাহবাগ নিয়ে গান লিখলেন। কাজেই ভারতীয়রা শাহবাগকে মনে করল নিজেদের এবং বলল যে, শাপলা পক্ষ বলল এটা নাস্তিকদের আন্দোলন। ভারতের অতিরিক্ত সমর্থনে ঐটাকে প্রায় সত্য বলে মনে হলো।

এই যে ডিনামিক, সেটা পরের ১০ বছরে একপ্রকারে ভেঙে গেছে। এই কথাটার সারকথা বলছি যদি এটা ভেঙে না যেত হাসিনার পতন হতো না। শাহবাগের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এবং শাপলা চত্বরে মার খাওয়ার পরও যারা হাসিনার কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল তাদেরও একটা অংশ এসে জুলাইতে যুক্ত হয়েছে বলেই হাসিনার পতন হয়েছে। যে বাইনারির কথা আপনি বললেন, সে বাইনারিটা চিরস্থায়ী নয়। অনেকে মনে করতে পারেন এটা বোধহয় চিরস্থায়ী।

দেশ রূপান্তর : কিন্তু একটা শঙ্কা তো তৈরি হয়েছে যে বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে…

সলিমুল্লাহ খান : না না, আমি বলছি আপনাকে তো, একটা ঘটনায় যেতে হবে, লাফ দিলে তো চলবে না। আমি বলছি, ১৯৯০-এর দশকে যে যুদ্ধাপরাধবিরোধী বিচারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল সেটারই কালমিনেশন শাহবাগ। বেগম জাহানারা ইমাম থেকে ইমরান এইচ সরকার ধরেন। এখন ইমরান এইচ সরকারকে আওয়ামী সরকার পেট্রোনাইজ করেছে। ইতিহাসের খাতিরে সত্য কথা তো বলতে হবে। আর সে সত্যের মোকাবিলা করার জন্য আরেকটা বাইনারি খাড়া করিয়েছে, কে খাড়া করেছে আমি সে কথা বলছি না। কিন্তু তার পরের ১০ বছরে বাইনারি যদি ভেঙে না যেত হাসিনার পতন হতো না। মানে শাহবাগে যারা প্রথম দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সমবেত ছিলেন তাদের বেশিরভাগই অতিক্ষুদ্র অংশ ছাড়া, আওয়ামী লেস্পেন্সাররা ছাড়া আর সবাই হাসিনার বিরোধিতায় নেমেছেন। সুতরাং শাহবাগ হাসিনার পক্ষে এবং শাপলা হাসিনার বিপক্ষে এই বাইনারিতে বিষয়টা দেখা যাবে না। আপনি যে শঙ্কার কথা বলছেন, কেউ কেউ সেই পুরনো স্মৃতি জাগ্রত করে হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে।

দেশ রূপান্তর : ঢাকা ইউনিভার্সিটির কিছু স্টুডেন্ট ধর্ষণবিরোধী মুভমেন্ট করছিল, শাহবাগ নামেও করেনি আবার শাহবাগের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যেটা হয়েছিল সেটা হয়েছিল ‘গণজাগরণ মঞ্চ’-এর ব্যানারে। তো এখন আমরা দেখছি যে, স্থানের নাম দিয়ে যে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে, প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ পেছনে বা আড়ালে চলে যাচ্ছে। যেখানে শাহবাগ একটা লিবারেল স্পেস যেখানে বিভিন্ন মতের, প্র্যাক্টিসের লোকজনের জমায়েতের একটা জায়গা, একটা মুক্তচিন্তার জায়গা বলে আমরা চিনতাম। আপনিও আমাদের অনুষ্ঠানে পার্কে গিয়েছেন। যে স্পেসটা ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ এর আগে থেকেই আওয়ামী লীগ নষ্ট করার চেষ্টা করছিল। যেমন, ছবির হাট বন্ধ করে দেওয়া। যেই স্পেসে ভিন্নমত ও নানা মাধ্যমের শিল্পী-চিন্তকদের সম্মিলন হতো। মূলত একটা প্রোগ্রেসিভ জায়গা যেখানে সেক্যুলার স্পেস ছিল। এটা কি সেকুলার স্পেসকে ধ্বংস করার, প্রশ্নবিদ্ধ করার সম্ভাবনা দেখেন? একই সঙ্গে শাপলার ক্ষেত্রেও বলতে পারেন যে কেন শাপলা? ওখানে তো তাদেরও প্ল্যাটফর্ম ছিল, নাম ছিল। সেগুলোকে পলিটিক্যালি আইডেন্টিফিকেশন করা যায়। এগুলোকে বাদ দিয়ে, স্থানের নামে করা হচ্ছে সেটা কি একটা সমস্যা কি না? 

সলিমুল্লাহ খান : অবশ্যই সমস্যা, এটা দিয়ে বিভাজনের রাজনীতিকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনিও এ কথাটিই বলেছেন। আমি মনে করি না যে এটা স্বতঃস্ফূর্ত। আমার দুটো বক্তব্য। প্রথম, শাহবাগ এবং শাপলা নামে যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল সেটাও স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। পরে হাসিনার অপশাসন, ফ্যাসিস্ট শাসনের তোড়ে সেই বাইনারি ভেঙে গেছে, মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে অ্যাক্রস শাহবাগ অ্যান্ড শাপলা। এখন সেই পুরাতন বিভাজনটা পুনর্জীবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। শাহবাগ মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মানে বিষয়টা হচ্ছে আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনাম কওমি মাদ্রাসা। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকমই। শাহবাগ একটা প্রতীকী শব্দ, এটা বলতে সুবিধা হয়। ঢাকা ভার্সিটি বলতে বাংলাদেশের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। এটাকে বলা হয় সেকুলার এডুকেশনের কেন্দ্র, আধুনিক শিক্ষাকেন্দ্র, যেটা ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটার তো পেছনের অনেক ইতিহাস আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলতে অনেক কথার সার হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আরও দশ ইংরেজি বিদ্যালয়, মানে কথার কথা বললাম। এখানে মুসলিম লিগ তৈরি হয়েছিল, এখানে বাগানবাড়ি ছিল নবাবদের, যেটায় নিখিল ভারত মুসলিম লিগ হয়েছিল ১৯০৬-এর ডিসেম্বর। যা হোক লম্বা কথায় যাচ্ছি না। শাহবাগ এবং শাপলা নামে যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল সেটা জনগণের আন্দোলনের মধ্যেই ভেঙে গিয়েছিল। সেটা পুনর্জীবিত করা মানে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের শক্তি যে এখন বিভক্ত হচ্ছে সেই বিভক্তিকে আরও বিভক্ত করা। কেউ কেউ পরিকল্পিতভাবে এই বিভাজনটা তুলছে।

দেশ রূপান্তর : জামায়াতের পুনরুত্থানকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন বা দেখছেন এখন? 

সলিমুল্লাহ খান : এটা হাসিনার অপকর্মের ফল; জামায়াতের পুনরুত্থানে হাসিনা সহায়তা করেছেন। যেকোনো দুঃশাসন, যেকোনো অপশাসন, যেকোনো ফ্যাসিবাদী শাসন সমাজের মধ্যে বিরোধের জন্ম দেয় এবং এই বিরোধের মধ্যে অতীতে বাংলাদেশকে যারা মেনে নিতে পারেননি তারাও কিন্তু বাংলাদেশেই বসবাস করেছেন, বাংলাদেশে বসবাস করেছেন, মানে আইডিওলজিটার প্রচার করছেন। তো হাসিনার অপশাসনের বিরুদ্ধে কেউ যদি প্রতিবাদ করে সেই প্রতিবাদ তো মানুষ শুনবেই। মানুষ আপনার অতীত দেখবে না। মানুষ দেখবে বর্তমানে ভূমিকাটি কি। কিন্তু বর্তমান দিয়ে অতীত অপরাধের কাফফারা হয়ে গেছে- এই প্রস্তাবের সঙ্গে বোধ হয় একমত হওয়া যাবে না।

দেশ রূপান্তর : জুলাই অভ্যুত্থানে ইসলামিস্ট ও বামদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তৌহিদি জনতার নাম করে একরকম উগ্রবাদ দেখা যাচ্ছে আবার বামদের প্রায় সবাইকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে খারিজ করার প্রবণতাও দেখছি। কিন্তু হাসিনার সুবিধাভোগী ও সমর্থনকারীদের মধ্যে তো ইসলামিস্টদের একটা অংশও ছিল, যেমন ছিল বামদের একটা অংশ। 

সলিমুল্লাহ খান : হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সাফল্য তো আমরা দেখলাম। কিন্তু এর একটা দুর্বলতাও আছে। হাসিনাকে সরে যেতে হবে। এই এক দফাতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। হাসিনার অন্য অপরাধগুলো তখন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। কিন্তু হাসিনা চলে যাওয়ার পর সমাজটা কিভাবে চলবে, কোন ধরনের রাষ্ট্র আমরা চাই সে বিষয়ে কোনো ঐকমত্য ছিল না। যার যার ধারণা তার তার মাথায় ছিল, এখন সেগুলো সব সামনে আসবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি যারা গঠন করেছেন তারা বলছেন নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন করা দরকার। কিন্তু বিএনপি, যারা এই আন্দোলনে ভুক্তভোগী এবং অংশীদার, বলছেন যে একটা জাতীয় সংসদ হলেই চলবে এবং সেখানে তারা আইন প্রণয়ন করবেন, দরকার হলে সংবিধান করবেন। এই যে দুটো মৌলিক পার্থক্য এটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য। কিন্তু যদি মনে করেন সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি কি হবে? হাসিনার আমলটা ছিল মূলত (আমরা যেটাকে এখন দৃষ্টির বাইরে রেখেছি) অর্থনৈতিকভাবে যেটাকে বলা হয় পুঁজির আদিম সঞ্চয়নের যুগ অর্থাৎ আইনবহির্ভূত কর্মকান্ডের যুগ। ভূমি থেকে সোজা কথায় কৃষকদের উচ্ছেদ করে তাদের জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে আবাসিক এলাকা নির্মাণ করা একটা উদাহরণ। যেটার নাম তারা দিয়েছে উন্নয়ন প্রক্রিয়া; তা তো অন্যকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া। সেটা নিয়ে কোনো কথা নেই, এমনকি আমি জানি না জাতীয় নাগরিক পার্টির এ বিষয়ে বক্তব্য কি। তাদের কোনো সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেই। বামপন্থিরা সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে সামনে নিয়ে আসতেন। তারা শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্ন, ন্যূনতম মজুরির প্রশ্ন, নারীর অধিকারের প্রশ্ন, সমান বেতন পাওয়ার প্রশ্ন ইত্যাদি প্রশ্ন তারা শুধু সামনে এনেছেন; বৈষম্য বিরোধিতা একটা বিমূর্ত কর্মসূচি। এটা চিরকালই বামপন্থিদের একচেটিয়া ছিল। এখন নতুন যে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের অনেকেই এসেছেন বামপন্থিদের বাইরে থেকে। ফলে আন্দোলনটা নতুন শক্তিতে শক্তিশালী হয়েছে। তাদের অনেকেই মাদ্রাসার পটভূমি থেকে এসেছেন। কেউ কেউ হয়তো অতীতে অন্যান্য ডানপন্থি দল করতেন। কিন্তু ব্যাপক একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল। এখন নতুন সমাজ কোন বিধানে চলবে এই প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবে একটা বিতর্কের জন্ম দেবে।

আমরা তো বিতর্ক বন্ধ করতে চাই না। বিতর্ক চলবে, সংস্কার চলবে, সমাজের উন্নতি হবে। এখন বামদের আলাদা করে হাসিনার দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটা সেই পুরনো রাজনীতির কৌশল। বামপন্থি বলেই কোনো লোক হাসিনার দোসর নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো সত্যিকারের বামপন্থি হাসিনার দোসর হতে পারেন না। হাসিনার দোসরদের মধ্যে কেউ কেউ বামপন্থি বলে অভিহিত, এটা তাদেরই ব্যতিক্রমী ব্যাপার। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন ষৈম্যবিরোধী আন্দোলনে তো সংবিধান পরিবর্তনের কথা ছিল না। কিন্তু তারা জানেন না রাজনীতিতে প্রতিদিনই বলতে হয় না যে আমি সংবিধান পরিবর্তন করব। গোটা সমাজ যখন বদলাতে হবে তখন তো সমাজের বিধানও বদলাতে হবে। (সংক্ষেপিত)

অনুলিখন: মোজাম্মেল হৃদয়

 

দেশরূপান্তর, ১৬ মার্চ ২০২৫